ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এফ আর টাওয়ার: দুদকের মামলায় আসামি হচ্ছেন ২৫ জন

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২১, ২৫ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এফ আর টাওয়ার: দুদকের মামলায় আসামি হচ্ছেন ২৫ জন

এম এ রহমান: অবৈধ নকশায় তৈরি বনানীর এফ আর টাওয়ার; ১৫ তলা থেকে গড়ে তোলা হয়েছে ২৩ তলা বিশিষ্ট এই ভবন। ১৫ তলা নকশার অনুমোদনেও মানা হয়নি কোনো নীতিমালা। নেই ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিভিল এভিয়েশনের অনুমোদন।

১৮ থেকে ২৩ তলা নির্মাণের কোনো তথ্যই নেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে। জমির মালিক ও ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি প্রশাসনের নাকের ডগায় নিজ সিদ্ধান্তে নির্মাণ করেছে বাকি ৫ তলা।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে মিলেছে এমন ভয়াবহ তথ্য। যেখানে সংশ্লিষ্টতা মিলেছে ভবন মালিক, ডেভেলপার কোম্পানি রূপায়ন গ্রুপ ও রাজধানী উন্নয়ন ‍কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঊর্ধ্বতনদের।

আর এই অভিযোগে রাজউকের প্রাক্তন এক চেয়ারম্যান, একাধিক অথরাইজড অফিসার, ইমারত পরিদর্শক ও রূপায়ন গ্রুপের পরিচালনা পরিষদের কর্তাব্যক্তিসহ ২৫ জনের মত ব্যক্তি মামলার আসামি হচ্ছেন বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্রে জানা গেছে; যারা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এফআর টাওয়ারের ৮ তলা ভবন পর্যন্ত নকশা অনুমোদন বৈধভাবে হলেও ১৫ তলা ভবন অনুমোদনে মানা হয়নি কোনো নিয়মকানুন। প্রথম ধাপে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে সিভিল এভিয়েশনের শর্তসহ বিভিন্ন কারণে নকশা অনুমোদন না দিয়ে এফ আর টাওয়ার কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দিলেও পরবর্তী সময়ে ওই একই বছরের ডিসেম্বরে অদ্ভুত অজুহাতে ১৮ তলার অনুমোদন দেয় রাজউক কর্তৃপক্ষ। অনুমোদন ফাইলে নোট ছিল, ‘আশাপাশের যেহেতু ১৮ তলা আছে তাই নকশা অনুমোদন দেওয়া যায়।’ ফাইলে কাগজপত্র ছিল সবই ভুয়া। নেওয়া হয়নি স্টেট শাখার অনুমোদনও। তাই দোষীদের সনাক্ত করে শিগগিরই অনুসন্ধান রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। কমিশনের অনুমোদন পেলে মামলা করা হবে।’

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘এফআর টাওয়ারের অনিয়মের সঙ্গে কারা জড়িত, সেটা আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে এবং বেরিয়ে আসবে। এদের ক্ষমা হবে না। দোষীরা দুদক থেকে ছাড়া পাবে না।’

এর আগে বনানীর এফ আর টাওয়ার নকশা অনুমোদনে জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন ও রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল, কাশেম ড্রাইসেল ব্যাটারির মালিক ও এফ আর টাওয়ারের বর্ধিত অংশের মালিক তাসভির উল ইসলাম এবং রাজউকের সংশ্লিষ্ট ইমারত পরিদর্শকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

এর পরপরই অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ৩ মার্চ রাজউক, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক), বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেশন কমিটি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, তিতাস গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ও ফায়ার সার্ভিসকে নথিপত্র সংগ্রহে চিঠি দেয় সংস্থাটি। সংস্থার উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের সই করা চিঠিতে ভবনের ছাড়পত্র প্রদান সংক্রান্ত নথির সত্যায়িত কপি, হাইরাইজ ভবনের ছাড়পত্র প্রদান সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট বিধিমালা বা নীতিমালার সত্যায়িত কপি, ভবন নির্মাণের সময়ে কোন কোন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন এবং কতবার ভবন পরিদর্শন করেছেন তার বিববরণসহ প্রতিবেদন ইত্যাদি নথিপত্র চাওয়া হয়েছিল।

দুদকে আসা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ফারুক হোসেন ১৯৯৬ সালে তার মালিকানাধীন ১০ কাঠা জায়গাতে ১৮ তলা ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকে আবেদন করেন। সে অনুসারে ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণের জন্য ফারুক হোসেন মালিকের ৪৫ শতাংশ ও ডেভলপারের ৫৫ শতাংশ হিসেবে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলীর সঙ্গে রাজউকের মাধ্যমে আমমোক্তারনামা চুক্তি করেন। কিন্তু ২০০৫ সালে ভবনের মালিক ফারুক হোসেন কর্তৃক রাজউক অনুমোদিত নকশায় ২৩ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে মর্মে রাজউককে জানানো হয় এবং ২০০৭ সালে বিষয়টি তদন্ত করে অনুমোদিত নকশায় অতিরিক্ত পাঁচতলা নির্মাণের প্রমাণ পেয়েও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে অবৈধভাবে নির্মিত অংশ বিক্রির অনুমোদন দিলে কাশেম ড্রাইসেল ব্যাটারির মালিক তাসভির উল ইসলাম ক্রয় করেন।

গত ২৮ মার্চ দুপুরে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। এতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন।

এদিকে এই ভবনের নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য রাজউকের প্রাক্তন চেয়ারম্যানসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ২২ মে সংবাদ সম্মেলনে এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেন, ‘যাদের নাম এ প্রতিবেদনে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯০ সালে এফ আর টাওয়ারের মাল্টি পারপাস কমার্শিয়াল ১৫ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং অনুমোদন যথাযথ ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ওই ভবনের ১৮ তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ইমারত বিধিমালা মানা হয়নি। ১৯৯৬ সালের ইমারত বিধিমালা জারি হওয়ার পরেও বনানীর এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন করা হয় ১৯৮৪ সালের পুরনো বিধিমালার আলোকে। এক্ষেত্রে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম তার দায় এড়াতে পারেন না।’

এই বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে হুমায়ুন খাদেম ছাড়াও রাজউকের সাবেক সদস্য ডি এম ব্যাপারী, রাজউকের সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ জাকির হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, সাবেক অথরাইজড অফিসার-২ সৈয়দ মকবুল আহমেদ, সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ এবং জমির মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুককে দায়ী করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

অবৈধ অনুমোদনের সঙ্গে রাজউকের ১৩ জন কর্মকর্তাসহ অগ্নিকাণ্ড ও জানমালের ক্ষতির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তত ৬৭ জন দায়ী বলে শনাক্ত করা হয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়