ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সম্ভাবনাময় উপকূল

শৈবাল চাষে লাভবান হবে বহু চাষী

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শৈবাল চাষে লাভবান হবে বহু চাষী



বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জলরাশিতে ব্যাপকভাবে শৈবাল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে জন্মায় ২১৫ ধরনের শৈবাল এবং ম্যানগ্রোভ এলাকায় জন্মায় ১০ প্রজাতির শৈবাল। অতি সহজ পদ্ধতিতে শৈবাল চাষে বেশি লাভবান হতে পারেন চাষীরা, গবেষণায় এমন প্রমাণ মিলেছে। শুধু গবেষণায়ই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ২০১০ সালে দেশে প্রথমবারের মত শৈবাল চাষ শুরু হয়। এখন সামুদ্রিক শৈবাল চাষ লাভজনক করতে প্রয়োজন যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

সূত্র বলছে, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের চারদিকেই প্রাকৃতিকভাবে জন্মে নানারকম শৈবাল। স্থানীয় লোকজনের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, দ্বীপের সৃষ্টি লগ্ন থেকেই বিভিন্ন প্রজাতির শৈবাল জন্মাতো। এগুলোর স্থানীয় নাম ‘হেজেলা’ ও ‘পাথরের ফুল’। সামুদ্রিক শৈবাল বা সবজি সাগরের তলদেশীয় ‘সমাঙ্গবর্গীয়’ অফুলেল উদ্ভিদ। বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক শৈবাল গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। বৈদেশিক বাজারে এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞানী প্রয়াত প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাফর দেশে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই মূল্যবান শৈবাল চাষের প্রযুক্তি প্রথম আবিষ্কার করেন। কক্সবাজার অঞ্চল থেকে প্রথমবারের মত বাণিজ্যিকভিত্তিতে এটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সস অ্যান্ড ফিশারিজ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের যৌথ অর্থায়নে শৈবাল উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল ২০১০ সালে। এতে স্থানীয় দরিদ্র জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা হয় এবং ও চাষী-বান্ধব কলাকৌশল উদ্ভাবন করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শৈবাল চাষের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শৈবালের উৎপাদন বৃদ্ধির কলাকৌশল শেখানো হয়। একইসঙ্গে শৈবাল ও শৈবালজাত পণ্যসামগ্রী তৈরি ও বাজারজাতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাদের আয় বেড়েছে।

 



ডিএফআইডি’র আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সস অ্যান্ড ফিশারিজের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় জলরাশিতে শীত মৌসুমে শৈবাল চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির শৈবাল চাষ করা হচ্ছে। উদ্যোগ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক প্রজাতির শৈবাল চাষ করা সম্ভব হবে। পরীক্ষামূলকভাবে শৈবাল চাষের ফলাফলে প্রমাণিত হয়েছে, জোয়ার-ভাটার অন্তর্বতী স্থানে, উপকূলীয় প্যারাবনে এবং উন্মুক্ত সাগরের বিশাল  জলরাশিতে শৈবাল সবচেয়ে ভালো জন্মায়। সরকারি অনাবাদি খাস জলাভূমিতে অনায়াসে সামুদ্রিক শৈবাল বা সবজির চাষ করা যেতে পারে। দৈনন্দিন গৃহস্থালীর সহজলভ্য উপকরণ দড়ি, রশি, জাল, পুরাতন কাপড়, বাঁশ, প্লাস্টিকের বয়া ইত্যাদি ব্যবহার করে অত্যন্ত সহজে ও কম পরিশ্রমে শৈবাল চাষ করা যায়।

গবেষকেরা বলেছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহারে শৈবাল চাষ করতে পারলে বাংলাদেশের বিশাল ও বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অগভীর ও গভীর অঞ্চল শৈবাল চাষের আওতায় আসবে। ফলে মৎস্য সম্পদ আহরণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টির যোগান বাড়বে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের স্থানীয় দরিদ্র জনগণ বিগত কয়েকদশক যাবৎ প্রাকৃতিক উৎস হতে শৈবাল কুড়িয়ে শুকানোর পর মিয়ানমারে রপ্তানি করে আসছেন এবং অবিক্রিত শৈবাল জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করছেন। শুধু প্রাকৃতিক উৎস হতে শৈবাল সংগ্রহ না করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অতি সহজেই শৈবালের উৎপাদন বাড়ানো যায় বলে প্রমাণিত হয়েছে গবেষণায়। জানা গেছে, উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র ও অতি দরিদ্র জেলে সম্প্রদায় এবং ভূমিহীন জনগোষ্ঠী উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শৈবাল চাষ ও ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী হতে পারেন। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও একাজে অংশ নিতে পারেন। বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার বিশাল উপকূলীয় এলাকার লোকজন এই প্রযুক্তি গ্রহণ করে শৈবাল উৎপাদন ও বিপণনের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে পরিক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় কিছু ব্যক্তি শৈবাল চাষের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সব প্রজাতির শৈবালের মধ্যে জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার যোগ্য গুণ রয়েছে। কোন প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালই এখন আর ফেলনা নয়। বৈদেশিক বাজারে চাহিদা থাকায় এটি এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে শৈবাল ও শৈবালজাত পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামুদ্রিক শৈবাল বহু বছর আগে থেকেই মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চীন, জাপান, কোরিয়া, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দেশগুলোতেও সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে বলে তথ্যসূত্রে জানা গেছে।

গবেষকরা বলেছেন, সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের উপাদেয় খাবার হিসেবে ব্যহৃত হচ্ছে। এটি পশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া  হাঁস-মুরগির খাদ্য, মাছের খাদ্য, জৈব সার, জৈব জ্বালানী, কসমেটিক্স সামগ্রীতে সামুদ্রিক শৈবাল কাজে লাগে। শৈবালের ভালো খাদ্যমান ও ওষুধি গুণ থাকায় দেশেও এর খাদ্যাভাস গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত গবেষকদের। গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, সামুদ্রিক শৈবাল মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ, শারীরিক ও মানসিক সুষম বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। দেশের মানুষের মাঝে সামুদ্রিক শৈবাল বা শৈবালজাত খাদ্যসামগ্রী ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুললে পুষ্টিহীনতা ও কঠিন রোগ-ব্যাধি হতে রক্ষা পেতে পাবে। শৈবাল পানির দূষণমাত্রা এবং পানির তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ফলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদির প্রভাব থেকে অনেকটা মুক্তি দেয়। জীববৈচিত্র্য বিস্তার ও সংরক্ষণে শৈবাল প্রধান ভূমিকা পালন করে।

জানা যায়, বিদেশে সামুদ্রিক শৈবালের বাৎসরিক উৎপাদন প্রায় ১০ মিলিয়ন টন, যার আর্থিক মূল্য ১২ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বে একুয়াকালচার উৎপাদনে শৈবালের অবস্থান দ্বিতীয়। শৈবাল একটি সম্ভাবনাময় জলজ উদ্ভিদ, যার পুষ্টিমান অন্যান্য জলজ প্রজাতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উপকূলীয় জলরাশিতে ব্যাপকভাবে শৈবাল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চাষের কাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণে চাষীদের স্বল্প বিনিয়োগ প্রয়োজন। সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে শৈবাল চাষ করা সম্ভব বলে চাষীরা সহজেই এই চাষ শুরু করতে পারেন। ভুমিহীন চাষীগণ সরকারি খাস অনাবাদি জলাভুমিতে বিনা বাধায় শৈবাল চাষ করতে পারেন। গবেষকদের মতে, চাষকৃত শৈবালের ওষুধি গুণ থাকায় দেশেও এর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। শৈবালে ওষুধি গুণ থাকায় সবজি হিসেবে এই শৈবাল খাবার তালিকায় রাখলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ টিউমার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি রোগ থেকে রক্ষা পাবে।

 



এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শৈবাল বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় জনগণ ‘হাইপেনা’ শৈবাল কুড়িয়ে তা শুকিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে এবং কিছু শৈবাল সার হিসাবে ব্যবহার করে। প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রচুর শৈবাল জম্মাচ্ছে। কিন্তু সেখানে পর্যটকদের অবাধে চলাফেরা, নৌ চলাচল, পাথর আহরণ ইত্যাদি কারণে শৈবালের উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক উৎস ছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে শৈবাল উৎপাদন ও শৈবাল চাষে আগ্রহী কৃষকদের পাশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা দরকার। কক্সবাজারের টেকনাফের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শৈবাল চাষী আমিরুল ইসলাম বলেন, শৈবাল চাষ খুবই সহজ। সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে যে কেউ শৈবাল চাল করে লাভবান হতে পারেন। কিন্তু অনেকে প্রশিক্ষণ পেলেও শৈবাল চাষের সুযোগ পান না। 

সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্টের কর্মকর্তা মো. শফিউদ্দিন বলেন, উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার প্রায় সাড়ে ৩ কোটি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই জলজ সম্পদ ও মৎস আহরণের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের এলাকাসহ বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের আয়তন প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা দেশের ভৌগলিক আয়তনের (১৪৪,০০০ বর্গকিমি) চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের উপকূলে ৫০ মিটার গভীরতার মহীসোপান অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৩৭ হাজার বর্গকিমি। সামুদ্রিক মৎস ও জলজ সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশের এই বিশাল সমুদ্র জলসীমা অত্যন্ত উর্বর। এই বিশাল সামুদ্রিক সম্পদ নবায়নযোগ্য। বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে নির্দিষ্ট মাত্রায় অনন্তকাল পর্যন্ত এই সম্পদ আহরণ করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের জলজ সম্পদ (যেমন, শৈবাল) চাষের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শৈবাল চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও বিস্তারের মাধ্যমে উপকূলীয় অগভীর জলাশয় চাষের আওতায় আসবে এবং জলজ সম্পদের উৎপাদন বাড়বে। ফলে উপকূলীয় দরিদ্র লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে। শৈবাল চাষের আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ অনুসরণ করে রপ্তানিতে নতুন পণ্য যোগ করতে পারবে বাংলাদেশ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়