ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শওকত ওসমানের অগ্রন্থিত গল্প

কাজী জাহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শওকত ওসমানের অগ্রন্থিত গল্প

নদীর পার থেকে ঘরে ফিরছিল কলিম নাগার্চি।

বর্ষার আকাশ মেঘে থমথম করছে। কিন্তু বৃষ্টি আসবে না এখন। মেঘের রঙে তার কোনো আভাস নেই। ধীর পদে হাঁটতে লাগল কলিম।

জমির উপর পানি জমেছে। ব্যাঙ ডাকছে দেদার মওজে। ফড়িঙের খোঁজে পাখির দল কিচির-মিচির শব্দের হাট বসিয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝলক আসছে অনেক দূর থেকে।

কলিমের ভারাক্রান্ত মন হঠাৎ হাল্কা হয়ে যায়। আনমনা গুনগুন শুরু করে দিয়েছিল সে। দূরাগত রাগিনীর নাগ-কন্যারা হেলেদুলে এঁকেবেঁকে ছুটে আসছে শীতল হাওয়ার সড়ক ধরে। তাল দিতে থাকে কলিম চুটকি বাজিয়ে। মধ্য-লয়ে কখন দ্রুত নিজের মনে শীষ দিতে থাকে কলিম।

ছায়া-ঢাকা পাড়ার পথ সম্মুখে। আবার সরু আল এগিয়ে গেছে। দুপাশে অনাবাদী ক্ষেতের প্রসার। এখানে ঝোঁপের পাশে উঠেছে কয়েক ঝাড় ঘন বাঁশ গাছ। ডগালির উপর বসে বসে দোয়েল পাখি শীষ দিচ্ছে।

কলিমের হঠাৎ খেয়াল হয়, আরো একজন শীষ দিচ্ছে তার সঙ্গে। হেসে উঠলো সে। তাল-রক্ষা বন্ধ থাকে না। আর বন্ধ থাকে না তার চলা। বাঁশ গাছের উপর রঙিন একদল মেঘ খুব পাক খাচ্ছে তুলির অসমান আঁচড়ের মত রং ইতঃক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ছে।

নাগার্চির বুক আনন্দে ভরে ওঠে। চোখ দূরে দূরে ভেসে যায়। সরু আল-পথের কথা তার মনে থাকে না। কানের পর্দায় সুরের আছাড়ি বিছাড়ি তাকে টেনে নিয়ে যায়। পদক্ষেপ তাই আরো দ্রুত; খেয়াল থাকে না। অথচ একটু এদিক-ওদিক হলে বর্ষার পানি টুম্বুর জমির নিচে পড়ে যেতে পারে সে। কিন্তু চেনা পথ পায়ের মিতালি ভোলে না।


সবুজ হয়ে গেছে চারিদিক নূতন বৃষ্টির স্পর্শে। সমস্ত পরিবেশ কলিমকে ডাকছে, কোথাও বেরিয়ে পড়ার ইশারায়। পাহাড়ি রাগের বাণী-নিক্কন কানের পাশে এসে ঘা দিয়ে ফেরে। চড়া সুর খাদে নেমে আসছে অথচ নর্তকীর হঠাৎ পা বদলানোর মতো চটুলতার ভঙ্গীটুকু মিটে যাচ্ছে না। গম্ভীর, তবু চঞ্চল, আবার হাউইয়ের মতো তারা গ্রামের দিকে সুরের লহরী দ্রুত-লয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে গেল মিহি, মিহিতম শব্দ-রেখায়, মনে হয়, মিলিয়ে যাচ্ছে না। গ্রীবা বাড়িয়ে দুই কানের সাহায্য করতে হয়, প্রত্যাশা মেটে না। ঝরা-পত্রের শব্দে ভীত হরিণ যেন শিকারীর মুখ দেখছে উৎকর্ণ দাঁড়িয়ে।

কলিমও দাঁড়িয়ে আছে উৎকর্ণ। পথের বিলুপ্তি ঘটে গেছে তার কাছে। অবেলার গ্রাম শুধু সুরের আধার ছড়িয়ে ছড়িয়ে আকাশের তলায় আঁচল লুটোচ্ছে কিশোরী বালিকার মতো।

কলিম কেন দাঁড়ায়? তার মন হালকা থাকার কথা নয় নাগার্চি হিসেবে গাঁয়ে-ভিনগাঁয়ে তার নাম আছে। বাঁশি, সানাই তার কাছে বুক নিংড়ে আবেদন জানাতে পারে। তুব অনড় তার দিন। আর আগেকার মতো পালাপার্বণ হয় না, সাধ খাওয়ানো নেই, আকিকা হয় না, হাতে খড়ি হয় না, অন্নপ্রাশন যেন উঠে গেছে। গুটিয়ে গেছে জীবিকার গ্রাম-জোড়া শীতল পাটি। 

নাগার্চি হাঁটছে। দুদিকে মাঠ। পহেলা বর্ষায় নূতন মেহনতে রূপ ফুটছে। চাষীরা লাঙ্গল-রত। ঝপ্ঝপ্ শব্দ হচ্ছে বলদের পা ফেলার। ছিটিয়ে পড়ছে ঘোলাটে পানি চারিদিকে। কোন চাষী মই দিচ্ছে ছিপছিপে পানির উপর। বলদের লেজ মলছে আর ‘হেট্-হেট্’ রব ছাড়ছে। স্নিগ্ধ পৃথিবী। মাটির সন্তানেরা তারই মদে চুমুক দিয়ে জোরে শোরে কাজে নেমেছে। মঠের কোলে কোলে ধানের চারা বীজ দোলা খাচ্ছে। ডানপিটে ছেলেরা ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে নদী-পুকুরে স্নান করে; এখানে শালিখ পাখির দল বৃষ্টির জলে গ্রীষ্মের রোয়াবের মোকাবিলা করছে পানি ছিটিয়ে।

কলিমের চোখে কিছু এড়ায় না। কিন্তু কোনো দৃশ্যের উপর তার মন স্থির নয়।  মাঠ-ঘাট তারই সঙ্গে হেঁটে চলছে। সকলে সঙ্গী। শুধু ভেসে যাওয়ার আনন্দই এখানে বড়, সঙ্গীদের দিকে তাকানো নিষ্প্রয়োজন।

মেঘের ডাক শোনা গেল দূর প্রান্তরে। অচেনা সাদা হাঁসের সারি মেঘের আঁধারে আঁধারে পাখনার দাঁড় বেঁধেছে। চিকচিক শব্দে ক্ষুদে পাখি ডাকছে মাকড়শার লোভে।

মেহনতের মহিমা নানা রূপে মাঠে-ঘাটে প্রতিভাত। কলিম ঝলকা হাওয়ায় জোরে নিঃশ্বাস টানে। পাঁজর ভরে উঠলো। আবার আসে ভূপালী রাগের দূতীবৃন্দ কঙ্কন প্রদর্শী কিষানীর মতো ঝরনা শিলায় লাফিয়ে লাফিয়ে নৃত্য ছন্দে বেহুঁশ। তাল দিতে দিতে ঝোকের মাথায় কলিমের বাবরী চুল দেখা যায়। গুণগুনানা আর থামে না।

আলের মাথা ভেঙ্গে গেছে। এক পাশ থেকে ঝরঝর শব্দে পানি নামছে। কলিম ছোট লাফ দিল মাত্র। সুরের খেই একটানা চলছে, সেখানে কোনো বিরতি নেই।

সুরের পর্দায় নাগার্চি দেখতে পায়: কত যুগের চেনা এক গ্রাম, আসরে সে সানাই বাজাচ্ছে। অতীতের টুকরো ভেসে ভেসে আসছে সুরের ভেলায় শাদীর মাহফিলে, মানুষের ভিড়, বাজনার খ্যাতি। কত কত দৃশ্য।

বেলা শেষের ধরিত্রী শুধু একটা সুরের জালে বাঁধা পড়ে গেছে। অসহ্য পুলকে কলিমের মনে হয়, এই পৃথিবীই বেহেশত, আর এমন সুন্দর দেশ নেই কোথাও!

তালের ঝোকে ঈষৎ কৃশ শরীর নাড়া খাচ্ছে। দোলা খাচ্ছে ঝাকরা চুল। নৈশ নির্জ্জনতার বুকে সঙ্গীহীন পাখির ডাক যেমন সমস্ত জনপদ শব্দের মোড়কে ঢেকে ফেলে, তেমনই আজকের রঙিন অবেলা তাকে ঘিরে রেখেছে।


সন্ধ্যা হতে আর সামান্য দেরী। মেঘলা মাথায় আকাশ ঈষৎ বিষাদাতুর। নিচে ছায়া পড়েছে ঐ মুখের। কিন্তু কিষাণের কর্ম ব্যস্ততায় পৃথিবী এই কালো রং অস্বীকার করছে। ভূপালীর হাস্যোজ্জ্বল সুর ছড়িয়ে আছে লাঙলের চকচকে ফলকে, কাস্তের দাঁতে, পিতল-বাঁধা নারিকেলী হুঁকায় আর মানুষের চঞ্চল দেহ-সৌষ্ঠবে।

অসমান এক জায়গায় লাফ দিতে গিয়ে একটু যতি কেটে গেল। ভূপালীর শেষ পর্দায় কখন ইমনের অলস করুণ মূর্চ্ছনা এলো, নাগার্চি খেয়াল করে না। সুরের দ্যোতনায় হাঁটতে থাকে সে। কল্পিত বাঁশি ঠোঁটে এসে চুমু আদায় করে নিচ্ছে অজানিতে। বাঁশি ধরার ভঙ্গীতেই হাঁটছে কলিম। এমন বে-খেয়াল।

দূরে এক বাঁধ-পথে রাখালেরা গরুর পাল নিয়ে গ্রামে ফিরছে। বাবলা গাছের কালো ডালপালা গোধূলির দিকে হাত বাড়িয়ে স্তব্ধ। গরুর পাল এক জায়গায় এসে থামল। এখন শুধু তাদের লেজ আর পা দেখা যায়। নিচের দিকে মুখ। লেজ তুলে আবার একটু দূরে মাথা ভাসিয়ে দিল প্রথমে। কলিমের মনে হয় নিমেষ-মাত্র, এইখানে সরু খাদ পার হচ্ছে রাখাল আর গরু।

পশ্চিমে নীল মেঘের ফাঁকে অজস্র লাল ফুটকী দাগ। এখনও সূর্য আছে দিবারাত্রির মোহনায়।

ইমনের করুণ কান্না নাগার্চির কানের সমতলে আকুলি-বিকুলি করে। কিন্তু তার নিজের মনে কোনো কান্না নেই। বেদনা মেশা এক রকমের পুলকে শরীর ছাওয়া। পদ্মার ঘুর্ণী ভয়ঙ্কর জলের বুক চিরে যেন চর জাগছে। নূতন সম্ভাবনা জগতে। তারই সুর বার বার আওড়ায় কলিম।

ফাঁক-তাল ছন্দের মাত্রা রাখতে গিয়ে হাত নেড়ে ‘হে’ শব্দ শেষে আবার গুনগুন শুরু করে। হঠাৎ বিচ্ছুরিত হাসি গোধূলির আবছা পটভূমি স্পষ্ট করে তোলে।

নাগার্চি চোখ তুলে চেয়ে দেখে, বাঁধের একটু দূরে কাশেম, হরি ও আরো তিন চারজন তামাক খাচ্ছে। জমিনের উপর লাঙল কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে বলদজোড়া। বৃষ্টি জলের সদ্য নিস্তরঙ্গ আরশীর ফ্রেমে আঁটা বলদ, লাঙল আর ছোট্ট বাবলা গাছের ছায়া- শীর্ষে সোনালী মেঘ।

‘এ হে নাগারচী।’ তামাকখোরেরা একসঙ্গে চীৎকার করে উঠলো সানন্দে।

হাসিমুখে কলিম হেঁকে জবাব দিল, ‘আহাম্মক সব, আক্কেলের গোড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছ?’

হরি জোরে বলে, ‘পেটের গোড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছি।’

কথার জবাব দিতে দিতে কলিম তাদের কাছে এসে পৌঁছল। কানে সুরের গুঞ্জন তখনও দোলা দিচ্ছে। হাসতে হাসতে নাগার্চি নেশাখোরের দলে ভিড়ে গেল।

কাশেম বয়সে ছোট। বলে, ‘মিয়া ভাই, হেই শব্দ শুনে ভাবলাম কেউ গরু তাড়াচ্ছে। দেখি গরু নেই কোথাও। একটা মানুষ আছে।’

কলিমের হাতে হরি কল্কে গুঁজে দিল।

হাসে নাগার্চি আর বলে, ‘আমি ত গরু দেখেই হেই করলাম।’

কাশেম ফুট কাটে- ‘ঐ বলদ জোড়া ছাড়া আর নাগার্চি সমঝদার কোথায় পাবে?’

হরি বলে, ‘দাদা, লোককে ভূতে পায় আপনেরে সুরে পায়।’

‘তা ঠিক বলেছো, হরি!’

অন্যান্য প্রসঙ্গ ওঠে। আবাদের কথা, বর্ষার কথা, খোশগল্প! হঠাৎ সব চাপা দিতে বিজ্ঞোচিত সুরে হরি বলে, ‘নাগার্চি ভাই, সুর জিনিসটা কি?’

কাশেম হাল্কা কথা চায়, সে জবাব দিল, ‘হাওয়ায় বাতাসে ভূত থাকে! সুর বাতাসের এক রকম ভূত।’

হাসে সবাই কলিম ছাড়া! সে তখন চড়া দম দিচ্ছে কল্কেয়।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মুখ খোলে সে, ‘ঠিক বলেছ। বড় ভূত। ঘাড়ে চাপলে রক্ষে নেই।’ তারপরই গম্ভীর স্বরে বলে, ‘তবে সুর জিনিসটা কি জানো?’

সকলে কৌতূহলী, চুপ করে। শোনা যাক নাগার্চির মন্তব্য।

একটু ভেবে বলে, ‘সুর হচ্ছে বাতাসে গেরো দেওয়া।’


বাতাসে গেরো দেওয়া? সকলে হৈ হৈ শব্দে হেসে উঠল। হরির পরনে গামছা ছিল, সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হি হি, সুর মানে বাতাসে গেরো দেওয়া। আজ নাগার্চিকে ভূতে ধরেছে।’ হরির আতিশয্য থামে না। মাঠের লোকদের শোনাতে সে খামাখা চিৎকার করে অথচ মাঠ এখন জন-বিরল। আশেপাশে কেউ নেই।

কাশেম হরিকে থামাতে গিয়ে গামছা ধরে এক টান মারতেই সে প্রায় উলঙ্গ হয়ে পড়ে আর কী! হাসির হররা চলে।

কলিমও হাসে- ‘তোমাদেরই আজ ভূত পেয়েছে, কোমরে কাপড় থাকছে না।’

কল্কে হাত ফেরে পালাক্রমে।

গোধূলির রঙে আরো এক ছোপ কালির প্রলেপ পড়ল।

হরি বলে, ‘দাদা, এবার খুব বড় জৌলুষ হবে?’

‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে কলিম।

জবাব এলো- ‘গঞ্জে। ঢ্যাড়া পিটে গেছে ঢোল বাজিয়ে।’

কাশেম উৎসাহের সঙ্গে বলে, ‘মিয়া ভাই, এবার গাঁয়ের নাম রাখা চাই। আপনার পার্টিয় (অর্থাৎ পার্টি) মতো বাজনা আমি শুনিনি।’

কলিম সামান্য নিস্পৃহ- ‘কিসের জৌলুষ হবে?’

‘ঐ আজাদী দিবস।’

‘কিন্তু আমি ত বাজনা ছেড়ে দিয়েছি।’ কিছুক্ষণ থেমে কলিম জবাব দিল।

‘বাজনা ছেড়ে দিয়েছ? পানি ছাড়া পানকৌড়ি?’

‘হ্যাঁ সত্যি, আর বাজাব না।’

‘কিন্তু এবার ঢ্যারাদার বলে গেছে, টাকা দেবে।’

‘তা দিক। আর বাজনা হাতে ধরব না। সন্ধ্যে হয়ে এলো। চলো, বাড়ি যাই।’

সকলে একবাক্যে বলে, ‘না। এখনও কাজ বাকী আছে।’ কলিমের কথা বলার বিশেষ উৎসাহ নেই। হরি জিদ ধরে, ‘দাদা, একটু মুখে বাঁশি বাজিয়ে শোনাও।’ কলিম গাল ফুলিয়ে সানাই বাঁশির অনুকরণ সুর বের করতে পারে।

‘না, আজ আর হুঁকোমুখো হতে পারব না।’ কলিম উঠে পড়ল। সকলে হেসে উঠলো।

তখনও সন্ধ্যে হয়নি। অন্ধকারের নীরব পাতালি শোনা যায়। কয়েক বিঘা দূরে গেরস্থর ভিটায় ঝাকড়া তেঁতুল গাছ হরেক রকমের পাখির ব্যবস্থা উছলে পড়ছে। যেন জংশনে ট্রেন এলো, বেশীক্ষণ থামবে না তাই চলছে যাত্রীদের তাড়াহুড়া। গায়ের বধূ পিদিম জ্বেলে ঘরের কোণে রেখে দিচ্ছে। সন্ধ্যে হলে উঠানে আনবে। মাঠের দুই পাশে দূরে দূরে সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে আসছে।

কলিমের মন আবার হালকা। সুরের রেশ হুল্লোড়ের মতো বুকে প্রবেশ পথ খোঁজে। পূরবী আর ইমন জড়াজড়ি করছে সর্পমিথুনের মতো বিলম্বিত লয়ে।

ধীরে পা ফেলছে কলিম। অন্ধকার এগিয়ে আসছে, ঘোমটা টেনে দিচ্ছে পৃথিবীর মুখে। সুরের হাওয়া তাকে অনেক দূরের জগতে পৌঁছে দিল। ঢিমা লয় আরো ঢিমা হয়। দূর জগত থেকেই আবার শোনা যায় দেবদাসীর নূপুর রিনিঝিনি দ্রুত হচ্ছে, লয় বদলে যাচ্ছে। যত এগিয়ে আসে, তত বিলম্বিত; আবার পিছিয়ে যাচ্ছে দ্রুত কাঁকন-নিক্কণে। মূর্চ্ছনার টানাপোড়েনে এক বিচিত্র গালিচার বুনন চলছে। তার আঙিনায় দাঁড়িয়ে কলিম। পা চলছে সরু আল-পথে। দুই নাগার্চি জেগে উঠেছে গো-ক্ষুরের দাগ ছাওয়া মর্মর সিক্ত তালবিথীর নিচে দিয়ে যেতে যেতে।

সুরের ফেন-দুর্গে ভেসে চলেছে আরোহী নাগার্চি। বেপথু হতে জানে না দুই পা। সমস্ত পৃথিবীর রহস্য তার জানা হয়ে গেছে এই মুহূর্তে। পথ ভুল করবে কেন সে?

ছোট বাঁশের সাকো, ডাহুক-খোঁচানো কচুরিপানার খাদ, আগাছার বন পার হয়ে কখন বাড়ির ভিটায় পা দিয়েছিল কলিম, এই হদিস তার কাছ থেকে জানার প্রত্যাশা নিরর্থক।


কঞ্চির বেড়ার উপর শুকনা কলাপাতা ঝোলানো। আব্রুর সীমান্ত। তারপর বাড়ির উঠান।

বেড়ার পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘কর্জ্জ পাইলে?’ থমকে দাঁড়ায় কলিম। এক নিমেষে আদমের সুর-স্বর্গের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। খোশমন কথা বলছে। খোশমন তার স্ত্রী।

আন্না নাগার্চির মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো, ‘না’। নির্বোধ কলিম দাঁড়িয়ে আছে তুষার-নিসাড় তরুর মতো। দুইজনে দাঁড়িয়ে থাকে। নিস্তব্ধ। হয়ত খোশমনের মুখে ছিল নির্মম অবসাদের ছাপ।

গোধূলির আয়ু শেষ।

ব্যাদন মুখ সায়ং অন্ধকার দম্পতিকে গ্রাস করে নিলো। কলিমের উঠান ছোট কিন্তু বেশ পরিষ্কার। শুচিতার স্পর্শ লেগে আছে। কয়েক হাত দূরে মৃত প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল আর দরজার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে বাঁশ ঝাড়ের গোড়া তারই কোলে আস্তাকুঁড়ে। উঠানের একটা সম্পদ ছোট ডালিম গাছ, অনেকদিন আগে কলিম লাগিয়েছিল। ফুল হয় এই গাছে, ফল হয় না। খোশমন প্রায় বলে, ‘আমাদের কপাল লেগেছে উঠানে।’

আজ সকালে কলিম একটা পিঁড়ির উপর বসে তবলার বোল তুলছিল। সম্মুখে তিন বছরের শিশুপুত্র আলিম।

দুইজনে সময় অপচয়ে রত। রান্না ঘরে আছে খোশমন। ভারী ঝামেলা করে আলিম। তাই খবরদারীর ভার পিতার উপরে। নচেৎ রান্না এগোয় না। ডুগডুগ শব্দ হয় উঠানের ভিতর।

আলিম হাসে আর তোতলায়: ‘বাজান, বাজাই’। শেষে ‘ই’র উপর দীর্ঘ টান। ‘বাজাও’ হেসে হেসে বলে কলিম।

পাণ্ডুর চেহারা আলিমের। মাথা ন্যাড়া। থপথপ পা ফেলে উঠানের এক কোণায় যায়। বাবা চাঁটি মারছে তবলায়। সে দৌড়ে এসে হঠাৎ ধাঁই এক চাঁটি কষায় কচি হাতে।

পিতাপুত্রে আবার হাসি বিনিময় হয়।

পরে কলিম নিচু গলায় গায়: দে দৈ, দে দৈ। তবলায় গুমগুম শব্দ হয়।

‘বাজান, আমি দৈ খাম্।’

‘দূর, বেটা। জাতি নাগার্চির বেটা। তবলার কথা শুনে বলে দৈ খাবো।’

‘আমি দৈ খাম্।’

কলিম হাসে। পুত্র তবলায় চাঁটি মারে এলোপাতাড়ি। ওদিকে বাজান তানা নানা ভাঁজা শুরু করে ছন্দ লয়ে। পিতার অনুকরণে আলিম ঘাড় নাড়ে, মাথা কাৎ করে।

পিতা ঘাড় দুলিয়ে ঝোঁক রাখার মাথায় সেও এক চাঁটি দিল যথাসময়ে।

‘সাবাস বেটা, শম বুঝতে শিখেছিস।’

তবলায় নিজে ঘা দিয়ে দেখিয়ে দিল কলিম। চটুল ছন্দে আবার তা না না শুরু।

শমের জায়গায় পিতার ঘাড় নাড়ার ভঙ্গী দেখেই আলিম চাঁটি মারে।

‘সাবাস, বেটা।’

‘আলিমের মা, দেখো।’ হাঁক দিল নাগার্চি।

খোশ্মন রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘামে ভেজা মুখ আঁচলে মুছতে মুছতে বলে, কী?

‘দ্যাখো।’

সুর ভাঁজতে ভাঁজতে দমক মেরে ওঠে কলিম। তবলা তখন শিশুর হাতের চাঁটি খায়।

‘দেখেছো? সাবাস, বেটা।’

‘কী দেখবো?’

‘এখনই এমন তাল-জ্ঞান। কালে বড় খুব বাজিয়ে হবে।’

অবিশ্বাসের সুর স্ত্রী-কণ্ঠে: হুঁ।

‘দেখো। বাজিয়ের ছেলে ত। রেডিয়োয় বাজাবে।’


কয়েকদিনের জন্য গ্রামে ব্যাটারি সেট রেডিয়ো এনেছিল খাঁ বাড়ির এক জামাই। সকলে ঐ যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত। অন্তত নাম মুখে শোনা আছে।

স্ত্রী আবার ঝাঁঝ ঝাড়ে- ‘কালে রেডিয়োয় বাজাবে। এখন কালের মুখ থেকে বাঁচলে হয়।’

আলিম খোশমনের উপর বিরক্ত হয়, ‘তোমার মুখ বড় পাতল।’

‘ঝুট বলেছি, তিন মাসে জ্বর গেল না। ফের বিকেলে জ্বর আসবে। তুমি এনেছো শহরের বাজনার খবর।’

কলিম চুপ করে যেতে বাধ্য। ছেলের পাণ্ডুর চেহারার দিকে চেয়ে সে দমে গেল। বর্ষা সম্মুখে। আরো ভয়।

খোশমন রান্না ঘরে ফিরে যায়। আলিম খেলা করে। পিতা সায় দেয়। কিন্তু উৎসাহ নেই তার পেছনে।

সকালের রৌদ্দুর টিকটিক করছিল ডালিম পাতার উপর।

বিষণ্নতা ছেয়ে আসে নাগার্চির মুখে। নানা কথা ভাবে। এমন অনটনবহুল সংসার। অনেকে বলে, গান-বাজনা হারাম। এই পাপেই বোধহয় সংসার ছারখার হচ্ছে। মিয়া সাহেবেরা বলে, ছোট লোক। মজলিশে খেতে ডাকে না গাঁয়ে। কিন্তু যারা সব গোনাহ করছে, তারা ত সুখে আছে। তারা শরীফ। রোজ ফনোগ্রাম বাজায় এ-পাড়ার শেখেরা। তারা বেশ সুখে আছে। গোনা-পাপ কিছু না হয়ত। বাজনা হারাম হবে কেন? আমি ত কারো অন্যায় করিনি? তবু দুমুঠো ভাত জোটাতে পারিনে এদের... এলোপাতাড়ি চিন্তা সব।

আলিম বাবার আনমনাভাব দেখে খুশী হয় না। তার কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে বলে বাজাও।

কয়েক বার হাত সরিয়ে শেষে ধমক দিতে চোখ রাঙায় নাগার্চি। অভিমানে আলিম একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখে হাত চাপা দিয়ে বলে, ‘মা-কাছে, মা-কাছে যাই।

‘না, এসো। আমা-কাছে।’ পুত্রের অনুকরণ করে কলিম। মুখে শুষ্ক হাসি টানার চেষ্টা চলে।

আলিম পা পা এগিয়ে এলো।

চিন্তার জটলা আবার ঘিরে ধরত, এমন সময় নমুপাড়ার পরাণের গলা শোনা গেল। 

‘মিয়া ভাই ঘরে।’

‘এসো, পরাণ। (পুত্রের দিকে) তোমার কাকা আসছে। বাজনা দেখাও।’

আলিম তবলায় চাঁটি মারে।

পরাণ তখনও বেড়ার ওপারে। কলিম হাঁকল, ‘ভেতরে এসো পরাণ, তোমার ভাবী এখানে নেই।’

পরাণ একা আসেনি। সঙ্গে নাসির।

‘আচ্ছা, নাসির মিয়াকেও দেখছি।’

কথা শেষ না করেই কলিম ঘর থেকে ছেঁড়া মাদুর নিয়ে এলো।

‘বসো, পরাণ। বসো, নাসির।’ আতিথেয়তায় কলিমের কণ্ঠস্বর যেন বাজছে।

নাগার্চি আবার উঠে গেল কল্কে সেজে আনতে। হঠাৎ দুজন মেহমান দেখে ঘাবড়ে যায় আলিম। সেও পিতার সঙ্গে রান্না ঘরে ঢুকল।

টান মেরে নেশামুখী আগুন উঠলে কল্কে পরাণের হাতে দিতে দিতে নাগার্চি বলে, ‘কী খবর, পরাণ?’

‘খবর আছে।’

‘কী কও?’

‘বায়না আছে। ভয়ে ভয়ে পরাণ শব্দ দুটো বের করে।’

‘বায়না?’

কলিমের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বিস্ময়রঞ্জিত।

পরাণ অনুনয় ও অপরাধের সুরে উত্তর দিল, ‘আপনারে না  জিজ্ঞেস করেই বায়না নিয়েছি।’


কলিমের কণ্ঠ থেকে আহত স্বর বেরিয়ে আসে, ‘কেন তোমরা বায়না নিয়েছ, তোমরা যাবে। আমার এখানে কেন? তোমরা জানো, আমি গান বাজনা ছেড়ে দিয়েছি। সুর দিয়ে পেটের অসুর পোষা যায় না। দল ভেঙ্গে গেল... হাফিজ শহরে গেছে, কতজন কতদিকে গেল, তুব...’

দুএক পশলা ভর্ৎসনা বর্ষণ চলে। পরাণ ও নাসির মুখ খোলে না। ঝাল ঝেড়ে নিক, ঝোঁপ মতো কোপ দেওয়া যাবে- তাদের এমনই ভাবখানা। নাগার্চির সঙ্গে নুতন পরিচয় নয় ত।

নাসির সাহস সঞ্চয় করে প্রথম, ‘ভাটির রাস্তায় দশ মাইল। তিন দিনের বাজনা। বাদ খোরাকী চল্লিশ টাকা দেবে। কি করে ছাড়ি বলেন?’

হু বলে কলিম চুপ করল।

ঝড়ঝাপটা কত যাচ্ছে। তবু বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তার শরীর ভেঙ্গে যায়নি। গোঁফ দুটা কাচপাকা ঘন। অভিমান আহত ক্ষুব্ধ  বেদনা চোখে সতেজ।

আসর স্তব্ধ।

পরাণ মনে মনে ভয় পায়। নাসির মাথা হেঁট করে বসে থাকে।

মুখ খুললো আবার নাগার্চি, ‘কি বাবদ বায়না? সত্যি টাকা দেবে ত?’

নাসির এক পলকে মুখের কথা শেষ করতে চায়। কাজেই হোঁচট খেল জোর- ‘ঠিকাদার-ভাত-টাকার ছেলে-।’

‘থামো, থামো। ঠিকাদারের ছেলের মুখে ভাত দেবে?’ মাথা নাড়ল কলিম, মাথা নাড়ল পরাণ। নাসির সায় দিল।

‘বেশ ভালো কথা। পরাণ যা তড়বড় করে, যেন ট্রেন ছেড়ে গেল। ভালো কথা। কিন্তু যন্তর যোগাড় করতে হয়। আমার ডুগী ছেঁড়া, বাঁশি দেখতে হবে।’

আরো অভিযোগ আছে কলিমের।

পরাণ উৎসাহ চেপে রাখতে পারে না। ‘মিয়া ভাই, সব যোগার হবে।’ নাসির খুব উৎফুল্ল মনে মনে। তবু ওস্তাদের মেজাজ ঝালাইয়ের জন্য বলে, ‘আমার বেহালার তার পুরাতন- জং ধরা।’

‘ওতেই চলবে।’

কলিম নাগার্চি সায় দিয়েছে। নাসির বেনো পানির গন্ধ পাওয়া মাছের মতো তড়পাতে লাগল। সে খামাখা চেঁচিয়ে ডাকে, ‘আলিম চাচা, ও চাচা’। অথচ এই ডাক পিতৃব্য স্নেহের তাগিদে মোটেই নয়।

আলিম রান্না ঘর থেকে উঁকি মেরে একবার মুখ দেখিয়ে আবার আড়াল হয়ে গেল।

‘চলবে পুরোনো তার, মিয়া ভাই?’ নাসির পুত্র ছেড়ে এবার পিতার স্নেহপ্রার্থী।

‘শোনো, নাসির। বাজনার আসল হচ্ছে কান, তারপর হাত- দুটো মেলা চাই। যন্তোর সামান্ন সাহাজ্জ করে। বেহালাটা আমাকে দিও।’


সুতরাং নাগার্চির বায়নায় যেতে মত আছে। নাসির ভাবে যন্তর চুলোয় যাক। রাজী হয়েছে, এই যথেষ্ট। গত তিন বছর থেকে নাগার্চির কি যেন হয়েছে। কোথাও বায়না নিতে চায় না। লুকিয়ে ভিন-গাঁয়ে মুনিশ খেটে এসেছে, তবু বায়নার কাছে ঘেষেনি। অবশ্য বায়না আর সাবেক কালের মতো হয় না। মেয়েদের নাকে কানে গয়না দিতে আগে নাগার্চির ডাক পড়ত। দেশের হাত-পা নাই আজ। চঞ্চলতা নেই কোথাও।

আজাদীর প্রথম উৎসবে বাজিয়েছিল নাগার্চি। শহরের সাহেব বাবুরা পর্যন্ত থ হয়ে গিয়েছিল, এমন মিষ্টি হাত! তারপর আর সে নিয়মিত বাজায় না। কি যে হলো? নাসির ভাবে।

আজ সে বলে, ‘মিয়া ভাই, আজাদী দিবসের মতো বাজানা চাই। ভাটির মুল্লুক মাত করে দিয়ে আসবেন।’

রুষ্ট কণ্ঠে জবাব দিল নাগার্চি, ‘আর কখনও ভালো বাজায়নি?’

‘না, আমি তা বলছিনে। সেদিন বারোয়া সুর খুব মিঠে লেগেছিল।’

‘মন থাকলে বাজনা আসে। মন উঠে গেলে-’ কথা শেষ করে না নাগার্চি।

নাসির বিনয় প্রকাশের সুযোগ খুঁজে, মাথা হেঁট করল। পরাণ মনে মনে খুশী। নেশায় পেট ফুলছিল। বলে ‘মিয়া ভাই এক কল্কে ধোঁয়া।’

নাগার্চি উঠে গেল রান্না ঘরে কল্কে হাতে।

ফিরে এলে নাসির পুরাতন রসিকতার খেই টানে। ব্রাহ্মণরা দাদা ডাকে অগ্রজকে। পরাণ সেই জন্য বলে, মিয়া ভাই ভারী ব্রাহ্মণবিদ্বেষী যে। নমুদের পাড়ায় মিয়া ভাই অর্থ কলিম নাগার্চি। শেষে এক সঙ্গীতপিপাসু ব্রাহ্মণ-সন্তান নাম সুশীল, কলিমকে মিয়া ভাই ডাকা শুরু করল। নমু তখন ডাকত, ওস্তাদ। সুশীল আর পরাণের এই আদাওতি সকলে উপভোগ করত। আলাপচারিতায় তামাক ফুরিয়ে এল।

পরাণ বলল, ‘উঠি, মিয়া ভাই, তোড়জোড় ঠিক রাখা যাক, কাল যেতে হবে।’

সাঁঝবেলায় এখানে এসো। মহড়া দেওয়া দরকার। কলিমের উপদেশ নিয়ে সানন্দে দুজনে বিদায় নিলো। খোশমনের আশঙ্কা ভিত্তিহীন নয়। আলিমের জ্বর এলো বিকেলে। সন্ধ্যায় গায়ের তাপ বেশ বাড়ল।

কিন্তু সন্ধ্যায় আসর বসল যথারীতি। নাসির ও পরাণ নূতন তালিম নিয়ে গেল।

পুত্র পীড়িত। পিতা বাদ্যযন্ত্রে মত্ত। খোশমন সেদিন ক্ষমা করেনি নাগার্চিকে। একদম চুপ হয়ে গেল সে সন্ধ্যা থেকে। নির্মম পাথর হতে জানে খোশমন। এই পাগল লোকটাকে শাস্তি দেওয়ার আর কোনো পথ নেই। রাত্রে নাগার্চি পুত্রের গায়ের তাপ অনুভব করে আর বলে, ‘আলিমের মা, আমাদের পেশাই এমন। লোকে ভাবে, খুব মওজে আছে। কাল ওদের নৌকায় বসে আবার নূতন করে শিখতে হবে। খামাখা সময় নষ্ট আজ।’

খোশমন জেগেছিল, কোনো জবাব দিল না।

নাগার্চি পুত্রের গায়ে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। আপশোস্ হয় তার, এত ভুল চাল শিখিয়েছে এতক্ষণ। কানের কাছে গুঞ্জন আসে, মাথা তেতে ওঠে।

অনুতাপের জ্বালায় অনেকক্ষণ ঘুমাতে পারে না। সুরের অবহেলা যেন তার কাছে আত্মমর্যাদার অবমাননা। মেজাজ ঠিক ছিল না সত্য। কিন্তু এমন কাজে কেন গেল সে? নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে কলিম।

জ্বরাক্রান্ত আলিমের তপ্ত গণ্ডদেশে চুমু দিতে গিয়ে অন্ধকারে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল নাগার্চির প্রাত্যহিকতা-দগ্ধ ডাগর দুই চোখ থেকে।

পরদিন খোশমন বলল, ‘গঞ্জের কাছে যাবে। হাতে টাকা থাকলে, আমার জন্য একটা নূতন কাপড় এনো। আমার কাফন কিনতেও ত তোমার টাকা খরচ হবে। দুদিন আগেই না হয় কিনলে।’ তারপর ছেঁড়া তালি দেওয়া কাপড়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।  

আজ কলিমের পরনে মোগলাই বেশ। সিন্দুক থেকে টেনে বের করেছিল পুরাতন কীট-দষ্ট সালোয়ার, কল্লিদার পাঞ্জাবি। জীর্ণ ঘরে কাঁচা ভাঁজে বোঝাই। সদ্রীয়ার জরির কাজ কবে তামাটে হয়ে গেছে। নাগার্চির বেশ বহুদিন পরে।

বেহালা নেওয়া হয়নি। তালি দেওয়া ব্যাগ পাইলে কাজ চলবে। বাঁশি বাজাবে পরাণ। ডুগি তবলার লোক আছে আর একজন।

কলিম খোশমনের প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ছেলের মুখখানা একবার দেখতে ভুলে গেল। দুবছরে প্রথম ব্যতিক্রম।


গৃহস্বামীর বাড়ি পৌঁছে সকলেই অবাক। এলাহি কারখানা! নূতন ইমারত, সম্মুখে প্রশস্ত পাকা উঠান। তারপর শান বাঁধানো পুকুর। ঘাটের উপর ছাদ। এখানেই রৌশন-চৌকির আসর।

কয়েক বছর আগে হলে পাওয়ার আশ্বাসে কলিম খুব খুশী হতো। ম্রিয়মান পরিবেশ থেকে তার মন আর জীইয়ে ওঠে না।

পরদিন ছেলের মুখের অন্নপর্ব। ঠিকাদার সাহেব বলে গেলেন, ‘বাদ জোহুর মজলিস শুরু। নূতন করে বাজাও নাগার্চি।’

একটু পরে বৃন্দাবনী সারং কেঁপে কেঁপে ওঠে বাঁশির ছেদা পাঁজরে, ব্যাগ পাইপ আর সানাইয়ের দীর্ঘশ্বাসে। ঢলা-দুপুরের আকাশ নেশাগ্রস্ত। সুরের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে অভ্যাগতদের হট্টগোলে, আনন্দের বন্দীশালায়। কলিম ভাবে, মজলিস বসবে। এদিকে আমরা বাজনায় মশগুল থাকব। যে ছেলে নিয়ে এত, তার মুখ একবার দেখতে পাব না? এখান থেকে মজলিস দেখা যায়, তবে খেয়াল যদি না থাকে।

একটু হাঁফ ছাড়তে ওরা থামল। আবার শুরু হয় গৌড় সারেঙ্গের সুর-রঙ্গ।

কলিম বার বার মজলিসের দিকে চায়। উঁচু মোটা বালিশের পাশে একজন বোজর্গ লোক বসে আছেন। এই বাড়ির দীক্ষাগুরু। উৎসবের আসল কর্ত্তা তিনি। এখনও শিশু মজলিসে আসেনি। সামিয়ানা টানানো উঠানের নিচে রং-বেরঙের মেহমান। কয়েকবার তাল কেটে গেল নাগার্চির। নাসির সামলাতে গিয়ে অগ্নিচক্ষু দেখল।

একটু পরে সভায় আলোড়ন শুরু হলো। চৌ-দোলে একটি নধরকান্তি শিশুকে চারজন কিশোর বয়ে আনছে। হেলান দিয়ে বসতে শেখেনি, একজন শুভ্র দাড়ী সমন্বিত বৃদ্ধ তাকে ধরে আছে। শিশুর পরনে রেশমের ছোট পাজামা, ছোট আচকান। গলায় সাদা ফুলের মালা। হকচকিয়ে গেছে ছেলেটি।

মজলিসে চৌ-দোলা নামল। এবার এত লোক চারিদিকে ভীর করে যে নাগার্চির চোখে আর কিছুই পড়ে না। তাই বাজনায় মন দিল। কিন্তু ঝিমিয়ে যাচ্ছে সুরের লীলা গতি। কলিম বোধ হয় বিরক্ত হয়ে একবার থুথু ফেলে নিলো। পেশাদারী তাগিদে ফুঁ দিচ্ছে সে ব্যাগ পাইপে। নাসির মুখ টিপে টিপে হাসে, তা নার্গাচির চোখ এড়ায় না।

একপালা শেষ হয় না, কলিম বলে, ‘জিরিয়ে নাও। নায়েব বললে আবার শুরু করবে।’

পরাণ বিড়ি টানতে টানতে বলে, ‘ওস্তাদ, নৌকায় যে চালের কথা বললেন, বেশ ভালো লেগেছিল। আজ বাজালেন না!’

‘চুপ বে। তোর কাছ থেকে শিখব চাল?’

ধমক খেয়ে পরাণ ও নাসির মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। নাগার্চির হলো কি?


পরদিন বিদায়ের সময় কলিম এক কাণ্ড করে বসল। ঠিকাদার টাকা দিতে এসেছে। চল্লিশ টাকা থেকে একটা টাকা নিয়ে নাগার্চি বলে, ‘এটা, খোকাকে সওগাত দেবেন।’

ঠিকাদার হাঁ-না-বিনা উত্তরে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের গন্তব্য পথে চলে গেল অত্যন্ত ব্যস্ততার ভানে। নাগার্চি কয়েক পা এসে টাকাটা জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। পরাণ বা নাসির কেউ কুড়িয়ে নিতে সাহস পেল না।

আবার নদীর ঘাটে, তুচ্ছ কি এক ব্যাপার নিয়ে নাসিরকে নাগার্চি মারে-মারে এমন ভাব। দুজনে এই অবোধ মানুষটাকে চেনে, তাই গায়ে মাখে না কিছুই।

নৌকায় চড়ে নিজের মনেই বলে নাগার্চি, ‘টাকা দিয়ে ভাবে সুরের দাম দিয়েছি। ইতর-’ তারপর মুখে বিড়বিড়। তারপর আর কারো সঙ্গে সমস্ত পথ সে বাক্যালাপ করেনি। সকলে জানে আবহাওয়া উত্তপ্ত। অতএব স্তব্ধতা সইল।

নৌকায় শুয়ে পড়ল কলিম।

দুপুর শেষে হয়ে যায়নি তখনও। মেঘলা বাতাস বইছিল জোরে। ঠাণ্ডায় কলিম চোখ বুজে শুয়ে থাকে, কিন্তু ঘুমায় না।

পানির কাছে এলেই তার মন কেমন হয়ে যায়। নাগার্চির বহু দিনের ইচ্ছা বৃষ্টির পতন ধ্বনি, ঝরনার মুখরতা, বিলের পানির ছলছল উদারতা, জোয়ার জলের গর্জন- সব মিশিয়ে সে নূতন রাগ রচনা করবে। তার নাম দেবে, রাগ কল্লোলিনী। নিজের পিতার কাছেই কলিম সুরের পরিচয় পেয়েছিল। শব্দ দিয়ে সুন্দর মাটির জগৎ রচনা করা যায়। তার অকাল মৃত্যুর ফলে অনেক শিক্ষাই বাকী থেকে গেছে।

নদীর জল-তরঙ্গ নাগার্চির কানে নূতন আবেশ রচনা করে। কিন্তু মেজাজ বিগড়ে আছে তার। বুকের কন্দরে অশোয়াস্তি সব ছিঁড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চায়। সুরের ঝিল্লীদল অন্ধকার বয়নে থেমে যায় বার বার।

নৌকা থেকেই নেমেই নাগার্চি সোজা হনহন বাড়ির দিকে ছুটল। সাজ সরঞ্জাম বন্ধুদের হাওলায়। বেলার আলো নিভে আসছে। একবার নাগার্চির মনে হয় এই অবেলাটুকু উপভোগ করা যেত। বাংলার মাটি আস্বাদ একবার যে দেখেছে সেই মজেছে। প্রান্তর তরুলতার মমতা এখানে অন্য পৃথিবীর আর কোথাও হয়ত নেই। আর কিন্তু সময়ও নেই।

ভীম-পলাশীর উদাস তান বারবার আছড়ে পড়ে কানের চারিদিকে। একটা ফিঙ্গে ডেকে গেল, জোড়া ঘুঘু চড়ছে মাঠে, সবুজ ঘাসের উপরে ঝিরিঝিরি সুতামিহি বৃষ্টি স্রোতে শামুক ঘুরে বেড়াচ্ছে- সুরের প্রতিভূরূপে সবাই ডাক দিচ্ছে। সুলতানির বৈরাগ্য আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে গোধূলির আকশে!

দূর বাজনা বাজছে। হয়ত আজাদী দিবসের মহড়া। সেদিকে কলিম কান পাতে না, দ্রুত হাঁটে।

ঘরের সড়ক পথে ঢুকতেই বাঁশ বনের নিচে, নাগার্চির চোখে পড়ল ছোট্ট কবর। পাড়ায় বহু ছেলে ম্যালেরিয়ায় ভুগছে। আন্দোলিত গমকের মতো হঠাৎ কলিমের বুক দুরুদুরু করে ওঠে। যদি যদি শব্দে হাজার ঢাক বাজাচ্ছে, কারা যেন পাঁজরের প্রাচীরের উপর নৃত্যরত।

দ্রুত এগিয়ে এলো নাগার্চি।

বেড়া ধরে আকাশের দিকে চেয়ে আছে খোশমন। বোবাদৃষ্টি যেন সদ্য উন্মাদিনী। বিস্ফারিত ডাগর চোখে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।

অজানিতেই নাগার্চির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘মরে গেছে?’

‘হ্যাঁ, আমার ছেলে মরে গেছে, তোমার কী?’ চকিতে খোশমনের নির্মম কণ্ঠস্বর আছড়ে পড়ে।

নাগার্চি সেখানেই বসে পড়তে বাধ্য হলো।

পৃথিবীর মাটি আজদাহার মতো আস্তে আস্তে তাকে গিলে নিচ্ছে।


সংগ্রহ ও ভূমিকা : কাজী জাহিদ
১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর ঢাক থেকে বেশ কয়েকটি নতুন পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়। এসময় ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মরহুম এ. এইচ. এম. আবদুল কাদের (১৯১১-১৯৯৪) তাঁর আকালপ্রয়াত স্ত্রী বেগম দিলরুবা কাদেরের স্মৃতিস্মরণে ‘দিলরুবা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাস)। প্রথম সংখ্যায় ঘোষণা করা হয়: ‘এ পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ত্রিবিধ। প্রথম উদ্দেশ্য বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের দৈন্য দূর করার চেষ্টা করা। ...আমাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলা সাহিত্যের গতিপথ নির্দেশের চেষ্টা করা। ...তৃতীয় উদ্দেশ্য পত্রিকার দ্বারা ভবিষ্যতে কোনো সমাজ-সেবার কাজ করা যায় কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা। ...এ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে বেগম দিলরুবা কাদেরের স্মৃতিকে স্মরণ করে। তিনি অল্প বয়সেই কলিকাতার লেডি প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পেয়েছিলেন, কিন্তু বেশিদিন জীবিত ছিলেন না; প্রসব-সংকটে ১৯৪৬ সনের ৩রা সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। তিনি বিদ্যোৎসাহী, তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্না বহু গুণান্বিতা ছিলেন। নারী শিক্ষার দিকে তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে বিশেষ কিছু তিনি করে যেতে পারেন নি। তাঁরই সম্পদ ও আদর্শ কেন্দ্র করে তাঁরই আত্মার প্রেরণায় ‘দিলরুবা’ প্রকাশিত হলো।’


দিলরুবার ৩য় বর্ষ ৩য় ও ৪র্থ সংখ্যা প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে। সংখ্যা দুটিতে সম্পাদক হিসেবে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, দৌলতুন্নেছা খাতুন, এস. রহমান এবং এ. এইচ. এম. আবদুল কাদের (সাধারণ সম্পাদক)-এর নাম মুদ্রিত হয়েছে। ৩য় বর্ষ ৩য় সংখ্যাটি ঈদ সংখ্যা এবং ৩য় বর্ষ ৪র্থ সংখ্যাটি আজাদী সংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত ঈদ সংখ্যায় ‘নাগার্চি’ শিরোনামে শওকত ওসমানের (০২.০১.১৯১৭-১৪.০৫.১৯৯৮) একটি ছোটগল্পের প্রথম অংশ মুদ্রিত হয়েছে। গল্পটির ২য় অংশ মুদ্রিত হয়েছে আজাদী সংখ্যায়।

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক শওকত ওসমান। হবীবুল্লাহ্ বাহার ও শামসুন নাহার সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে। পরে আসেন গদ্যে। নিরন্তর লিখেছেন নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখা, শিশুতোষ রচনা। কাব্যরচনা করেছেন ব্যঙ্গ আকারে। অনুবাদও করেছেন প্রচুর। লেখনীর মাধ্যমে তিনি শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে এবং শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।

শওকত ওসমানের মৃত্যুর পর ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র অধ্যাপক বুলবন ওসমানের সম্পাদনায় সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় শওকত ওসমানের ‘গল্পসমগ্র’। গল্পসমগ্রের প্রস্তাবনায় বুলবন ওসমান উল্লেখ করেছেন: ‘পুস্তকাকারে যেসব ছোটগল্প ছাপা হয়েছে শুধু সেগুলোই এই সংকলনে স্থান পাচ্ছে। এর বাইরে বেশ কিছু লেখা অগ্রন্থিত থেকে গেছে।’ শওকত ওসমানের প্রকাশিত বারোটি গল্পগ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে মোট ১৪৩টি গল্প। তাঁর ‘সাবেক কাহিনী’ গ্রন্থে একটি গল্পের অর্ধেক ছাপা হয়। গল্পটির শিরোনাম ‘তিন পাপী’ । এই গল্পটি তাঁর গল্পসমগ্রে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অন্যদিকে ‘গল্পসমগ্রে’ স্থান পেয়েছে মোট ১৪২টি গল্প। উল্লিখিত কোনো গ্রন্থেই ‘নাগার্চি’ গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

২০১৭। শওকত ওসমানের জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে রাইজিংবিডির ঈদ সংখ্যায় শওকত ওসমানের অগ্রন্থিত এই গল্পটি পুনঃর্মুদ্রণ করা হলো। গল্পটিতে শওকত ওসমানের বানান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়