ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দুপুরে চরকায় || এনামুল রেজা

এনামুল রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২০, ২১ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুপুরে চরকায় || এনামুল রেজা

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার



মতিনের বয়স চল্লিশ, মাথায় বিশাল টাক এবং সে অকারণ সুঠামদেহি; প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিটায় নিত্য আওন্তি-যাওন্তি, খাওয়া-ঘুম-হাগা-মোতা এবং স্ত্রীর সাথে প্রচুর সঙ্গম- এছাড়া অন্য কোনো কাজ সে করে না যার কারণে তার দেহ সুঠাম হতে পারে। এখন সে যায় সকালের বাজার করতে, হাতে ঝোলে ফাঁকা চটের ব্যাগ। বাজার সেরে অফিস- এরকম এক রুটিন গত দশ বছরে তৈরি হয়েছে। লোকটির জীবনে কোনো বৈচিত্র নেই- স্রষ্টা এমন এক দীর্ঘ জনপদ যে সৃষ্টি করেছেন, অনুমান হয় এসমস্ত রুটিনমাফিক ও নিজেদের ক্লান্তিনামা সম্পর্কে অজ্ঞাত লোকগুলোকে তিনি ভালোবাসেন। স্রষ্টার ভালোবাসা পকেটে নিয়ে মতিন মুসলিম বাজারে প্রবেশ করে; গতকাল বেতন হয়েছে, কাঁচা টাকা হাতে এলে মানুষের চেহারায় একটা চকচকে আভা তো চলে আসে, নাকি?

মাছের বাজারে ঢুকে খানিকটা দিশেহারা বোধ নিয়ে সে হাঁটে। প্রচণ্ড ভিড়, প্রচণ্ড দাম, অসহ্য এক শোরগোল ভনভনে চারপাশ যদিও এ হৈ চৈ মতিনের কাছে নেশার মতো ঠেকে- একসকাল বাজারে না আসতে পারলে সারাদিন মনে হয় কিছু একটা করা হলো না, দিনটা ফাঁকা রয়ে গেল একটু কেমন। দাম নিয়েও খুব একটা দরবারের মানুষ সে না, তবে সুরমাই মাছের দাম শুনে সে বিরক্ত হয়। মাসখানেক আগে যে মাছ শ’দুয়েকে কিনেছে, এর মাঝে কী এমন হয়ে গেল যে তিনশ টাকা কেজি? মাছঅলা পাশের নালায় কপ করে থুতু ফেলে হাসে- এই মাচ তো মামা কিচুদিন বাদে আর পাইবেন না। ছৌদি চইল্লা যাইবোগা হবডি।

বিরক্তি নিয়েই মতিন পা চালায়, নাকে ধাক্কা মারে নিকটস্থ মুরগি বাজারের দুর্গন্ধ, মাছের দামের চে’ হয়তো ওই দুর্গন্ধ তীব্রতা পায় মগজে। ভিড় ঠেলে সে এগুতে থাকে খানিক সামনে যেখানে পাঙাশ মাছ নিয়ে বসেছে একজন।

কেজি কত?

একশ পঞ্চাশ।

একশ কইরা রাখো?

এক দাম ছার, দরাদরি নাই।

মাছ কি বাটা কোম্পানির নাকি? একশ বিশে দাও।


কথাবার্তার এ পর্যায়ে মাছঅলার আগ্রহ হারায় সে, লোকটা অন্য কাস্টমারের দিকে তাকায় কিংবা অন্যকোনো দিকে চেয়ে উদাস হয়ে যায় যেন মাছগুলো বিক্রি করতে এসেছে শখে! তার আগ্রহ ফিরে পেতে চেঁচায় মতিন- উঠাও মিয়া, ওই মাঝারি সাইজেরটা ওজন করো।

আষাঢ়ের প্রচণ্ড রোদসী বেলা। মানুষ ঘামে এবং বিরক্ত হয়- চারদিকে চায় বিরক্তি নিয়ে। ভিড়ুয়া মশগুলে বাজার থেকে বেরিয়ে পয়লাবারের মতো তার মনে হয়, কেউ পিছু নিয়েছে; তাকে অনুসরণ করছে নিকট দুরত্ব বজায় রেখে। যখন বাজারে ঢুকেছে তখনও খটকাটা ছিল, যখন এদিকে সেদিকে ঘুরে সে এক ব্যাগ সবজি, দুই কেজি আলু, আড়াই কেজি ওজনের পাঙাশ মাছটা কিনেছে তখনও মনে হয়েছে কেউ আসছে পিছু পিছু- কে? বাজার থেকে মহল্লার দিকে গড়ানো এবড়ো-থেবড়ো পিচঢালা রাস্তা, ওর মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, দু’একটা রিকশা পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বেল বাজায়, আঁখ ছোট করে দেখে আরোহী ও চালকেরা। মতিন আলী মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন ঘামতে থাকে? পিছু নিয়েছে, নির্ঘাত তার পিছু নিয়েছে কেউ- এই ভেবে? মনে হয়, এমুহূর্তেই ফিরে তাকানো উচিত, নইলে জানা যাবে না আসলেই কেউ তার পিছু নিল কিনা, আবার মুহূর্তে কোনো শীতল ভয়ে শরীর দ্রুত পিচ্ছিল হয় ঘামে- সত্যি যদি কেউ তার পিছু নেয় তবে করণীয় কী?

আরে মতিন ভাই, কী হইছে?


খেয়াল ভেঙে সে চমকে তাকায়, রুখসানা দাঁড়িয়ে আছে- রুখসানা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়, তাদের বিল্ডিঙে চারতলার ফ্ল্যাটে থাকে স্বামী-সন্তান নিয়ে। অন্য কোনো সময় হলে নিয়মমাফিক এই প্রতিবেশিনী ও ভারি নিতম্বের মহিলাটিকে দেখে সঙ্গমেচ্ছা জাগতো মতিনের, মনে হতো কোনো এক সন্ধ্যায় সিঁড়ি ঘরের অন্ধকারে তাকে চেপে ধরে একেবারে পিছন দিক থেকে... অথচ এ মুহূর্তে নিজেকে চুপসে যাওয়া বেলুন মনে হয়, বিব্রত কণ্ঠে সে হাসে- আরে ভাবি? কই যান?

যাই তো ইস্কুলে। আপনি এইরকম দাঁড়ায় আছেন বাজারের ব্যাগ হাতে, শরীল খারাপ করলো?

নাহ, না তো। রশীদ ভাইয়ের খবর ভালো? উনি যাইবেন না ইস্কুলে?

তিনি ইস্কুলে কেন যাইবেন? মতিন ভাই, আপনের হইছে কী? রিকশা ডাইকা দেই একটা?

প্রশ্নের জবাব না দিয়েই মতিন হাঁটতে শুরু করে। তার হয়েছে কী? রুখসানার স্বামী লোকটা কোনো এক বায়িং হাউজে খাটে- আর সে বলে দিলো লোকটা স্কুলে যাবে, ছিঃ ছিঃ না জানি ওই ভয়ানক নিতম্বের নারীটি তাকে কেমন বেকুব ভেবে নিয়েছে; সম্ভাব্য যৌন সম্ভোগের অকাল মরণশঙ্কায় মতিন কাঁপে, আবার ভাবে এখন কি সে একবার ফিরে তাকাবে? তার ঘাড়ের পিছনে একজোড়া চোখ আছে, সেই চোখেরা কটকট করে ওঠে, ঘাড়ের পিছনের সেই অদৃশ্য চোখেরা টাটায়, মাথার ভিতরে কেউ ঘা মারে, আসছে কেউ তার পিছে। অশুভ কিছু, মন্দ কিছু- ঠিক যেমন একটা দুর্দান্ত সবুজ লনের সাদা বাড়ির উপর ছায়া বিস্তার করে পাশে গজিয়ে ওঠা কোনো ভঙ্গুর উঁচু-দালান। মতিন জোরে পা চালায়, মোড় পার হবার সময় কুমিল্লা জেনারেল স্টোরের মালিক তার দোকানের শাটার উঠাতে উঠাতে দেখে সরকারি আমলা মতিন আলী কেমন কুঁজো হয়ে হাঁটছে, ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে কিছু অথচ ঘাড়ে যেন তালা মারা তাই পিছনে ঘুরানো যাচ্ছে না। মতিন এলাকার সবচে’ অবস্থাপন্ন লোকগুলোর একজন- জেনারেল স্টোরের মালিক দৃশ্যটি দেখে বেশ কৌতুক বোধ করে, গলা খাকাড়ি দিয়ে প্রশ্ন ভাসায় বাতাসে- সার, কী অইছে আপনের? অসুক করলো নিকি?


মতিনের আদতেই বেশ অসুস্থ লাগে, এত ঘাম সচরাচর তার গা থেকে তো বেরোয় না, বাড়িতে এসি, অফিসে এসি, সারাদিনে একমাত্র এই বাজার করতে আসা-যাওয়াটা পায়ে হেঁটে করে নইলে তার কালো রঙের মিতসুবিশি ল্যান্সারটাও তো এসি- ঘামার সুযোগ কোথায়? হঠাৎ মনে হয়, রোজ এত সময় তো লাগে না বাসায় ফিরতে, আজ এখনও কেন তাদের সাদাকালো ছ’তলা দালানটা দেখা যাচ্ছে না? পথ হারিয়ে ফেলেছে নাকি, পিছে পিছে যে আসছে তার অলৌকিক কোনো ইশারায় ভুলপথে হনহন হেঁটে চললো? এমন সময় প্যান্টের পকেটে সেলফোনটা বাজে।

হ্যালো?

শুভ’র আব্বা, কই তুমি? এত দেরি হইতেসে কেন ফিরতে?

হ্যাঁ?

হ্যাঁ মানে কী? জলদি বাসায় আসো। শুভ’রে স্কুলে নামায় দিতে হবে না? তোমার কাণ্ডজ্ঞান হবে না কখনও?

স্ত্রীর চেঁচামেচি আর প্রশ্নবাণে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ওঠে সে। তাই তো, বাসায় ফিরতে হবে দ্রুত, আজ অফিসেও জরুরি মিটিং আছে এগারোটার দিকে। ফোনের ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠটি শুনতে পাওয়া যায় ফের-  শুভ’র আব্বা, কথা বলতেসো না কেন? আশ্চর্য্য!

কই, বলতাসি তো। আইতাসি, এই চইলা আসছি।

তোমার গলা এমন শুনায় কেন? কী হইছে?

কিছু হয় নাই। আমি আইতাসি।


বাজারের ব্যাগ হাতে মতিন হাঁটতে থাকে, তার মনে অনুসরণকারীর কালো আশঙ্কা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়- রোদ্রজ্বলা শহুরে আবাসিক এলাকার পথ চোখের সামনে বদলে যেন হয়ে দাঁড়ায় একটা উঠোন, নিকটেই একতলা টিনশেড পাকা বাড়ি, মতিন চিনতে পারে যে ছ’তলা বিল্ডিং হবার আগে তাদের বসত-ভিটে এমনি দেখতে ছিল। বারান্দার ইজিচেয়ারে সে তার বাপ মঈন আলীকেও দেখতে পায়: বৃদ্ধ ও দু’চোখ অন্ধ, পায়ের কাছে একদল অচেনা লোক বসে আছে। মঈন আলী তাদের বলেন, লাস্ট শো সিনেমা দেখে খুলনা টাউন থেকে বোগদিয়া ফিরবার গল্পটি, তার কণ্ঠস্বরে মগ্নতা। হাওয়া বইতে থাকে, মেঘ ডাকে গড়র গড়। তিনি হাত নাড়েন, হাওয়ায় তার থুতনির একগুচ্ছ দাড়ি নাচানাচি করে। সিনেমার নাম রহিম-রুব্বান, সুজাতা নায়িকা। হল থেকে বেরিয়েছেন যখন রাত ন’টা বেজেছে, রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা, খালিশপুর যেতে কোনো রিকশাঅলাই রাজি হয় না, সুতরাং দু’জন বন্ধু সমেত মঈন ঠিক করেন হেঁটে হেঁটে ফেরা যাক, কত সময় আর লাগবে? আড়াই-তিন ঘণ্টা বড়জোর, পাশাপাশি শহরের রাতও দেখা হয়ে যাবে। তিনজনে ডাকবাংলোর মোড় থেকে তিনটা ক্যাপস্টান কেনেন এবং আগুন ধরান, হালকা শীতে অনুভব করেন খুলনা শহর আসলে তো এক স্বর্গ, যদিও পরনের লুঙ্গির ফাঁক গলে তাদের অন্ডকোষ শীতল করে যায় কনকনে ডিসেম্বুরে বাতাস। দু’জনে গায়ের জাম্পারটিতে হাত গুটিয়ে নেন আরও, মঈন আলী তার চাদর একবার ঝেড়ে আবার গতরে পেঁচান শক্ত করে- তাদের আঙুলে ধরা জ্বলন্ত সিগারেটগুলো বহাল থাকে অতি আপন সঙ্গীর মতো, যার সঙ্গ ক্ষীয়মান কিন্তু বলশালী। খুলনা-যশোর মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে তারা হাঁটেন, এমন বিচিত্র নির্জনতা চারদিকে, দু’বন্ধুর একজন নিজাম কাশেন, কাশতে কাশতে বলেন, শাউয়ো মেলাক্ষণ হয়ে গেল না মঈন? এতক্ষণে তো খিয়াঘাটে চইলে আসবার কথা, আসতিসে না কেন বুজদিসি না।

মুজগুন্নি ঢুইকে পড়লাম নাকি?

না তা কেন? সুজা রাস্তা। এ কথা বলে মাথা চুলকান তৃতীয়জন ফরিদ, রাস্তার ধারে বসে পড়েন পেশাব করতে, পাতলা ঘাস ভেদ করে উষ্ণ জলের তোড় মাটিতে বুজবুজে আওয়াজ তোলে। ঠিক তখন প্রাণীটিকে দেখা যায়, একটা কালো কুকুর, ভ্রু-দুটো শাদা; তাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদ আলোয় চোখ জ্বলজ্বল করে জন্তুটির।

জ্বিন নাকি?

হতি পারে। নিজাম কণ্ঠে ভয় নিয়ে আবার কাশেন, ফরিদ, পিশাব-মিশাব জলদি শেষ কর বুদা। জ্বিন-ভুতি এই মাঝরাত্তিরে ঘিরে ধরলি তো বিপদ!

তারা দ্রুত পা চালান- এতক্ষণ ধরে হাঁটছেন, খেয়াঘাট তবু আসে না কেন? আবাসিক এলাকার রাস্তা নিয়ে ছিলেন শর্টকাট ধরবার জন্য, এখন এভাবে চক্কর মারতে হবে এ মাথা ও মাথা কে জানতো? পথ খুঁজে পাবার আশায় তারা হয়রান হয়ে চার রাস্তার একটা মোড়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন, খেয়াল করেন কালোরঙা ও সাদা ভ্রু’অলা কুকুরটাও একটু দুরুত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মঈন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, এ পিছে পিছে আসতিসে নাকি নিজাম? তারা তিনজন রাস্তার মোড়ে বসে পড়েন, ফাঁকা মোড়, নিকটে শুধু ওই কালো কুকুর- চারদিক শুনশান, যেন এ এলাকায় শুধু একতলা কিংবা দোতলা বাড়িগুলোই আছে ঠায় দাঁড়িয়ে আশেপাশে, ভিতরে কেউ বসবাস করে না।

ফরিদ জানান, আমরা পথ হারায়ে ফেলিসি, এইরোম হাঁটতি থাকলি তো হবে না, হিসাব কইরে হাঁটতি হবে।

নিজাম বলেন, এইগুলো সব জ্বিনের কাজ কারবার, আমাইগে নিয়ে খেলতিসে রাত-দুপুরি, কিলান্ত হইয়ে এইযে বইসে আছি, উরা মজা পাচ্ছে এহন, কিছুক্ষণবাদে এগোই আসবে আমাইগে ঘাড় ঠাইসে ধরবে মাটির পরে।

মঈন আলী বলেন, তালি একটাই উপাই আছে।


উপায়স্বরূপ তিনজন রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন, লুঙ্গির গিঁটে হাত রাখেন কেননা মঈন আলী বলতে থাকেন এইরকম পথ হারিয়ে যাবার ঘটনা অতীতে বহু লোকের সাথে ঘটতো, তখন চারদিকে বন-বাদাড় বেশি, মাটির পথঘাট আর মানুষের বসবাস ছিল কম, ভরদুপুর কিংবা এমন মাঝরাত, বেশিরভাগ সময় পৃথিবী হয়ে রইতো নিঝুম। গাঁয়ের মানুষেরা চলাচল করতো পায়ে হেঁটে, অনেক সময় বেলা বয়ে যেত, ফাঁকা কোনো বিল বা ময়দান পেরুতে তারা ক্লান্ত হয়ে উঠলে দেখতো বেলা গড়াচ্ছে কিন্তু গন্তব্য আসছে না, প্রমাণ হতো ভুল রাস্তায় হেঁটে আসা হয়েছে- ভুল পথে এসে রাত নামলেই তো বিপদ, শরীরের খোঁজে হন্য হয়ে ফিরতে থাকা দুরাত্মা গায়েবানাদের উৎসবে বেঘোরে প্রাণ চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি। তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বারো আউলিয়ার নাম নিত তারা, আল্লা-রসুলকে স্মরণ করত, তিনবার বলতে হতো- আউযুবিল্লা হিমিনাশশাই তানিররাজিম- এরপর পরনের লুঙ্গিটি খুলে উল্টে নিয়ে আবার বেঁধে নিত শক্ত করে। পথিকেরা বিশ্বাস করতো, যেসব বদনসিব জ্বিন তাদের এতক্ষণ পথ ভুলিয়ে ফিরছিল, ওগুলোর দৃষ্টি উল্টে গেছে- নিজেরাই পড়ে গেছে ধাঁধায়, কেননা ঠিকঠাক পথের সন্ধান মিলে যেত এরপর।

সরকারি আমলা মতিন আলী এরপর দৃশ্যটি দেখতে পায়: তার পিতা মঈন আলী, নিজাম এবং ফরিদ চাচা লুঙ্গি খুলছেন যেহেতু লুঙ্গি খুললে পথ খুঁজে পাওয়া যাবে, স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদ আলোয় সে দেখতে পায় তার পূর্বপুরুষ তিনজনার পুরুষাঙ্গ কুঁচকে এতোটুকুন হয়ে আছে শীতে। মুহূর্তেই সেসব ঢাকা পড়ে যায়, কারণ লুঙ্গি উল্টে নিয়ে আবার বেঁধে ফেলে তারা হাঁটতে শুরু করেন, নিশ্চয় এখন পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। দৃশ্যটি মিলিয়ে গেলে মতিন আবিষ্কার করে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, নিকটে দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো কুকুর। এর ভ্রু দুটিও সাদা। তাহলে কি আজ এই অতিচেনা শহরেই পথ হারিয়ে ফেলবে সে। লুঙ্গি তো পরনে নেই, প্যান্ট খুলে ফেললে কাজ হবে? মতিন টের পায়, পিছনের সেই অদৃশ্য অনুসরণকারী যেন খুব কাছে চলে এসেছে। সে হাঁটতে শুরু করে কিন্তু পিছনে ফিরে তাকাবার সাহস হয় না, প্রচণ্ড আতঙ্কে বুক শুকিয়ে আসে, মনে হয় অনুসরণকারী ভয়টির অলৌকিক ইশারা এগিয়ে আসছে তার জীবন তছনছ করতে, তখন পকেটের ফোনটা বেজে ওঠে পুনরায়।


হ্যালো, শুভ’র আব্বু কোথায় তুমি?

আমি রাস্তায়, আরেকটু।

কই আছো আমারে বলো, তোমার বাসায় আসতে হবে না, যেখানো আছো ওইখানে দাঁড়ায় থাকো, আমি গাড়ি পাঠাইতেসি।

আরে মানে কী? আইতাসি তো।

আইতাসি মানে? সেই কখন বের হইসো বাসা থেইকা জানো? তুমি কি আমার সাথে মজা করতেসো শুভ’র আব্বু? কী হইসে তোমার?

স্ত্রীর কাঁদোকাঁদো কণ্ঠস্বরে বেদনাবোধ হয় মতিনের। এ রমণীটিকে বিয়ে করেছিল সে দশ বছর আগে, তখন কেমন অল্পবয়সী মেয়েটাকে পারলে কোলে বসিয়ে রাখতে ইচ্ছে হতো দিনমান- বয়সের সাথে ওজনটা বেড়ে যাওয়ায় তাকে কোলে সে নিতে পারে না আজকাল, ইচ্ছেটাও আর জাগে না কেন? এ মুহূর্তে ফোন কানে রেখে মতিন দিগম্বর অবস্থায় তার বউকে দেখতে পায়, দৃশ্যটি সহজে মিলায় না: দিগম্বর ও স্থুল রমণীটি সেল ফোন কানে ধরে কাঁদোকাঁদো স্বরে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে, চোখের জল কণ্ঠ গড়িয়ে এসে নামে তার ফ্যাকাশে ও বিশাল স্তনের উপর, ‘‘শুভ’র আব্বু, কই তুমি? বাসায় ফিরতে এত দেরি কেন হয়?” মুহূর্তে সেই দৃশ্য বদলে চলে আসে অফিসের মিটিংরুম, তারা মিটিঙের বদলে চা খান- সহকর্মী রমিজ আলম কোনো একটা রসিকতা করলে পুরো রুম সকলের হাসিতে গমগম করে। পাশ থেকে অন্য কেউ বলে, মতিন সাহেব, সরকারের তো পতন হচ্ছে শুনেছেন?

এত জলদি পড়ে যাবে? তিন মিনিটও তো হলো না!

তিন মিনিটের আগেই সরকারের পতন হবে, এর সম্ভাব্য আনন্দে মিটিং রুম আনন্দ-হল্লাতে থরথরায়। সুঠামদেহের অধিকারী মতিন তার প্রচুর সঙ্গমের স্মৃতি আক্রান্ত দেহ ও মগজ নিয়ে হাঁটে, সরকার পতন হলেই বা কী, নতুন সরকার এলেই বা কী- ওসবের চেয়ে বড় সংকটে এখন সে ডুবন্ত কারণ পিছে পিছে কেউ আসছে, ভয়ানক কেউ যার মুখোমুখি হবার সাহস সে রাখে না। তার ঘাড়ের কাছে অদৃশ্য চোখেরা টাটায়, কটকটায়- মতিন নিশ্চিত হয় পথ হারিয়েছে।

ঠিক বেলা দু’টোয় তাকে বাসার বদলে হাজির হতে দেখা যায় অফিসে: সে হেঁটে আসে পা টেনে, দারোয়ান তাকে চিনতে পারে কিন্তু ভিতরে ঢুকতে দেবে কিনা ভেবে পায় না- চেঁচামেচিতে বহু লোকজন জমা হয় মন্ত্রণালয়ের সদর দুয়ারে, দেখতে পায় সুঠামদেহী তরুণ আমলা মতিন আলী বাজারের ব্যাগ হাতে দণ্ডায়মান, কাঁধে ঝুলছে পরনের প্যান্ট, শার্টের নিচ দিয়ে উঁকি মারে তার সবুজ জাঙ্গিয়া। সকলের বিস্ময়াভুত দৃষ্টির সামনে খানিকটা গর্বিত ভঙ্গিতে সে কাশে, আসলে রাস্তা হারায়া ফেলায় অবস্থা এমন হইসে, আপনারা বিষয়টা তো জানেন যে মানুষ পথ ভুইলা গেলে পরনের কাপড় উল্টায়া নিতে হয়? এখন আমারে সাহায্য করেন, খুলবার পর প্যান্টটা আর পরতে পারতাসি না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়