ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

খান আতা পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন: সোহেল রানা

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ১৬ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খান আতা পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন: সোহেল রানা

রাহাত সাইফুল :  ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে/দিকে দিকে বাজল যখন শেকল ভাঙার গান/আমি তখন চোরের মতো হুজুর হুজুর করায় রত/ চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে বাঁচিয়েছি প্রাণ’- গানটির স্রষ্টা খান আতাউর রহমান। এই গানের কথার মতোই ছিল ১৯৭১ সালের অবস্থা- বলেন চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব সোহেল রানা।   

মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে খান আতাউর রহমানের ভূমিকা জানতে চাইলে সোহেল রানা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘খান আতাউর রহমানের কথা বলতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ঘোষণার আগে স্বাধীনতা সম্পর্কে কয়জন চিন্তা করেছেন? কেউই করেননি। আমাদের ভাবনার মধ্যে স্বাধীনতা আসেনি। এসেছে বিদ্রোহ। আমাদের মাকে মা বলতে দেবে না, বাংলাকে বাংলা বলতে দেবে না এবং উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা। তখন আমরা প্রতিবাদ করলাম। এই প্রতিবাদ করার মধ্যে কিন্তু স্বাধীনতার বিষয় ছিলো না। যদিও এখন আমরা বলি ওটার মধ্যে স্বাধীনতার বীজ লুকিয়ে ছিলো।’

সোহেল রানা বলেন, ‘১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হলো তখন আমাদের স্লোগান ছিলো- জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। তখন আমরা যুদ্ধের প্রথম ধাপে চলে গেলাম। ১৯৬৯-এর পরে আরো অন্যান্য কিছু কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর এগুলো এক হয়ে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিলাম। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের দাবি করি, আদর্শগতভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধ কয়জন করেছি? তখন শিক্ষিত সমাজ, সুশীল সমাজ বুঝেছিলো আমাদের ভাষার ওপর আক্রমণ, সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ, জাতির ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে এবং ধর্মের নামে শোষণ চলছে। সুতরাং আমরা যুদ্ধ করবো। এই বিষয়গুলো গ্রামের কিছু লোককে বুঝাতে পারিনি। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ছিলো জীবন বাঁচাতে গিয়ে যুদ্ধ করেছে। তাদের যুদ্ধ ছাড়া কোনো পথ ছিলো না। এর মধ্যে ২০ ভাগ লোক ছিলো যারা সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধ বুঝে যুদ্ধে গিয়েছিলো।

১৯৬৬ সাল থেকে যারা গান, নাটক, সাহিত্য, আর্ট কালচার থেকে শুরু করে সব জায়গায় বিপ্লবী চেতনা নিয়ে এসেছে তারাই হচ্ছে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছে কি পারেনি সেটা পরের কথা। খান আতাউর রহমানের কথা বলা হয়- তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। আমি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুকে অনুরোধ করবো ১৯৬৯ সালে রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত গানগুলো শোনার জন্য। ২৫ মার্চের আগে এখানকার রেডিও ও টেলিভিশনে যে গানগুলো প্রচারিত হয়েছিলো তার ৩০ ভাগ গানের লেখক ও সুরকার খান আতাউর রহমান। এই গানগুলো যেন তিনি দয়া করে শোনেন। গানগুলোতে কী ছিলো? গানগুলোতে কি পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ ছিলো না আমাদের দেশের কথা ছিলো? এই গানে আমরা যে লাঞ্ছিত, অপমানিত, আমরা স্বাধীনতা চাই, বাংলা ভাষা চাই, বেতার থেকে রবীন্দ্রসংগীত বন্ধের প্রতিবাদ- এসব কিছু ছিল? এখন এই গানের যারা স্রষ্টা বা এখানে যারা জড়িত তারা পরে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পেরেছে কি না সেটা বড় কথা নয়।

তখন বাচ্চু সাহেবকে কেউ চিনতো না কিন্তু খান আতা সাহেবকে সবাই চিনতো। পাকিস্তানিরা এ-দেশের দশজন লোক চিনলে তার মধ্যে খান আতা একজন। ফলে বাচ্চু সাহেবের পালিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যতটা সহজ ছিল, খান আতা সাহেবের জন্য ততটা সহজ ছিল না। যে কারণে তিনি সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারেননি। অনেকেই রয়েছে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে যেতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য গান লিখেছেন, অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছেন, খাবার দিয়েছেন। পুলিশ, বিডিআর, আর্মি, শিক্ষক, চিকিৎসক - ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা বেতন নিয়েছেন কার কাছ থেকে? পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে। এখন তাই বলে কি তারা রাজাকার? বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষ তো আর যুদ্ধ করতে যায়নি- তারা কি তাহলে রাজাকার?

বাচ্চু সাহেব প্রমাণ করুক খান আতা পাকিস্তানের পক্ষে কোন গান লিখেছেন? আর যদি এমন হয় পাকিস্তানি আর্মি তার কাছ থেকে বন্দুকের নলের মুখে গান লিখিয়ে নিয়েছে তাহলে সেই গান দিয়ে কি তার পরিচয় হবে, না কি তার আরো যে সৃষ্টি রয়েছে সবগুলো মিলিয়ে তার পরিচয় বিবেচনা করা হবে? সারাজীবন মানসিকভাবে সে বাংলাদেশের স্বার্থে লিখেছে কি না সেটা দেখতে হবে। এক দিনের অপরাধ দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। মনে রাখতে হবে, এখানে আপনি নয় মাসের কাজ বিচার করছেন অথচ তার সারা জীবনের কাজ বিচার করছেন না। খান আতা বিভিন্ন আলোচনায়, আড্ডায় কী বলেছেন? যুদ্ধ চলাকালীন খান আতা পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। নাসিরউদ্দীন ইউসুফের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক অবদান ছিলো। আমরা যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম বাচ্চু সাহেবও সেই আদর্শের লোক। তাকে ভালো জানি, আপন জানি। তার মানে এই নয়, একজন লোক স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি, সেই কারণে তাকে আমি ‘রাজাকার’ বলবো? 

খান আতা একদিন আমাকে বলেছিলেন তোমরাই তো আমাদের সাহস জুগিয়েছ। ভরসা করে আছি। একদিন দেশ স্বাধীন হবে। তুই পারবি বাঙালির নাম রাখতে। তখন কিন্তু তিনি পাকিস্তানের কথা বলেননি। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। স্বাধীনতার পরপর কয়েকজন শান্তিনগরে খান আতাকে ‘রাজাকার’ হিসেবে আটক করেছিল। তাকে মেরে ফেলবে। তখন আমি ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)  ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমি খবর পেয়ে জিপে করে আর্মস নিয়ে সেখানে উপস্থিত হই। আমি ওদের ১৫ জনকে পিটিয়ে আতা সাহেবের কাছে মাফ চাইতে বাধ্য করেছিলাম। সেদিন ওদের বলেছিলাম- খান আতা তোদের বাবা।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ অক্টোবর ২০১৭/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়