ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ডুব আমাদের প্রত্যাশা ডুবিয়েছে || ছটকু আহমেদ

ছটকু আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৯, ২৯ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডুব আমাদের প্রত্যাশা ডুবিয়েছে || ছটকু আহমেদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্ব কবির সম্মান অর্জন করেও একজন সাধারণ লোকের পরিচয়ে খ্যাতিমান হতে চেয়েছিলেন আর আমাদের দেশের ইন্টেলেকচুয়ালরা খুব তাড়াতাড়ি সাধারণ থেকে সরে গিয়ে অসাধারণ লোক হয়ে উঠতে চান। খুব তাড়াতাড়ি একশো লোকের মাঝ থেকে সরে গিয়ে একাই একশো হতে চান। আমিত্ব এমন করে এদের গ্রাস করে রাখে যার থেকে তারা বেড়িয়ে আসতে পারে না। আর এই অসাধারণ হতে গিয়ে এরা এমন সব কীর্তি করে যা সাধারণের বোঝার বাইরে চলে গিয়ে সাধারণের মাথায় একটা বোঝা হয়ে যায় এবং এরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।

সাধারণ পর্যায়ে যখন থাকে তখন তারা অসাধারণ কীর্তি করে কারণ তখন তাদের মধ্যে ‘আমি কি হনুরে’ দেখাবার মানসিকতা কাজ করে না। আর ওই অসামান্য র্কীতি যখন সাধারণ মানুষ লুফে নেয়, প্রশংসা করে, তখন তারা নিজেদের অসাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করেন। বলতে শুরু করেন, আমার সৃষ্টি তোমাদের মতো নিরানব্বই ভাগ লোকের জন্যে নয়, আমার সৃষ্টি অভিজাত শ্রেণির জন্যে যারা তোমাদের শোষণ করে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তোমরা সাধারণ লোক আমার কীর্তি বোঝ আর না বোঝ এরা সেমিনারে আমাকে নিয়ে লেকচার দেয়।

ডুব ছবি রিলিজের আগে আমাদের পরিচালক সমিতি এবং বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগে মেহের আফরোজ শাওনের যে আশঙ্কা ছিল পরলোকগত লেখক পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নিয়ে সেটা একদম অসার মনে হয়েছে। মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করার একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করলেও হুমাযূন আহমেদের কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্টই ইরফানের কৃত চরিত্রের মধ্যে নেই।  হুমায়ূন আহমেদের চলা ফেরা, কথায় রস সৃষ্টি, গুন গুন করে গান করা তার বিন্দু মাত্র নেই এই ছবিতে। ইরফান সাহেব যেভাবে চলেছে, যেভাবে কথা বলেছে তার কোনো ছাপই আমাদের হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে নেই। হুমায়ূন আহমেদ নামে এই ছবিটার এত প্রচার হয়েছে যে, সামান্য যে দর্শক আসছে সেটা তারই ফসল। শো শেষে তারই প্রমাণ পেলাম ভার্সিটির এক তরুণের কথা শুনে। সেই তরুণ তার পাশের বন্ধুকে বলছে ওই বেটা তুই কইলি হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়া ছবি, এখানে তো তার কিছুই দেখলাম না। সেই বন্ধু উত্তর দিল, ‘আরে দোস্ত আছিল, শাওন কমপ্লেইন দিয়া সেন্সার বোর্ড থেইকা কাটাইয়া দিছে।’

আসলে ফারুকী সাহেব হুমায়ূন সাহেবকে নিয়ে এই ছবি বানাননি তবে এই বিতর্ক ডুবকে বাঁচার শেষ আশায় অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে।

এই ছবিতে শট কেন নেয়া হচ্ছে বা সেই শটের তাৎপর্যইবা কি, কেন অনেক শট একই রকম ট্রলি করে নেয়া, কেন প্রতিটি চরিত্রকে অস্পষ্ট করে ধরা হচ্ছে এইসবের কোন তার্কিক বিচারে যাব না কারণ যে কোনো নির্মাতার ছবি মেকিংয়ের নিজস্ব একটা স্টাইল থাকে কিন্তু চলচ্চিত্রকে যেহেতু বৃহত্তর গণমাধ্যম বলা হয় সেহেতু প্রশ্ন থাকে এইভাবে ধরা শটে লোকজনের জন্যে কি সহজবোধ্য হয়েছে?

সিনেপল ফিল্ম সোসাইটির সদস্য থাকাকালীন বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের কল্যাণে বিশ্বের তাবৎ তাবৎ খ্যাতনামা পরিচালকের আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি দেখেছি, কিন্তু ছবির গল্পকে এত অবোধ্য করে তুলতে কাউকে দেখিনি। এই উপমহাদেশের বরেণ্য বিশ্বখ্যাত পরিচালক সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, মসিহ উদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, মোর্শেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ প্রমুখ গল্প যেটা বলতে চেয়েছে সেটা দর্শককে বুঝিয়ে ছেড়েছে কিন্তু এই ছবির এত কায়দার শট গল্পকে বা গল্পের চরিত্রকে দর্শককে বোঝাতে কোনো সহায়তা করেনি। যখন যেখানে ইচ্ছা হয়েছে গাড়িতে ছাদে ব্যলকনিতে সিঁড়িতে দেয়ালের পাশে, দরজার বাইরে থেকে অর্ধেক কেটে ছবি শুট করা হয়েছে।

অনেক আগে একটা গল্প পড়েছিলাম ছেলের আর্ট করা একটা ছবি দেখিয়ে ছেলের বাবা তার বন্ধুকে বলছে, এই দেখ আমার ছেলে কি সুন্দর একটা কুকুরের ছবি একেঁছে। ছেলে  তখন পাশ থেকে বলে- বাবা তুমি কি বোকা, ওটা কুকুর না ওটা তুমি। তোমার ছবি আমি এঁকেছি। এখন সেমিনারে বক্তারা নিজেকে বোদ্ধা শ্রেণিতে প্রবেশ করাবার জন্যে আপনার ছবির এমন প্রশংসাই করল যাতে আপনি মুখ টিপে হাসছেন আর বলছেন বেটা আমি কুকুরের ছবি আঁকিনি। কি কারণে, কোন প্রেক্ষাপটে ছবির প্রশংসাসূচক মন্তব্য করছেন বিদগ্ধজনেরা তার কারণ খুঁজতে অনেক বেগ পেতে হবে। পোস্টারে এবং পেপারে ফলাও করে সেই প্রশংসার জোয়ারে না ভেসে জনগণের দেয়া পুরস্কারে নিজেকে সম্মানিত করাই শ্রেয়।

এই ছবির প্রায় সব চরিত্রই মনে হয় ধোঁয়াশা, কোনো রহস্যজনক ছবির চরিত্র। ক্যামেরায় তাদের অস্পষ্ট ধারণ একটা রহস্যে মায়াজাল সৃষ্টি করে রেখেছে।  একমাত্র তিশার চরিত্র ছাড়া সব চরিত্রই অপূর্ণ। এই ছবির সব শিল্পী খুবই দক্ষ এবং আমার খুবই প্রিয়। রোকেয়া প্রাচী, ইরফার খান তো অভিনয়ের শিরোমনি আর আছে তিশা। যার অভিনয় দেখে আমার কোনোদিনই মনে হয়নি সে অভিনয় করছে এটা এই জন্যে হতে পারে যে আমি তার অভিনয়ের একজন দারুণ ভক্ত।

ফারুকি একজন বড় মাপের পরিচালক। আমরা ছবির গল্প পুরোটা না বুঝলেও তিনি পুরোটা বুঝেই এই চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। চিন্তা ভাবনার সংমিশ্রণ করে ছবির শট নিয়েছেন। ছবির চিত্রধারণ, সংগীত, আবহ সংগীত, লোকেশন এবং মেকিং খুবই ভালো কিন্তু এই ভালোটা আমাদের বুঝিয়ে, সাধারণ মানুষদের জন্যে সহজবোধ্য করে নির্মাণ করলে কি দোষটা ছিল। আমি বুঝতে পারি না যে সৃষ্টি পাঁচ থেকে দশ ভাগ লোকের বাহবা কুড়ায়, নব্বই ভাগ লোককে সাথে নেয় না সেই সৃষ্টির দরকার কি। আপনারা যারা ভালো ছবি বানান তারা নিজেরা বিখ্যাত নাইবা হলেন, সাধারণ মানুষেরা আমাদের বিখ্যাত করে দিক।

আপনারা যারা ভালো মেকার যদি বিনোদন প্রিয় মানুষের জন্যে ছবি বানাতেন তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই দেশে ভালো ছবি হয় না এই আক্ষেপ জনগণের  মন থেকে দূর হয়ে যেত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি যে কোনো বিদেশি ইন্ডাস্ট্রির সমকক্ষ হয়ে উঠত।



লেখক: চিত্রপরিচালক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী চিত্রনাট্যকার



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ অক্টোবর ২০১৭/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়