ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আধুনিক কাস্টম হাউসের উদাহরণ বেনাপোল

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৭, ১০ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আধুনিক কাস্টম হাউসের উদাহরণ বেনাপোল

এম এ রহমান: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাস্টম হাউস বেনাপোল চেক পয়েন্ট। ১৯৫৭ সালে চেকপোস্ট চালুর পর বেনাপোল পূর্ণাঙ্গ কাস্টম হাউস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ‌্যিক লেনদেন হয় এবং ১০ হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে।

কাস্টম হাউসটি ক্রমেই আধুনিক হাউসে রূপান্তর হচ্ছে। বর্তমান কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজস্ব ফাঁকি রোধ, শুল্কায়ন ও আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় এসেছে ব‌্যাপক পরিবর্তন। এই কাস্টম হাউসকে আনা হয়েছে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশনের আওতায়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর চালু করা হয়েছে বাইপাস সড়কসহ বেশ কিছু নতুন স্থাপনা।

বেনাপোল কাস্টম হাউসকে আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার স্বীকৃতি হিসেবে মিলেছে ‘বিজনেস এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৯।’ বিশ্বব‌্যাংক সম্প্রতি বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরীকে দেশ সেরা ‘কাস্টমস কমিশনার’ হিসেবে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।

এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি চাই ব‌্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া আরো সহজ ও গতিশীল হোক। আমি এখানে যোগদান করার পর থেকেই এ উদ্দেশ‌্যে কাজ করে যাচ্ছি। বন্দর উন্নয়নে বেনাপাস সফটওয়‌্যার, আমদানি-রপ্তানিতে নতুন গেট স্থাপন, রাস্তার উন্নয়ন, উন্নত বন্দর ব‌্যবস্থাপনা, আধুনিক কেমিক‌্যাল ল‌্যাবরেটরিসহ বেশ কিছু বিষয় সংযোজন হয়েছে। এর ফলে পণ‌্য আমদানি-রপ্তানি অনেক গতিশীল হয়েছে। আগে আমদানিকৃত পণ‌্য ছাড় করতে ১০ থেকে ১৫ দিন লেগে যেতো, এখন তা ১ ঘন্টায় নেমে এসেছে।’

বেনাপোল কাস্টম হাউসের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ‌্যে রয়েছে-
চেকপোস্ট
: বেনাপোল কাস্টম হাউসের নিরাপত্তা জোরদারে স্ক‌্যানিং মেশিনের পাশাপাশি অত‌্যাধুনিক মেটাল ডিটেকটর ও সিসি ক‌্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ট্র্যাভেল ট‌্যাক্স সহজীকরণের জন‌্য সোনালি ব‌্যাংক বুথ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যাত্রী হয়রানি বন্ধে চেকপোস্টে বহিরাগত প্রবেশ রোধে কার্যকর ব‌্যবস্থা ও যাত্রীদের জন‌্য ১০০ ট্রলি সরবরাহ করা হয়েছে। যেখানে নিবিড় তদারকির জন‌্য একজন ডেপুটি কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

 



কার্গো শাখা:
সংস্কারের মাধ‌্যমে আমদানি পণ‌্যের সুষ্ঠু ব‌্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে উদ‌্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩৬ ধরণের রপ্তানি পণ‌্য দ্রুত প্রেরণে দুটি লিংক রোড চালু করা হয়েছে। কার্গো সংস্কারের আগে ভারত একটি পথ বন্ধ রাখতো। লিংক রোড চালু করায় পণ‌্যজট ও আমদানি-রপ্তানি ব‌্যয় কমেছে অনেকখানি।

বেনাপাস সফটওয়‌‌্যার চালু: কার্গো শাখার আরেকটি সাফ‌ল‌্য বেনাপাস সফটওয়‌্যার চালু। এর মাধ‌্যমে ভারতীয় আমদানি পণ‌্যবাহী গাড়ির তথ‌্য ডিজিটালি ধারণ করা হয়। প্রতিটি গাড়ি এন্ট্রিতে খরচের পাশাপাশি সময় আট ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

শুল্কায়ন: শুল্কায়ন কার্যক্রম সঠিক ও দ্রুত করার জন‌্য একাধিক সংস্কার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। শুল্কায়ন দ্রুত করতে ফোল্ডার পদ্ধতি চালু করার ফলে একটি ফাইল নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় সময় ৩ দিনে থেকে তিন ঘন্টায় এসেছে। শুল্কায়ন গ্রুপ সংখ্যা ৫টি থেকে ৯টি বৃদ্ধি করা হয়েছে। শুল্কায়ন, মূল‌্যায়ন ও অডিটের ওপর নিয়মিত ইনহাউস প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।

আধুনিক ল‌্যাব: দেশের নিরাপত্তায় ও অবৈধ রাসায়নিক পণ‌্য চোরাচালান প্রতিরোধে চলতি বছরের জানুয়ারিতে কাস্টম হাউসে যুক্ত হয়েছে অত‌্যাধুনিক কেমিক্যাল ল‌্যাবরেটরি। আগে ছিল নামমাত্র যন্ত্রপাতি। আগে রাসায়নিক দ্রব‌্য পরীক্ষা করতে যেখানে ৭ থেকে ১৫ দিন লাগতো, সেখানে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনের ফলে তা ঘণ্টায় নেমে এসেছে। বর্তমান কমিশনারের উদ‌্যোগে ল‌্যাবরেটরিতে যুক্ত হয়েছে ১৮ ধরণের নতুন যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতির মধ‌্যে রয়েছে     এইচপিএলসি (হাই পারফরম্যান্স তরল ক্রোমাটোগ্রাফি), এফটিআইআর (ফোরিয়ার ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড স্পিকারস অনুলিপি), মাইক্রোস্কোপ, ফ্ল্যাশ পয়েন্ট যন্ত্রপাতি, ওয়েল কনটেন্ট এনালাইজার, মিল্টিং পয়েন্ট যন্ত্র, কেজিডাহাল ফ্লাস্ক সেট, সুতা গণনা যন্ত্র, পলারি মিটার, ডেনসিটি মিটার, পিএইচ মিটার, কলারি মিটার, ভিসকো মিটার, হিটিং মিটার, ওয়াটার ডিসটিলাইমেন সেট, হট প্লেট, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, হাজমাট আইডি এলিট এবং রোমান স্পেকট্রমিটার।

এ বিষয়ে কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘বেনাপোল কাস্টম হাউজে আধুনিক রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন হওয়ায় মিথ‌্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি কমে যাবে। কেমিক্যালের সঙ্গে কোনো ক্ষতিকর বা বিস্ফোরক জাতীয় পণ্য এলে তা পরীক্ষায় ধরা পড়ে যাবে। এর ফলে সৎ ব্যবসায়ীরা হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন।

 



ঝুঁকি ব‌্যবস্থাপনা:
ঝুঁকি ব‌্যবস্থাপনায় গোয়েন্দা ও নিবারক তৎপরতায়  ইনভেস্টিগেশন রিচার্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করা হয়েছে। এনবিআর প্রদত্ত গাইডলাইনের আলোকে আইআরএম দলের প্রোফাইলিং ও নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। জট কমাতে বন্দরে পণ‌্যবাহী গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন‌্য গেট সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধে রাত্রিকালীন পেট্রোল টিম এবং বিশেষ ক‌্যাশ ক্লিয়ারেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া জেলার ম‌্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে ডিসি কাস্টমসের নেতৃত্বে বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র‌্যাবের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

তথ‌্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি: তথ‌্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উন্নয়নের অংশ হিসেবে স্টাফদের ডাটাবেজ তৈরির পশাপাশি হাজিরা নিশ্চিত করা হয়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধে অত‌্যাধুনিক সিসি ক‌্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধিতে ভাইবার গ্রুপ খোলা হয়েছে, যেখানে সম্পৃক্ত আছেন ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারি।

বন্দরে নতুন ৭৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ: আমদানিকৃত গাড়িসহ বিভিন্ন পণ‌্য রাখার সুব‌্যবস্থা করতে বর্তমান কমিশনারের উদ‌্যোগে স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ ৭৫ বিঘা বা ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। ফলে মাল খালাসের আগে বিভিন্ন গাড়ি ও পণ‌্য বন্দরে রাখার অধিক সুবিধা পেয়েছেন আমদানিকারকরা। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি বেনাপোল বন্দর দিয়ে তাদের আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে।

বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বন্দরটি দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ১২ লাখ ৭১ হাজার ২৪ টন। ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বেড়ে যথাক্রমে ১৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪২, ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৮৭৫, ১৫ লাখ ১৯ হাজার ২২০ ও ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৯৭ টনে দাঁড়িয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ মে ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়