ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কখনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি: ফারুক আহমেদ

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১০, ১৯ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কখনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি: ফারুক আহমেদ

১৯৭২ সাল থেকে আমি হুমায়ূন আহমেদকে চিনতাম। মোহাম্মদপুর থাকতো তার ছোট ভাই শাহীন (আহসান হাবীব)। সে আমার ক্লাসমেট। ওরা থাকতো মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে, আমি থাকতাম হুমায়ূন রোডে। তখন আমি ওদের বাসায় নিয়মিত যেতাম। তখন দেখেছি তাকে। যদিও খুব বেশি কথা বলতাম না, বড় ভাই হিসেবে সম্মান করতাম। দেখা হলে সালাম দিতাম- এ পর্যন্তই।

এর মধ্য হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশিত হলো। বেশ পরিচিতি পেয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু আমি তখনও জানতাম না বইগুলো তার লেখা। শাহীন আমাকে কখনও এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। এক সময় তিনি আমেরিকা চলে গেলেন। তারপর বড় একটা গ্যাপ তৈরি হয়।

পুনরায় যখন আমাদের দেখা হলো তখন ১৯৯০ সাল। এই দেখা হওয়াটি একেবারেই নতুন করে, নতুনভাবে। বিটিভি থেকে আমাকে রিয়াজ উদ্দীন বাদশা ডাকলেন নাটকে অভিনয়ের জন্য। ওই নাটকটি ছিল হুমায়ূন আহমেদের।

নাটকে আমাকে নেয়া হলো। সেদিন কিন্তু হুমায়ূন ভাই আমাকে দেখে চিনতে পারেননি। পারার কথাও নয়। আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি যে, আমি শাহীনের বন্ধু। তো সেই শুরু। এরপর আমি হুমায়ূন ভাইয়ের প্রায় আশি শতাংশ নাটকে অভিনয় করেছি।

এক অন্যরকম মানুষ ছিলেন তিনি। বেশীরভাগ সময় শিশুসুলভ আচরণ করতেন। সহজ করে নিতে বলতেন সব কিছু। তার অধিকাংশ নাটক মানুষকে হাসাতো। আর আমার ভূমিকা বরাবর হাসির। লোকে যাকে বলে কমেডি। হুমায়ূন ভাই নাটককে ‘কমেডি নাটক’ বলতে চাইতেন না। তিনি সব সময় বলতেন, নাটক তো নাটকই। এর আবার কমেডি আর সিরিয়াস কি? নাটকে জীবনের গল্প থাকে।

আরো বলতেন, কেউ যদি তোমার নাটক দেখে, তোমার অভিনয় দেখে হাসে তো হাসবে। তবে জোড় করে মানুষকে হাসাতে যেও না। মানুষকে হাসানোর দায়িত্ব তোমার না। তোমার দায়িত্ব অভিনয় ঠিকমতো করে যাওয়া। মানুষ যেখানে হাসার দরকার হাসবে, কাঁদার দরকার হলে কাঁদবে। এসব নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।

আবার যখন শট দিতাম। হয়তো দেখা গেল সংলাপ শুনে উপস্থিত সবাই হাসছে। হুমায়ূন ভাই সবার সাথে তাল মিলিয়ে কখনো শুটিংসেটে শব্দ করে হাসতেন না। দেখা যেত আমি শট দিচ্ছি হুমায়ূন ভাই সহকারী পরিচালককে শট শেষ করার দায়িত্ব দিয়ে একটু সরে যাচ্ছেন। আমি জানি না সরে গিয়ে তিনি হাসতেন কি না। এ নিয়ে কখনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি।

আবার এই মানুষটিই যখন জানতেন শুটিং ইউনিটের একজন লাইটম্যান অথবা অন্য যে কারও জন্মদিন, তখন আয়োজন করতেন। কাউকে পুরো বিষয় না জানিয়ে একজনকে দায়িত্ব দিতেন কেক নিয়ে আসার। কেক কাটা, গান-বাজনা হতো। সব কিছুতেই সাবলীলভাবে অংশ নিতাম। কিন্তু তার সামনে কখনো পান করিনি। এমনকি সিগারেটও না।

আমার ওপর অন্যরকম দাবি ছিল হুমায়ূন ভাইয়ের। হয়তো নাটকের শুটিং শুরু হবে সন্ধ্যায়, ছয়-সাতদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে; আমাকে দুপুরে জানাতেন।

এভাবে যখন যেখানে যেতে বলেছেন গিয়েছি। ওই সময় আমি যে অফিসে চাকরি করতাম তারাও আমাকে যেতে দিত। কালেভদ্রে বিপদেও পড়তাম। যদিও অন্য পরিচালকের সাথে খুব কম কাজ করতাম, তবে কাউকে কথা দিলে সিডিউল মিস করতাম না।

দেখা গেল আগে থেকে কাউকে সময় দিয়ে রেখেছি এমন সময় হুমায়ূন ভাই ফোন দিলেন। তখন বাধ্য হয়ে অফিস থেকে তাকে জানানো হতো, অফিসে কাজের খুব চাপ দু’তিন দিনের আগে ছুটি হবে না। বিষয়টি খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতেন কিন্তু অন্য পরিচালকের সাথে কাজ করে তাকে ‘না’ বলেছি- এতে খুব কষ্ট পেতেন। আমি কখনো না বলতেও চাইতাম না। যেহেতু তার শুটিং সিডিউল খুব বেশি আগে জানাতেন না, তাই মাঝেমধ্যে এ রকম সমস্যায় পড়তে হতো।

হুমায়ূন ভাইকে আমি ‘ভাই’ বলতাম। অন্যরা বলতো স্যার। ভাই বলার মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে ছিল শাহীন। তিনিও ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। একবার তিনি আমার নামে একটা বই উৎসর্গ করেছিলেন- নাম ‘লিলুয়া বাতাসে’। শুধু ভালোবাসতেন তা নয়, রাগও করতেন। কোনো কিছু পছন্দ না হলে গ্রহণ করতেন না।

‘বৃক্ষমানব’ নাটকের কথা বলি। এই নাটক দর্শক যেভাবে দেখেছে প্রথম নির্মাণকালে সেরকম ছিল না। আমার চরিত্রটি অন্য আরেকজন করেছিল। নাটকের এডিটিং হয়ে যাওয়ার পরে হুমায়ূন ভাইয়ের মনে হয়েছে কিছু হয়নি! ফলে নতুন করে শুটিং করেছিলেন। এমনই ছিলেন তিনি।

কোনো নাটকে সাউন্ড ভালো না এলে ডাবিং করতে হতো।

হুমায়ূন ভাইয়ের পরিচালিত শেষ সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। এখানে আমি অভিনয় করিনি। সিনেমার যখন ডাবিং চলছিল আমি ছিলাম নারায়ণগঞ্জ। ধ্বনিচিত্র থেকে আমাকে ফোন করে বলা হলো, তাড়াতাড়ি ঢাকা আসতে। আমি প্রশ্ন করলাম, কেন?

বললো হুমায়ূন স্যার আপনার জন্য বসে আছে। ডাবিং করতে হবে। আমি বললাম, আমি তো কোনো নাটক বা সিনেমা করিনি।

আমাকে জানানো হলো, স্যার আসতে বলেছেন আসতে হবে।

আমি চলে এলাম। মাসুদ আখন্দ যে চরিত্রটি রূপায়ন করেছে সেটির ডাবিং করলাম।

ডাবিং রুম থেকে যখন বের হয়েছি, হুমায়ূন ভাই আমাকে ডেকে বললেন, তুমি অভিনয় ছেড়ে দাও।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাশেই মেহের আফরোজ শাওন বসা ছিলেন। তিনি বললেন, কেন?

হুমায়ূন ভাই বললেন, যে এত ভালো ডাবিং পারে তার অতো কষ্ট করে অভিনয় করার দরকার কি?

অনুলিখন: স্বরলিপি




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়