ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সংখ্যা নিয়ে যত কুসংস্কার

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সংখ্যা নিয়ে যত কুসংস্কার

প্রতীকী ছবি

অহ নওরোজ : সংখ্যার ধারণা পাওয়ার পর থেকেই সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন শুভ-অশুভর ধারণায় সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিশ্বাসী। এখনো পর্যন্ত এই বিজ্ঞানের যুগেও সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মানুষ সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে আসতে পারেনি।

পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতাভেদে সংখ্যার উৎপত্তি এবং প্রকাশের ধরন ভিন্ন। যে কারণে দেশ ও জাতি ভেদে সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কারের ধরনও ভিন্ন। বিভিন্ন দেশে সংখ্যা নিয়ে এমন কিছু প্রধান কুসংস্কার এবং আমাদের জীবনে সংখ্যার প্রভাব নিয়ে এই ফিচার।

০ : সাধারণভাবেই অসীম জগতের সন্ধান আমরা পেয়েছি শুন্য আবিষ্কার হওয়ার পরে। মানব সভ্যতার সম্পূর্ণ অগ্রগতিও এই শুন্য আবিষ্কারের পর থেকেই। কিন্তু দেখা যায় আমাদের অঞ্চলে বেশ আগে থেকেই পূজা-পার্বণে একক অঙ্কে শুন্য আছে এমন কোনো চাঁদা ধার্য করা হয় না। যেমন ১০ বা ৫০ কিংবা ১০০, সম্ভব হলে এর সঙ্গে এক যোগ করা হয় নইলে এক কমিয়ে দেওয়া হয়। দৈনন্দিন জীবনেও কখনো যদি এমন হয় রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় চাল মেপে নেওয়ায় পাত্রের সব চাল শেষ তখন গৃহিণীকে দেখা যায় এক কিংবা দুমুঠো চাল পাত্রে ফিরিয়ে দিতে। অর্থাৎ শুন্য যেন অশুভ। শুন্যের সঙ্গে যোগসূত্র থাকাটাই যেন অন্যায়।

অনেক সময় দেখা যায় পরিক্ষার্থীকে ডিম, রসগোল্লা কিংবা গোলাকার খাদ্য দিতে বারণ করা হয়। কারণ অনেকে বিশ্বাস করেন গোলাকার অর্থাৎ শুন্যের মতো কিছু খেলে পরীক্ষায় শুন্য জুটতে পারে। গ্রামেগঞ্জে এখনো দেখা যায় কলসি নিয়ে জল আনতে গেলে কোনো কারণে জল না নিয়ে ফিরে এলে খালি কলসি ঘরে ঢোকায় না। এসব ঘটনাই শুন্য নিয়ে অশুভ কুসস্কার প্রমাণ করে।

তবে শুন্যকে শুভও মনে করে অনেকে। শূন্যকে ছোট বৃত্ত রূপে এঁকে বহু আদিবাসীসের নৃত্য করতে দেখা যায়। তামাং সমাজে ‘বাকপা’ কিংবা ‘ফিকিরি’ নাচে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে নৃত্য করতে দেখা যায়।

১ : শূন্যের মতো ‘১’ সংখ্যাও মানুষের মনে ভালো কিংবা মন্দ দুদিকেই জায়গা করে নিয়েছে। তাইতো ইংরেজিতে যেমন ‘One for sorrow/Two for Joy’’ প্রবাদটি প্রচলিত তেমনি বাংলাতেও বলতে শোনা যায় ‘এক ছেলের মা/ভয়ে কাঁপে গা’। আবার ১-কে নিয়ে শুভ কুসংস্কারও আছে। যেমন- ‘এক মানিকে সাত সাগর আলো’।

 

২ : অশুভর চেয়ে শুভ বিশ্বাসেই দুইয়ের পদচারণা যেন বেশি। কারণ ২-এর সঙ্গে ‘জোড়’ শব্দটি সম্পর্কিত। জীবজগতের বিকাশের মূলে এই ‘জোড়’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই হয়তো ২-কে এখনো পর্যন্ত মানুষ শুভ বলে বিশ্বাস করে। তবে ২-কে নিয়ে অশুভ বিশ্বাসও আছে। যেমন সাঁওতালরা গায়ে যে উল্কি আঁকে তার মধ্যে অনেক ফোঁটা থাকে যেগুলো বিভিন্ন বিষয়কে নির্দেশ করে। এর মধ্যে পাশাপাশি দুইটি ফোঁটা এঁকে মৃত্যুকে বোঝানো হয়।

৩ : আমাদের মানবজীবনের বিভিন্ন বিশ্বাসে ৩-এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তিন নিয়ে সংস্কার পৃথিবীর সবদেশেই বেশি। প্রবাদ, ধাঁধা কিংবা ধর্মীয় আচারেও ৩-এর অবস্থান সুদৃঢ়। ইংল্যান্ডের আদিবাসীদের ধারণা তিন অশুভ। যে কারণে তারা পরপর তিনবার আয়নায় মুখ দেখে না, দেয়াশলাইয়ের একই কাঠিতে তারা পরপর তিনজন সিগারেট ধরায় না।

তবে তিনকে অনেক স্থানে শুভও মনে করা হয়। যেমন- আসামের কাছাড় পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী ডিমাছা আদিবাসীরা মনে করে পুকুরে স্নানের সময় তিনবার ডুব দিলে সমস্ত অশুভ দূর হয়ে যায়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অশুভ শক্তিকে আটকাতে শিশুর পিতা তিনদিন বাড়ি থেকে কোথাও যায় না। মৃতদেহ সৎকারের সময় এরা শ্মশানের মাটিতে তিনটি কড়ি পোতে। এই তিনটি কড়ি পোতার অর্থ হল তাদের দেবতা ‘তুরুক রাজা’র কাছে ওই মৃতদেহকে সঁপে দেওয়া। এছাড়া মুসলিমদের ধর্মীয় আচারে তিনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়।

তিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও। হরিতকি-আমলকী-বয়ড়া মিলে ‘ত্রিফলা’। ঘৃত-মধু-চিনি সহযোগে হয় ‘ত্রিমধু’। রামায়ণেও দেখা যায় তিনের প্রভাব। পঞ্চবটী বনে রামকে লড়তে হয়েছিল তিনজন রাক্ষসের সঙ্গে- খর, দূষণ, ত্রিশিরা। হনুমান অশোকবনে সীতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন রাত্রি ‘তিন প্রহরে’। এছাড়া আমাদের সমাজে, প্রবাদে প্রচুর তিনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ‘একড়া খাবো, দুইড়া খাবো, তিনড়া খাবো না। তিনড়া খেলে দিদি কয়েছে, ছেলে হবে না।’

৫ : পাঁচ সংখ্যাটির ধারণা এসেছিল সম্ভবত হাতের পাঁচটি আঙুল থেকে। পঞ্চেন্দ্রিয়, পঞ্চগঙ্গা, পঞ্চপল্লব, পঞ্চায়েত, সাত-পাঁচ ভাবা ইত্যাদি কথাগুলো আমাদের মধ্যে পাঁচ সংখ্যার বিশ্বাসকে প্রমাণ করে।

৭ :  তিনের মতোই ৭-কে নিয়ে বিশ্বাসও আমাদের সমাজে প্রবল। রয়েছে প্রভাবও। আদিকাল থেকেই সাত শুভ বা পবিত্র সংখ্যা হিসেবে মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় দখল করে নিয়েছে। তবে এর পেছনে সাত সমুদ্র, সাত ঋষি, সাত তারার ভূমিকা থাকাও স্বাভাবিক। এছাড়া এক অঙ্কের সবচেয়ে বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যা হওয়ার জন্যও হয়তো সাতকে এতো গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা আমেরিকানরা এখনো বিশ্বাস করে যে সপ্তম সন্তান বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়। জিপসিদের ধারণা সপ্তম সন্তান জ্যোতিষ বিদ্যায় পারদর্শী হয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সাত দিন ধরে সপ্তাহ হিসেবে জীবনচক্র আবর্তিত হয়। বাইবেল এবং কোরআনেও সাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মেই ৭-কে শুভ রূপে দেখানো হয়েছে।

৯ : এক অঙ্কের শেষ সংখ্যা ‘৯’। তবে তিন এর বর্গ সংখ্যা হওয়ার কারণে বোধহয় মানুষের কাছে এর একটি গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ হিসেবে নবমী তিথি পর্যন্ত মহাসমারোহে নবরাত্রি পালন করতে দেখা যায়। এছাড়া নয়-ছয়, ন-কড়া, ইত্যাদি শব্দগুলো নয়ের প্রভাবকে প্রমাণ করে।

১০ : হিন্দুধর্মে ১০-এর প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। পরলৌকিক কাজকর্মে ব্রাহ্মণদের দশ দিনে ঘাটের কাজ হয়। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য মেয়েরা কন্যা সন্তান প্রসব করলে দশদিন আঁতুর ঘরে কাটায়। এদেশের অনেকেই এখনো মনে করে দশ মাসে দাঁত উঠলে শিশু নাকি শতায়ু হয়।

১৩ : ১৩-সংখ্যাটি সামনে আসলেই প্রথমে যে শব্দটি আমাদের মনে পড়ে তা হল ‘আনলাকি’। গোটা ইউরোপের লোকবিশ্বাস, পুরান কিংবা রুপকথা, সবখানেই ১৩কে মনে করা হয় অশুভ হিসেবে। অনেকে মনে করে বাইবেলে বর্ণিত ‘শেষ নৈশভোজ’ বা লাস্ট সাপার কাহিনি থেকে তের সংখ্যাটির সঙ্গে অশুভ বিশ্বাসের ধারণা শুরু হয়েছে। এরকম আরো একটি ভোজসভার কথা আছে নরওয়ের প্রাচীন রুপকথায়। দুঃখ ও কলহের দেবতা লকি আমন্ত্রিত না হয়ে দেবতা ভালহাল্লার ভোজসভায় ঢুকে পড়ার কারণে নাকি তার মৃত্যু হয়েছিল। এবং তিনি ছিলেন ভোজসভায় যোগদানকারী তেরতম ঈশ্বর।

গ্রিক পুরাণে তের সংখ্যাটিকে অশুভ বলার পেছনে রবার্ট গ্রেভস বলেছেন- যখন গ্রিসে প্রতি বছর শেষে রাজাকে বলি দেওয়ার রীতি চালু ছিল তখন বছর ছিল তেরো মাসে। এরপর বারো মাসে বছর আসার পর থেকে এ রীতি বন্ধ হয়ে যায়। ইজিপ্ট পুরাণেও তেরোর উল্লেখ আছে।

পুরাণে বর্ণিত দুই দেবতা হোরাস ও সেথের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর দিনটিতে যুদ্ধ হয়েছিল সে দিনটির নাম থাউড। পুরাণে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে পৃথিবী সৃষ্টির তের তম দিনে এই যুদ্ধ হয় বলে দুর্ভাগ্যের দিন হিসেবে তাকে থাউড বলা হয়। থাউড মানে তেরো।

তবে ইটালি এবং চীনে তেরোকে মনে করা হয় শুভ সংখ্যা হিসেবে।

আমাদের দেশে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’, ‘তিনগুন তেরো দোষ’ প্রভৃতি কথা থেকেও এই সংখ্যাটির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তেরো ছাড়াও ১৭, ৯৯, ১০১ সহ আরো বেশ কিছু সংখ্যা রয়েছে যেগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাসের চল লক্ষ্য করা যায়। আর এর ফলেই একসময় এসব সংখ্যা আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন আচারে প্রভাব বিস্তার করে। পুরাণে, ধর্মে, সাহিত্যে, গানে, প্রবাদে, ধাঁধায়, খেলায় সবখানেই এসব সংখ্যার এমন প্রভাব আমরা মেনেও নিই খুব সহজে।

তথ্য সূত্র- *বিজোড় সংখ্যার সংস্কার: সোমেন চৌধুরী। *তিনের ত্রিভুবন: হরিপদ ভৌমিক। *সংখ্যা এলো কেমন করে: কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়।*সংখ্যার মজা, মজার সংখ্যা: বসন্ত কুমার সামন্ত।*উইকিপিডিয়া।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়