ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শ্রমিকদের কর্মঘণ্টার দাবি এখনো অধরা

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ৩০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রমিকদের কর্মঘণ্টার দাবি এখনো অধরা

ছবি: শাহীন ভুঁইয়া

হাসান মাহামুদ : বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ১৩২ বছর ধরে পালিত হচ্ছে মে দিবস। কিন্তু শ্রমিকদের মূল দাবি ‘আট ঘণ্টা’ কর্মসময় এখনো বিশ্বের অনেক দেশেই অধরা।

শ্রমিকের শ্রমঘণ্টা নিয়ে আজও কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা হয়নি। শ্রমের সময়সূচি নিয়ে এখনো যথাযথ নিয়ম মানা হয় না। আজও শ্রমিক নির্যাতিত হয়। শ্রম আইনের বাইরে রয়ে গেছে এখনো প্রায় ৫ কোটি শ্রমিক। এর মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সংখ্যা জানার এখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিসংখ্যানই প্রকাশ হয়নি দেশে। ফলে এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনার অধিকাংশ কর্মস্থলে শ্রমিক দিবসের মূল দাবিই মানা হয় না।

ইতিমধ্যে দেশে শ্রম আইন যুগোপযোগী করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো দেশের অধিকাংশ শ্রমিক এসব আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নিয়েই এখনো দেশের আইন এবং নীতিমালা আবর্তিত হচ্ছে। অথচ দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক লাখ। এছাড়া নারীর গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি এবং হিসাব এখনো সব ধরনের পরিকল্পনার বাইরে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকসহ ৫ কোটি ৪০ লাখ ৮৪ হাজার লোক বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। সংস্থাটির হিসাব মতে, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছে ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার, যারা মূলত সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়মিত শ্রম দিয়ে থাকেন। এসবের মধ্যে রয়েছেন পাট, টেক্সটাইল, চিনি, কাগজ, গার্মেন্টস, হালকা যান, পরিবহন, ট্যানারি, চা ও নৌযান শ্রমিক।

তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনেক বেশি। মূলত শ্রমের ৮৭.৫ ভাগই নিয়োজিত রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, এ খাতে ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত। তারা মূলত গৃহশ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, হকার প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত। এ বিশাল শ্রমিকের নেই কোনো স্বীকৃতি। নেই কোনো আলাদা পরিচয়পত্র। এদের দিনে প্রায় ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করতে হয়। কারণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিংবা বেরসকারিভাবে পরিচালিত হয় বলে, এরা সরকারি নিয়মের বাইরেই কাজ পরিচালনা করে আসছে। যার বলি হচ্ছে নিরীহ শ্রমিকরা। অথচ তাদের ঘামে সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা।

পরিবহন খাত, নিরাপত্তাকর্মী, হোটেল ও রেস্তোরাঁসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যেকোনো কাজেও শ্রমিকদের আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়। এমনকি মিডিয়াতেও সরাসরি কাজের ক্ষেত্রে বেশি কর্মঘণ্টার বিষয়টি সম্পর্কে সবাই জানে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শ্রম আইনে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবস নির্ধারিত থাকলেও তার বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয় প্রায় ৯৮ শতাংশ নিরাপত্তাকর্মী, হোটেল বা রেঁস্তোরা ও পরিবহন শ্রমিকদের।

তথ্য অনুযায়ী, পরিবহন খাতে ১০০ শতাংশ শ্রমিককে দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয় এবং নিরাপত্তাকর্মীদের ৮০ শতাংশ শ্রমিককে দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করতে হয়। এসব শ্রমিক সাপ্তাহিক ছুটি থেকেও বঞ্চিত হন। নিরাপত্তাকর্মীদের ৬৬ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না, ৮৮ ভাগ মে দিবসে ও ৮৬ ভাগ সরকারি ছুটির দিনও কাজ করতে হয়। হোটেল শ্রমিকদের ৮৬ শতাংশ সাপ্তাহিক ছুটি, ৮২ শতাংশ সরকারি ছুটি ও ৮২ শতাংশ মে দিবসের ছুটিতেও কাজ করেন। রি-রোলিং শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাদের কাজ করতে হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসেও। হাসপাতালের শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ সরকারি ছুটিতেও কাজ করেন, সাপ্তাহিক ছুটি নেই ২২ শতাংশের।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রমঘন পরিবেশের কারণেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যাদের কল্যাণে পোশাক খাত আজ সারা বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে গিয়েছে তারা হলো এ সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক। যাদের ৯৫ ভাগই নারী। এ দেশের পোশাকের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও শ্রমিকদের অবস্থার কোনো বদল হয়নি। শুধু তৈরি পোশাক খাত নয়, চামড়া, চাসহ অন্যান্য খাত দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পের নাম চা শিল্প। এ সেক্টরেও দেশের দেড় লাখ শ্রমিক অবদান রাখছেন। তাঁত শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন ৫০ লাখ শ্রমিক। বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়াও তুলা উৎপাদন, সুতা উৎপাদন, প্রিন্টিং ও ডাইং মিলে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। চামড়া শিল্পের শ্রমিকরা এ শিল্পকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন।

মাছ উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের কল্যাণে দেশের মাছ উৎপাদন বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। কৃষি শ্রমিকের অবদানে বিশ্বের ধান উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। অথচ তাদের পেশার নেই কোনো স্বীকৃতি। দেশে এখন একজন নারী কৃষি শ্রমিকের যেমন কোনো স্বীকৃতি নেই, তেমনি কৃষি শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মতো পরিচয়পত্রও নেই। এমনকি জীবন, স্বাস্থ্য, অক্ষমতা, মাতৃত্ব সংবলিত সামাজিক নিরাপত্তা সুযোগ এবং বৃদ্ধ বয়সের ভাতার সুযোগ নিশ্চিতকরণের কোনো নীতি বা কৃষি শ্রমিক কল্যাণ তহবিল বা জাতীয় বোর্ড গঠন এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আজও উঠেনি।

সার্বিক বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, শ্রম খাতে এখন বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক শিল্পসহ বেশ কয়েকটি খাতে আমাদের অবস্থান ঈর্ষণীয়। যদিও এসব ক্ষেত্রে মালিকদের যে হারে উন্নতি শ্রমিকদের সে হারে উন্নতি হয়নি। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি খাতসংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

তবে শ্রমশক্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অর্জনও কম নয়। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কল্যাণে আজ তৈরি পোশাক শিল্প পরিপক্বতা অর্জন করেছে। এ শিল্প আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে শিশুশ্রম বন্ধ, ন্যূনতম মজুরি দেওয়া, ক্রেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজের পরিবেশ উন্নত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি কারখানায় সিবিএসহ ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয় আছে।

এ রকম বাস্তবতায় ১ মে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা সারা বিশ্বে মে দিবস হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন। অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।

এবারের মে দিবস উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পালনের জন্য নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও দিনটি পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারিভাবেও দেশে এ দিবস পালনের জন্য কর্মসূচি রয়েছে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ এপ্রিল ২০১৮/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়