ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সিপিবির সমাবেশে হামলা : সাক্ষী-আসামির গরহাজিরে থমকে আছে বিচার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ২০ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিপিবির সমাবেশে হামলা : সাক্ষী-আসামির গরহাজিরে থমকে আছে বিচার

মামুন খান : ১৮ বছর পার হলেও সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা মামলার কার্যক্রম থমকে আছে সাক্ষী ও আসামিদের গরহাজিরে। পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন ঘটনায় হতাহতের স্বজনেরা।

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে দুর্বৃত্তরা বোমা হামলা করে। হামলায় পাঁচজন নিহত ও ২০ জন আহত হয়। ওই ঘটনার ১৮ বছর পার হলেও  মামলার বিচারকাজে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মামলা দুটি বর্তমানে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।

মামলা সম্পর্কে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দীর্ঘদিনেও ওই হামলার বিচার না হওয়া খুবই দুঃখজনক। মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো দলই চায় না যে বামপন্থীদের ওপর ওই হামলার সুবিচার হোক। বিএনপির সময়ে এ মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরে আন্দোলনের মুখে মামলার তদন্ত শুরু করতে বাধ্য করানো হয়। আর হামলার পরবর্তী সময়ে পার্টির পক্ষ থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছেও কিছু আলামত আমরা উপস্থাপন করেছিলাম। তবে তাতেও তেমন কাজ হয়নি। ভোটের রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে না বলেই এ মামলাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বামপন্থীদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে এ দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান। প্রথমে যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে, এরপর রাজধানীর পল্টনে আমাদের (সিপিবি) সমাবেশে, এরপর রমনা বটমূলে বর্ষবরণে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, পরবর্তী সময়ে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশেও গ্রেনেড হামলা হয়। আর এরপর থেকে জঙ্গি হামলা ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। ওই সময় কঠোর হাতে জঙ্গি দমন করলে আজ জঙ্গিবাদের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুল্লাহ আবু বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলাটি নিয়ে আসলেই আমরা বিব্রত। বার বার চেষ্টা করেও সাক্ষীদের আদালতে আনা যাচ্ছে না। সাক্ষীরা আদালতে হাজির না হওয়ায় মামলার বিচারকাজ শেষ হচ্ছে না। পুলিশও তাদের সাধ্য অনুসারে চেষ্টা করছে। তবে ঘটনার দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া কষ্ট। সাক্ষীদের প্রতি সমন ও অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম দ্রুত করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, পুলিশ আর রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় সময়মতো আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পারছে না । আর তাদের ব্যর্থতার কারণেই মামলার বিচার কাজে বিলম্ব হচ্ছে। গত দুই বছরে একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এর আগে কিছু সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তবে অধিকাংশই এখনও বাকী রয়েছে।

এ মামলায় অনেক সাক্ষীই সাজানো-বানোয়াট দাবি করে তিনি বলেন, ঘটনার সময় যেসব সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা কেউই এর স্বপক্ষে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট আদালতে দেখাতে পারেননি। এগুলো সব দলীয় সাক্ষী।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন কোন সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। আর আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করেনি পুলিশ। এজন্য আদালত আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন। আর আসামিদের আদালতে হাজির করতে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেছেন আদালত। আর সাক্ষীদের প্রতি সমন ও অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, মামলার আসামিদের মধ্যে মুফতি মাঈন উদ্দিন শেখকে সবচেয়ে বেশি বার আদালতে হাজির করা হয়নি। গত ধার্য তারিখে মাঈন উদ্দিনের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানায়, সিলেটের কোতয়ালী থানার একটি মামলায় মাঈন উদ্দিন আসামি। আর ওই মামলার প্রয়োজনে তিনি সিলেটের কারাগারে আছেন। এজন্য তাকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না।

এদিকে সাক্ষীদের বিষয়ে দেখা যায়, মামলাতে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর  বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এবং ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন সভাপতি রুহিন হোসেন প্রিন্স সাক্ষ্য দেন। এরপর আর কোন সাক্ষ্য হয়নি। এর প্রায় দুই বছর পর ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ তিনজনের হাজিরা আদালতে দাখিল করে। কিন্তু ওইদিন আসামিদের আদালতে হাজির না করায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মামলার কিছুটা গতি ফিরেছিল। এরপর  প্রায় আড়াই বছর ধরে মূলত সাক্ষী এবং আসামিদের গরহাজিরে মামলার বিচারকাজ এগোয়নি। এমতাবস্থায় মামলার বিচার কি হবে তা নিয়ে সন্দিহান ভূক্তভোগীরা।

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবির সমাবেশে দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায়  পাঁচজন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়। ওই ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আসামিদের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি মর্মে তদন্ত শেষে  আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল। এরপর ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের আগস্টে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা হয়। এসব ঘটনায় জঙ্গিরা জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়ার পর ২০০৫ সালে মামলাটি আবার পুনঃতদন্তের আদেশ দেওয়া হয়। মামলাটি পুনঃতদন্তের পর ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর মৃনাল কান্তি সাহা । এর পরের বছর ২১  আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত ।

মামলা দুটিতে মোট ১০৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এদের মধ্যে হত্যা মামলায় ২৮ জনের ও বিস্ফোরক মামলায় ৩২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।

মামলার আসামিরা হলেন- মুফতি আব্দুল হান্নান, মুফতি মাঈন উদ্দিন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মো. মশিউর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুত্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিরাজ ও নুর ইসলাম।

আসামিদের মধ্যে জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের অন্য একটি মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আসামিদের মধ্যে  শওকত ওসমান, সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ও মাইনউদ্দিন কারাগারে আছেন। অপর আসামিরা পলাতক রয়েছেন।

ওই হামলায় খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মণ্ডল, খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আব্দুল মজিদ, ঢাকার ডেমরা থানার লতিফ বাওয়ানি জুটমিলের শ্রমিক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের মুক্তার হোসেন, খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিপ্রদাস মারা যান।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জানুয়ারি ২০১৯/মামুন খান/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়