ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দুই বন্ধুর ‘ঢাকা অ্যাটাক’

সানি সানোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪০, ৯ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুই বন্ধুর ‘ঢাকা অ্যাটাক’

দীপংকর দীপন ও সানি সানোয়ার

সানি সানোয়ার : বাংলাদেশের সব শ্রেণির সিনেমাপ্রেমী দর্শক এবং দেশপ্রেমী মানুষের স্বপ্নের নাম ঢাকা অ্যাটাক- Dhaka Attack।

কারণ, দর্শক সারিতে বসে রূপালি পর্দায় বাংলা ভাষায় যে সিনেমা দেখতে চেয়েছিলাম, সেটাই হচ্ছে ‘ঢাকা অ্যাটাক'। প্রথম চেষ্টায় আমরা কতটুকু সফল বা বিফল হয়েছি তা দর্শকরাই বলে দেবেন।

দেশীয় সিনেমা হলে বিদেশি মানের বাংলাদেশি সিনেমা দেখার স্বপ্ন কোন দর্শকের না আছে?  কিন্তু, দিনে দিনে সে স্বপ্পটা যখন ফিকে হয়ে আসছিল তখন দেশীয় সিনেমা নিয়ে অনেকের ভাবনাটাই বন্ধ হয়ে গেল। তবুও সিনেমা নির্মাণ থেমে যায়নি। তবে গল্প, মেকিং, অভিনয়– কোনো কিছুতেই যেন সব শ্রেণির দর্শকদের মন ভরছিল না। তাই বিদ্রোহী দর্শকের মতো কাগজ-কলম আর ক্যামেরা হাতে অনেকে নির্মাতাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এতে কেউ কেউ সফলও হয়েছেন, আবার কেউ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তবে কাউকে ব্যর্থ বলা যাবে না। কেননা, তাদের এই ঝাঁপিয়ে পরাটা তাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পাঁয়তারা নয়, বরং সিনেমার উন্নয়ন সমুন্নত রাখা। তাই সিনেমা শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমগ্র সিনেমাযোদ্ধাদের সাধুবাদ জানাই।

দেশীয় সিনেমার বাজেট-মার্কেট যতই সংকুচিত হয়ে আসুক না কেন, অধিকাংশ  দর্শক এখনো দেশীয় চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক মানে দেখার স্বপ্ন দেখেন। শতাধিক টিভি চ্যানেল আর অনলাইনের কল্যাণে সবাই এখন ফিল্ম এডুকেটেড। সিনেমাভিত্তিক কয়েকটা ব্লগ কিংবা ফেসবুক গ্রুপে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়, ফিল্ম নিয়ে দর্শকদের ভাবনাগুলো কতটা উন্নত। তাদের ভাবনাগুলো যতটাই পরিপক্ক হোক না কেন তারা বাংলা ভাষাতেই শ্রেষ্ঠ সিনেমা দেখতে চান। যদিও এদের অনেকেই বিদেশি সিনেমার পোকা।

দেশীয় চলচ্চিত্রের ধারা দেখে তারা এখন সংকল্প করে নিজেরাই কিছু একটা করতে পারেন কি না। তাদের আকাঙ্ক্ষা- দেশীয় সিনেমার ঢংয়ে একটু পরিবর্তন আসুক। কেননা, নতুন জেনারেশন এখন নতুন কিছু দেখতে চায়, ঠিক আইপ্যাড-ট্যাবে ইনস্টল করা তার থ্রিলার টাইপ গেইমসের মতো। কিন্তু বাস্তবতার খড়গে পরে কেউ আর তা বানাতে পারছেন না। তারপরও স্বপ্নবাজ দর্শক স্বপ্ন দেখেন- কেউ একজন পারলেই হলো।

ঢাকা অ্যাটাক চলচ্চিত্রের পোস্টার


সেই কেউ একজন হিসেবে কিছু একটা করতে আমরা ২০১২ সালের দিকে  ঝাঁপিয়ে পরেছিলাম। দেশীয় সিনেমাতে একটা ভিন্ন ধরনের সিনেমা উপহার দিতে একটা ক্ষুদ্র এবং সুন্দর পরিকল্পনাও হাতে নিলাম। এরপর ৫ বছর ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, বার বার থেমে গিয়েও সেই প্রজেক্ট আমরা বাস্তবায়ন করলাম। শেষতক আমাদের এবং লক্ষ্য-কোটি দর্শকের সংকল্পের যোগফল দিয়ে নির্মিত হলো এই ‘ঢাকা অ্যাটাক'।

পরিচালক দীপংকর দীপন নিজেই একজন বিশ্ব চলচ্চিত্রের পোকা। তাই মুম্বাই পেরিয়ে মোটা দাগে একটা প্রস্তুতি নিয়ে এসে বাংলাদেশের সিনেমাকে বিশ্ব সিনেমার আদলে নির্মাণ করার কাজ শুরু করেন।  এক্ষেত্রে লক্ষ-কোটি বুভুক্ষু দর্শকের অনুপ্রেরণা সাথে থাকলেও তিনি একটি ভালো গল্প এবং একজন পেশাদার বিনিয়োগকারীর অভাব বোধ করেন। তবুও বদলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে তিনি এগিয়ে যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্বে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই মেধাবী নির্মাতা মানসম্পন্ন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কোনো ছাড় দেননি। তাই তিনি মনের মতো একটা প্রজেক্ট পেতে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন।

একসময়  তিনি সেটা পেয়েও যান। ব্যস শুরু হয় ‘ঢাকা অ্যাটাক' নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম। স্বপ্নের এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা প্রথমে দীপংকর দীপনের মাথা থেকেই আসে। ২০১২ সালের কথা। আমি তখন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) হিসেবে কাজ করছি। মূল দায়িত্ব ছিল বোম্ব ডিসপোজাল টিমের ইনচার্জ হিসেবে বোমা এবং বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করা। গোয়েন্দাগিরি আর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ধারা বিশ্লেষণ করে একটি কপ থ্রিলার স্টোরি লিখতে শুরু করলাম। লেখা শেষে স্টোরির নাম দিলাম ‘থ্রিল পয়েন্ট'।

তখন গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমার চাকরির বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ঢাকা শহরের অত্যন্ত অপরাধপ্রবণ একটা এলাকার দায়িত্বে ছিলাম বলে স্বল্প সময়ে পুলিশিং সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাটাও বেশ ভালোই ছিল। পাশাপাশি বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের ইনচার্জ হিসেবে ততদিনে ৩/৪ বছররের অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে ঢুকে গেছে। তাই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বোমা বা বিস্ফোরকের ব্যবহারের ক্রম পরিবর্তনের ধরনটাও আমার জানা ছিল। তাই পুরো ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটের ওপর বাস্তবভিত্তিক একটি কাহিনী লিখতে আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

যদিও গল্পটিতে সিনেমাটিক ঢং দিতে যোগ দেয় একটি সিনেমাপ্রেমী ইয়াং গ্রুপ- ‘সিনেমাস’। এই গ্রুপের সদস্যরা নানা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও চলচ্চিত্র সম্বন্ধে রয়েছে এদের অঢেল জ্ঞান। প্রত্যেকেই অত্যন্ত উঁচু মানের সমালোচক এবং ভাবুক। তাই, তাদের ভাবনাগুলোকে পুঁজি করে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে আমরা গল্পটিকে ধীরে ধীরে সিনেমা বানানোর উপযোগী করতে থাকি। মাসের পর মাস ধরে তর্কবিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটি, রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমানের ফসল হিসেবে কংক্রিটের মতো দাঁড়িয়ে উঠে একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমার কাহিনী। আগাগোড়া বিবেচনায় এটিই হয়তো আজ এ দেশের প্রথম পুলিশ অ্যাকশন থ্রিলার সিনেমা। তবে প্রথম কি দ্বিতীয় সেটা নিয়ে আমাদের ততটা মাথাব্যথা ছিল না। আমাদের  গুরুত্ব ছিল পুরো গল্পেই টানটান উত্তেজনা রাখার।

ঢাকা অ্যাটাক চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য


টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা একটা মনমতো সিনেমার গল্প পেয়ে গেলাম। গল্পের দ্যুতি তখন মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো উলম্বভাবে আমাদের মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে লাগল। কিন্তু সিনেমা বানানোর মতো এত টাকা কোথা থেকে পাব? সিনেমার এত উপকরণই বা আমরা কোথা থেকে পাব? এরকম নানাবিধ প্রশ্ন তখন আমাদের মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকল। এতে গল্পের সেই উজ্জ্বল দ্যুতি অনিশ্চয়তার কারণে অমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে গেল।

এই সময় থ্রি হুইলারস লিমিটেডের কর্ণধার হায়দার আলী এবং খালেদুর রহমান জুয়েল ভাই গল্প এবং এই উদ্যোগকে নিজ সন্তানের মতো আগলে নিলেন। তারা দুজনেই মিডিয়ার মানুষ। তাদের পাশে পেয়ে আমি আর দীপন একটা শীতল ছায়ার স্নিগ্ধতা অনুভব করলাম।

এবার পুরো প্রজেক্ট সম্বন্ধে জেনে এগিয়ে এলেন জনাব মো. মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার, সিটিটিসি, ডিএমপি (তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার, ডিবি) এবং জনাব খন্দকার নুরুন্নবী, ডিসি, ডিবি-পূর্ব (তৎকালীন স্টাফ অফিসার টু ডিএমপি কমিশনার)। তারা দুজনে মিলে এই সিনেমা প্রজেক্টটি নিয়ে জনাব বেনজীর আহমেদ, ডিজি-র‌্যাব (তৎকালীন কমিশনার, ডিএমপি)-এর সাথে আমাদের আলোচনায় বসার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমরা একটা আশার আলো দেখতে পেলাম। দুটা প্রেজেন্টেশন বানিয়ে আমি, দীপংকর দীপন, মোহাম্মদ হায়দার আলী (থ্রি হুইলার্স), খালেদুর রহমান জুয়েল (থ্রি হুইলার্স) এবং আরো কজন মিলে কমিশনার স্যারের ছোট কনফারেন্স রুমে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু একি কাণ্ড! ধীরে ধীরে ডিএমপির সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ সেই মিটিংয়ে হাজির হয়ে গেলেন। আমরা তো রীতিমতো অভিভূত। সিনেমার মিটিংয়ে এত সংখ্যক সিনিয়র পুলিশ অফিসার আমরা আশাই করিনি।

যাহোক, তারা আমাদের প্রজেক্ট দেখে অভিভূত হলেন। ব্যস, কাজ শুরু  হয়ে গেল। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে একটি অনাড়ম্বর পরিবেশে রাজারবাগ টেলিকমে থ্রি হুইলার্স লিমিটেড এবং ঢাকা পুলিশ পরিবার কল্যাণ সমিতি লিমিটেডের সাথে একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হলো।

ঢাকা অ্যাটাক চলচ্চিত্রের পোস্টার


সেই চুক্তির পর গল্প থেকে একটি সুন্দর চিত্রনাট্যও তৈরির কাজ শুরু করে দিলাম। মাথায় থাকল কয়েকটা জিনিস:

- গল্পটা যেন ঝুলে না যায়।

- ক্লাইমেক্স এবং উত্তেজনা সর্বোচ্চ শিখরে নিতে হবে দেশীয় আদলে।

- বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন যেন না ওঠে।

- দর্শক যেন পরের দৃশ্য অনুমান না করতে পারে, ইত্যাদি।

সর্বোপরি এটাকে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক সিনেমা বানাতে সবকিছু ঢেলে দেওয়া হলো। ২০১৫-২০১৬ সালে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমরা উঠেপড়ে লাগলাম। ততদিনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ব্যাপক রদবদল হয়ে গেলে আমরা একটা আশঙ্কায় পরে গেলাম। কিন্তু না, মনিরুল ইসলাম স্যার নতুন পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান স্যারকে প্রজেক্ট সম্বন্ধে ধরণা দিলে তিনিও একাত্ম ঘোষণা করেন। ব্যস, আমাদের আনন্দ কে দেখে! এদিকে আইজিপি এ কে এম শহিদুল্লাহ স্যার তো আগে থেকেই পাশে ছিলেন। তাই পুলিশের টেকনিক্যাল এবং মানসিক সাপোর্টের সাপ্লাই চেইনটা আগের মতোই রয়ে গেল।

২০১৫ সালের দিকে আংশিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পেয়ে গেলাম একজন সিনেমাপ্রেমী মানুষকে। তিনি হচ্ছেন Splash মাল্টিমিডিয়া এবং সুখ্যাতি সম্পন্ন ডেভেলপার কোম্পানি ADDL-এর চেয়ারম্যান। তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এই মানুষটির ঋণ আমি এবং দীপন কোনদিন ভুলব না।

তার কাছে থেকে অর্থের কিছুটা আভাস পাওয়ায় এবার শুরু হলো সিনেমার চিত্রনাট্য, কাস্টিং এবং সঙ্গীতবিষয়ক কার্যক্রম শুরু করার পালা।

চলবে ...




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৭/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়