ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাহিত্যের বাতিঘর এখন...

আবদুল মান্নান পলাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৭, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাহিত্যের বাতিঘর এখন...

বাঁ থেকে- আশুতোষ চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরী, প্রিয়ম্বদা দেবী ও জয়ন্তনাথ চৌধুরী

আবদুল মান্নান পলাশ, চাটমোহর : বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক প্রমথ চৌধুরীর ঈশ্বরী পাটনী গল্পে উল্লেখ করা মন্ত্রশক্তির টেরাকোটা বসানো মন্দিরের কাঠামোয় বটপাকুড় মাথা তুলেছে। খসে পড়ছে ইট, সুরকি, টেরাকোটা। হুতুমপেঁচা আর চামচিকে বাসা বেঁধেছে মন্দিরের খাঁজে-ভাঁজে।

 

এক সময়ের প্রতাপশালী জ্ঞানগৌরবে উজ্জ্বল জমিদারবাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক মন্দিরটির এমনই দশা। একটু দূরে শান বাঁধানো পুকুরঘাট। পুকুরের স্ফটিক জলের ভেতরে বিলুপ্ত জৌলুসের বৃত্তান্ত জানতে হাতছানি দিচ্ছে ইতিহাস।

 

বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসের ‘বাতিঘর’ চৌধুরী বাড়ির ভিটার মূল আঙ্গিনায় এখন ঘুঘু না চড়লেও কথিত ভূমিহীনদের  সারিসারি ঘর গৃহস্থালি দেখে চেনার উপায় নেই যে, এখানে একদা এক জমিদারবাড়ি ছিল। আর ওই জমিদার পরিবারটি ছিল বাংলা সাহিত্যের ‘বাতিঘর’।

 

পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদর থেকে পাকা সড়কে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরের গ্রামটির নাম চৌধুরীপাড়া। সম্প্রতি এক সকালে উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের গ্রামটিতে গিয়ে এ চিত্র চোখে পড়ে।

 

বাংলা সাহিত্যে চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক, বীরবল খ্যাত রায়াতের কথা, বীরবলের হালখাতা, চার-ইয়ারী কথা, আহুতি, নীললোহিত, পদচারণ, নানাচর্চা, প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমান, তেল নুন লাড়কির লেখক প্রমথ চৌধুরীর পৈতৃক ভিটা। শুধু তাই নয়, বাংলা কাব্যে প্রথম সনেট রচয়িতা প্রসন্নময়ী দেবী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠবন্ধু ও ভাতিজী জামাই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সাহিত্যিক স্যার আশুতোষ চৌধুরীর পৈতৃক ভিটাও এটি।

 

প্রমথ চৌধুরী তার আত্মকথায় লিখে গেছেন- ‘আমি ছেলেবেলায় কৃষ্ণনগরেই বাস করতুম বছরের সাড়ে এগার মাস, আর হরিপুরে পনের দিন। কিন্তু বাবার বাড়ি হরিপুরটা আমি সঙ্গে এনেছিলুম।’ যদিও তিনি মামাবাড়ি যশোরে জন্মেছিলেন।

 

প্রমথ চৌধুরীর বাবা ছিলেন দূর্গাদাস চৌধুরী। ছিলেন কৃষ্ণনগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তার বাবা ছিলেন কালীকান্ত চৌধুরী। নাটোর রাজার দেওয়ান। তিনি সোনাবাজু পরগনার সিকি অংশ কিনে জমিদার হয়েছিলেন। তার বংশধর হরিমৈত্রের নামানুসারে গ্রামের নাম হরিপুর রাখা হয়। মতান্তরে চৌধুরীরা হরিসংকীর্তন করতেন বলে গ্রামের নাম হরিপুর হয়েছে। প্রমথ চৌধুরীর মায়ের নাম মগ্নাময়ী দেবী। তার ৭ ছেলে, ২ মেয়ে। প্রমথ চৌধুরীর ভাইবোন সবাই উচ্চশিক্ষিত। মহারানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রত্নগর্ভা’ উপাধিতে সন্মানিত করে স্বর্ণপদক প্রদান করেছিলেন।

 

 

বড়দা আশুতোষ চৌধুরী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। অন্যরা হলেন, কুমুদনাথ চৌধুরী, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, মন্মথনাথ চৌধুরী, সুহৃদনাথ চৌধুরী ও অমিয়নাথ চৌধুরী। এদের মধ্যে  সুহৃদনাথ চৌধুরী ও অমিয়নাথ চৌধুরী বিলেতফেরত ডাক্তার ছিলেন। অন্য ভাইয়েরা ছিলেন ব্যারিস্টার। কুমুদনাথ চৌধুরী বিখ্যাত শিকারী ছিলেন। তিনি সুন্দরবনে শিকারে গিয়ে মারা যান।

 

সবার বড়বোন কবি প্রসন্নময়ী দেবী ও মৃণালিনী দেবী বিলেতফেরত উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। চৌধুরী পরিবারের প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত গেলে স্থানীয় হিন্দু নেতৃবর্গ তাদের সমাজচ্যুত করেছিল। আর অমিয়নাথ চৌধুরীর ছেলে প্রমথ চৌধুরীর ভাতিজা জয়ন্তনাথ চৌধুরী (জেএন চৌধুরী) ভারতের সেনাধ্যক্ষ হয়েছিলেন।

 

প্রমথনাথ চৌধুরী (আসল নাম) ও স্যার আশুতোষ চৌধুরী জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জামাই ছিলেন। প্রমথ চৌধুরী ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করেন। তিনি বিলেত থেকে ‘বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে কিছুদিন আইনব্যবসা করেন। বিশ্বভারতী ও সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তাঁর চিত্রবৃত্তির বাহুল্যবর্জিত আভিজাত্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে।’ প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।

 

কবি প্রসন্নময়ী দেবী :
বাংলা সাহিত্যে প্রথম সনেট রচয়িতা প্রসন্নময়ী দেবী ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্বামীর নাম কৃষ্ণকুমার বাগচী। প্রমথ চৌধুরীর বড়বোন এবং কবি প্রিয়ম্বদা দেবী।
 

মাত্র বারো বছর বয়সে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আধ-আধ-ভাষিণী’। ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী প্রসন্নময়ী কিশোরকালেই লিখেছিলেন ‘হবে নাকি এই দেশে ব্রাহ্মধর্মাচার’। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘বনলতা’, ‘নীহারিকা’ উল্লেখযোগ্য। সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস ‘অশোক’ তাঁর বিশিষ্ট রচনা। ২৫ নভেম্বর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

স্যার আশুতোষ চৌধুরী :
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দূর্গাদাস চৌধুরীর দ্বিতীয়পুত্র বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। সাহিত্যিক, বঙ্গীয় বিধানসভা ও কংগ্রসের অন্যতম সদস্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাতিজী জামাই ও বন্ধুস্থানীয় আর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সহপাঠী ছিলেন স্যার আশুতোষ চৌধুরী। পরে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছেন। পাবনার বাগ গ্রামের মাতুলালয়ে ১৮৬০ সালের ১৩ জুন, ৩০ জ্যৈষ্ঠ রোববার জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

 

আশুতোষ চৌধুরী প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ ও এমএ পাশ করেন। ১৮৮৪ সালে কেমব্রিজের সেন্ট জনস কলেজ থেকে গণিত শাস্ত্রে বিএ এবং ১৮৮৫ সালে ব্যবসা শাস্ত্রে ট্রাইবাস পাশ করেন। ১৮৮৬ সালে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। বেঙ্গল হোল্ডার্স আ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি।

 

১৯০৪ সালে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯০৮ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সভার অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। আর ১৯২০ সালে তিনি বঙ্গীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর এই ধীমান পুরুষ ১৯২২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯৩১ সালে লাভ করেন`নাইট` উপাধি। ১৯৩৪ সালের ২৩ মে তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

 

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে স্মৃতিকথায় লিখেছেন- দ্বিতীয়বার বিলেত যাইবার জন্য যখন যাত্রা করি তখন আশুর সঙ্গে জাহাজে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পাস করিয়া কেম্ব্রিজে ডিগ্রি লইয়া ব্যারিস্টার হইতে চলিতেছেন। কলিকাতা হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত কেবল কয়টা দিন মাত্র আমরা জাহাজে একত্র ছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, পরিচয়ের গভীরতা দিন সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। একটি সহজ সহৃদয়তার দ্বারা অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি এমন করিয়া আমার চিত্ত অধিকার করিয়া লইলেন যে, পূর্বে তাঁহার সঙ্গে যে চেনাশোনা ছিল না সেই ফাঁকটা এই কয়দিনের মধ্যেই যেন আগাগোড়া ভরিয়া গেল। আশু বিলেত হইতে ফিরিয়া আসিলে তাঁহার সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার সম্বন্ধ স্থাপিত হইল।’

 

দূর্গাদাস চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলটি এখন নানা অবহেলা আর উদাসীনতার মধ্যেও মাথা উঁচিয়ে দূর্গাদাস হাইস্কুল এন্ড কলেজে উন্নীত হয়েছে। দূর্গাদাসের একটি পাথরের আবক্ষ মূর্তি স্কুলের কক্ষে অযত্নে নষ্ট হচ্ছে। যতদূর জানা গেছে, ৪৭ সালের পরে চৌধুরীদের সম্পত্তি ভুয়া নিলাম ডাকের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে পাবনার ওষুধ কোম্পানি এড্রুক এর মালিক আব্দুল হামিদ রাতারতি মালিক বনে যান।

 

আব্দুল হামিদ চৌধুরী বাড়ির দালান-কোটা ভেঙ্গে ইট-কাঠ-লোহা সব পাবনা নিয়ে যান। চৌধুরী বংশের কেউ এখন এখানে নেই। নিকট প্রতিবেশী প্রয়াত অধ্যাপক কল্যাণ চৌধুরীর বাড়ির কেয়ারটেকার বিশ্বনাথ সরকার (৬৫) বলেন, ‘আমি চৌধুরী বাবুদের বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে যেতে দেখেছি।’

 

পাশের মৈত্রপাড়ার শতবর্ষের বৃদ্ধ সুধীর দাস বলেন, ‘আমি শিকারী কুমুদনাথ চৌধুরীকে দেখেছি। বড়দিনের ছুটিতে কৃষ্ণনগর থেকে আসতেন শিকার করতে।’ তার ছেলে রতন দাস বলেন, ‘আশির দশকে দূর্গাদাস চৌধুরীর নাতি জয়ন্তনাথ চৌধুরীর ছেলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সন্দীপ চৌধুরী সরকারি সফরে বাংলাদেশে এসে হরিপুর দাদুর ভিটে দেখতে এসেছিলেন।’

 

স্থানীয় ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জমিদার দূর্গাদাস চৌধুরীর বসতবাড়িতে তিন দাগে ৩ টি ভিটে রয়েছে। একটি ১ একর ১০ শতাংশ, একটি ১৯ শতাংশ এবং একটি ২৭ শতাংশ আয়তনের। হরিপুর ভূমি অফিসের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি এখানে বেশি কিছু জানি না। তবে সেখানে এখন ১৪টি পরিবার বসবাস করছে। তাদের নামে একসনা লিজ দেওয়া হয়েছে।’

 

ওই তহশিল অফিসের সাবেক ভূমি কর্মকর্তা (বর্তমানে পৌর ভূমি অফিসে কর্মরত) বিপুল চন্দ্র জোয়াদ্দার জানান, চৌধুরী বাড়ির সকল সম্পত্তি এখন সরকারের অর্পিত সম্পত্তির ১ নং তালিকাভুক্ত (আরএস রেকর্ডভুক্ত)। অবৈধ নিলাম ক্রেতার দাবিদার পাবনার এড্রুক কোম্পানির মালিক সরকারের সঙ্গে মামলায় হেরে গেছেন। প্রথমে নিম্ন আদালতে তার মিস-ওসি (অঃপঃ) মামলা করা হয়। সেটিতে হেরে গেলে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করেন। তবে সেটিও নামঞ্জুর হয়।

 

তিনি বলেন, ‘৩ বছর আগে সেখানে ১৪টি ভুয়া ভূমিহীন পরিবার দখল করে বসতি গড়ে তোলে। পরে তাদের নামে একসনা লিজ দেওয়া হয়। একজন লিজের শর্ত ভেঙে পাকাঘর করেছে।

 

ভূমিহীন দাবিদার সেখানে বসবাস করা ছানোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমরা প্রকৃত ভূমিহীন। সরকারের পক্ষে আমরাই মামলায় লড়েছি। তাই এখানে বাড়ি করিছি। একজন আছে সে ভূমিহীন নয়।’

 

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মিজানূর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে প্রমথ চৌধুরীর বসতবাড়ি সংরক্ষণ করা সহজ নয়। এখানে যারা ওই সম্পত্তি ও স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় কাজ করছে তারা আবেদন করলে আমরা তাদের নামে লিজ প্রদান করতে পারব।’


 

রাইজিংবিডি/চাটমোহর/৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫/পলাশ/সনি/রহমান

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়