ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য

মো. আসাদুজ্জামান আসাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য

মো. আসাদুজ্জামান আসাদ: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাংলার ইতিহাসে বিস্ময়কর এবং গৌরবময় ঘটনাগুলোর একটি। কারণ এই মামলা কেন্দ্র করে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থানের সৃষ্টি। মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং আন্দোলনের তীব্রতায় ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। যদিও প্রকৃতপক্ষে এই নামে কোনো মামলা ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার মামলাটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল কিন্তু মামলার নথিতে এর নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’।

পাকিস্তান সরকারের ভাষায় ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৬৮ সালে ৬ জানুয়ারি, ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। একই অভিযোগে নিরাপত্তা আইনে ১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে জেলে আটককৃত শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ১৭ জানুয়ারি পুনরায় গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। মামলাটি দায়ের করার আগে ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদ্রোহে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয় এবং সরকারি তথ্যমতে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, রাজনৈতিক এবং সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্য থেকে ৩৫ জনকে অসামী করে তাদের বিরুদ্ধে ১০০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে সরকার। শেখ মুজিবকে করা হয় ১ নম্বর আসামী। বাকি ৩৪ আসামীর সবাই ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্য।

যদিও সরকারি অভিযোগ নামায় ১৯৬৪ সালে বিদ্রোহের সূত্রপাত এবং ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সর্বশেষ বৈঠকের কথা উল্লেখ ছিল। তবে বিভিন্ন তথ্যমতে ১৯৬৮ সালে মামলা শুরু হওয়ার প্রায় ১২ বছর পূর্বে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন দক্ষ মেধাবী অফিসার ও কর্মী, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য এবং পূর্ববাংলার উপর নানা ধরনের নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং ‘বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মামলাটির ২৬ নম্বর অভিযুক্ত সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী এম.পি এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট দিন, নির্দিষ্ট সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো ক্যান্টনমেন্ট সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে একসাথে দখল করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করার। পাকিস্তান সরকারও তাদের অভিযোগ নামায় উল্লেখ করে যে, অভিযুক্তরা ভারত সরকারের অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্য নিয়ে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে পূর্ব-পাকিস্তানকে বিছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এই অভিযোগের মাধ্যমে তারা সশস্ত্র বিপ্লবটিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়। তবে প্রথম থেকেই অভিযুক্তগণ তাদের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি মেনে নিতে রাজি হননি। তারা বিদ্রোহ শব্দটিকে গৌরবজনক মনে করতেন। যদিও এই বিদ্রোহ পূর্ণতা পায়নি তবুও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর স্বাধীনতার পশ্নে এটা ছিল বড় মাপের আরেকটা বিদ্রোহ।

১৯৬৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বিদ্রোহীরা গোপন বৈঠকে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই দিনটিকেই বিদ্রোহ সংগঠনের সময় নির্ধারণ করেছিল। তবে সরকার বিদ্রোহের বিষয়টি আগে থেকে আঁচ করতে পেরে ঐ দিন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। মামলার তৃতীয় সাক্ষী বিপ্লবী পরিষদের ঢাকা অফিসের কোষাধ্যক্ষ এক্সকর্পোরাল আমির হোসেন মিয়া ১৯৬৭ সালে অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা অফিসে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ সংক্রান্ত তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ঠিকানাসহ ৬৩ পৃষ্ঠার বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ বিবৃতি দেয়। ফলে পলাশী যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার দুইশ বছর পর সেই সূর্য উকিঁ দিয়ে আবারও বাংলার ভাগ্যাকাশ থেকে অস্তমিত হয়ে যায় আমির হোসেনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। তার বিশ্বাস ভঙ্গের সূত্র ধরেই এই মামলার সূচনা হয়। বিপ্লবী পরিষদের সদস্যরা বিপ্লবের জন্য সংগৃহীত অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগে তাকে সংগঠন থেকে পূর্বেই বহিষ্কার করেছিলেন। অনেকের অভিমত প্রতিশোধ নিতে এবং পাকিস্তান সরকারের বিপুল অর্থের লোভে তিনি এ কাজটি করেছেন।

বিদ্রোহীরা নিশ্চিত ছিল যে, বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার সাথে সাথে নির্যাতিত, নিপীড়িত পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর জনগণ বিদ্রোহের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাবে। কারণ তাদের সাথে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সমর্থন রয়েছে। এক তথ্যমতে নূন্যতম ৮ জন রাজনৈতিক ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এই বিদ্রোহের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। যদিও মামলায় উল্লেখ করা হয় বিদ্রোহীদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান তিন বার বৈঠক করেছিলেন। বিদ্রোহীরা কর্নেল ওসমানীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও মৌন সম্মতি দিয়ে  ছয়টি রেজিমেন্ট থেকে দশটি রেজিমেন্ট গঠন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। মাওলানা ভাসানী ও কমরেড মোজাফফর আহমদের সাথে যোগাযোগ করলে দুই নেতাই সতর্কতার সাথে বিপ্লব সংগঠিত করার পক্ষে মত দেন। বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম আয়ুব খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর বিদ্রোহীরা তার সাথে দেখা করলে তিনি বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের সাফল্য কামনা করেন।

১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেয়। ১৯ জুন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়। সংশোধিত ফৌজদারি আইন অধ্যাদেশের ইউ/এস-৫ ধারা মতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই মামলার ভাষ্য আদালতে উপস্থাপন কর হয়।ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এস. এ. রহমান এবং তার সহযোগী ছিলেন এম. আর. খান ও মুসসুলুম হাকিম। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান কৌসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান। তবে একটি সেকশনের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে আনা হয়েছিল।



সরকার তাদের পক্ষে দুইশ সাক্ষীর নাম মূদ্রিতভাবে প্রকাশ করে। এদের মধ্যে ১১ জন সাক্ষী কোন না কোনভাবে বিদ্রোহ প্রচেষ্ঠার সাথে জড়িত ছিল। এগারো জনের মধ্যে আবার তিন জন সরকারের পক্ষে সাক্ষী দিতে আদালতে দাঁড়িয়ে বৈরী সাক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিন জনের অন্যতম কামাল উদ্দিনের সাক্ষ্য মামলাটিকে দুর্বল করে দেয়। এ সময় তৎকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অভিযুক্তরা তাদের নির্দোষ বলে মিথ্যা দাবি করেন।মামলার একজন অভিযুক্ত তৎকালীন ক্যাপ্টেন শওকত আলী ২০১১ সালে তার স্বরচিত ‘সত্য মামলা আগরতলা’ বইয়ে মিথ্যা দাবির ব্যাখ্যা দিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন: ‘সেই সময় যদি স্বীকার করতাম এই বিদ্রোহের সাথে আমরা জড়িত, তাহলে মুজিব ভাইসহ আমাদের ৩৫ জনেরই নিশ্চিত ফাঁসি হয়ে যেত! তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমরা সকলেই বলেছি যে, আমাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা। যদিও অভিযোগটি সত্য ছিল।’

বন্দীদের মুক্তির দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মাওলানা ভাসানী ঢাকার রাজপথে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেইসাথে জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ সুনামির শক্তি নিয়ে মানুষের মাঝে নতুন চেতনার স্ফুরণ ঘটায়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শেষের দিকে প্রায় প্রতিদিনই লাশ নিয়ে মিছিল হয় এবং পুরনো পল্টন ময়দানে পুলিশের গুলিতে নিহত লাশ সম্মুখে রেখে লক্ষ লক্ষ আন্দোলনকারী জানাজায় অংশগ্রহণ করে। বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ১৭নং অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১১নং অভিযুক্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে কারাগারের ভেতরে গুলি করা হয়। পরে তাদের সিএমএইচ-এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেসময় সেখানে কর্মরত প্রয়াত ডা. এম. এম আলীর বর্ণনা ছিল এমন: ‘দুজনের অবস্থাই ছিল সঙ্কটাপন্ন। তাই জরুরিভিত্তিতে তাদের অপারেশন করানোর প্রয়োজন ছিল কিন্তু তার একার পক্ষে দুটি অপারেশন একসাথে করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সেখানে প্রয়োজনীয় সুবিধাও ছিল না। তাই তিনি কর্তৃপক্ষকে একজনকে অন্য কোথাও অপারেশনের ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দেয় এটা সম্ভব নয়, যা করতে হয় এখানেই করতে হবে। তিনি প্রথমে ফজলুল হকের কাছে গেলে সে সার্জেন্ট জহুরুল হককে প্রথমে অপারেশনের কথা বলেন। জহুরুল হকের কাছে গেলে সে ফজলুল হককে প্রথমে অপারেশনের করতে বলেন।’

বিদ্রোহীদের মনোবল এতই দৃঢ় ছিল যে, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তারা বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফজলুল হক ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুদ্ধ জনতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও অন্যান্য ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। অতিথি ভবনে অবস্থানরত ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি এস.এ. রহমান এবং সরকারের প্রধান কৌসুলী মঞ্জুর কাদের পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন।এই মামলাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে  ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান। স্লোগান ওঠে ‘কারার প্রাচীর ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদ, ২৪ জানুয়ারি মতিউর এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন। এই অভ্যূত্থানে সমগ্র বাংলাদেশে প্রায় ৫৮ জন দেশপ্রেমিক বাঙালি শহীদ এবং শত শত মানুষ আহত হন। পাকিস্তান সরকার জনরোষ থেকে বাঁচতে মামলার ১নং অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধুসহ বাকি ৩৩ অভিযুক্তকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ তৎকালীন রের্সকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় সমবেত জনতার পক্ষ থেকে  শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেইদিন থেকে টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া খোকা, খোকা থেকে শেখ মুজিব হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। বর্তমান প্রজন্ম এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও ভাষা আন্দোলন এবং ৬৬-এর ৬ দফার পর বীরত্বগাঁথা হিসেবে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থানের কথা বলে। কিন্তু ঊনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থানের যে বিদ্রোহ থেকে সূত্রপাত তার কথা কেউ উল্লেখ করে না।

এই মামলার অভিযুক্ত প্রত্যেকের পরিবারকে সে সময় অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই তার পিতার সাথে দেখা করতে যেতেন। একসময় শেখ মুজিবকে সরকার প্যারলে মুক্তি দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শেখ হাসিনার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে খবর পাঠিয়ে মুক্তি নিতে বারণ করেন। তিনি সেদিন শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘তোর বাবাকে গিয়ে বল সে যেন প্যারলে না যায়। সে প্যারলে গেলে বাকী অভিযুক্তদের স্ত্রীরা বিধবা হবে।’ আরেক অভিযুক্ত কর্নেল শওকত আলীর স্ত্রী মাজেদা শওকত সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট-এ থাকি। হঠাৎ আমার স্বামীর স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন দেখতে পাই। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে আমাকে বিদ্রোহের পরিকল্পনার কথা জানায় এবং বলে দেখ তোমার বাবুর মতো অনেক বাবুর বাবা থাকে না! তোমার মতো অনেক মেয়েই বিধবা থাকে! তারপরও দেশকে ভালোবাসতে হবে। দেশের জন্য জীবন দিতে হবে। এ কথা শুনে আমি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। পরে আস্তে আস্তে নিজেকে কঠিন করেছি।’

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেও এই মামলার অভিযুক্ত সকলকে টার্গেট করে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ২নং অভিযুক্ত কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালবেলা তার বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ক্যাপ্টেন শওকত আলীর খোঁজে ২৭ মার্চ যশোরে তার কর্মস্থল কার্পেটিং জুটমিলে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে এক দারোয়ানকে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী বরাবরই দাবি করেছিল যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতীয় মদদে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৩ সালে গোপনে আগরতলায় গিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সাথে দেখা করে তার মাধ্যমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তার এই যোগাযোগের সাথে আলোচিত বিদ্রোহের কোনো সূত্র ছিল কিনা তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটা ঠিক যে, এই যোগাযোগের সূত্র ধরেই তৎকালীন সরকার মামলাটিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছিল। অভিযুক্তদের সাথে যদি বঙ্গবন্ধুকে আসামী করা না হতো তাহলে সকলকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করায় এই মামলা দ্রুত রাজনৈতিক দিকে  মোড় নেয় এবং তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে।

আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই রাজনৈতিক সশস্ত্র বিপ্লব প্রচেষ্টার কাহিনী ক্রমান্বয়ে আলোর বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যূত্থান দিবস পালন করি কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই দিবস তাকে অবহেলা করে চলছি প্রতিনিয়ত! এই মামলা আমাদের দেশের গৌরবের অনিবার্য ইতিহাস। তাই সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের সূত্র ধরে বলতে চাই, জনগণের সাথে সম্পর্কিত বা বিচ্ছিন্ন কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনার সাথে ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। সময় নেয়, ভিন্নতা দেখা দেয় কিন্তু সত্যের উজ্জ্বলতা বিকাশ লাভ করতে বাধ্য। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা বা ব্যক্তির অবদান অস্বীকার করার শক্তি কারোর নেই। পয়ত্রিশ অভিযুক্তের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৬ জন বেঁচে আছেন। তাই আমাদের উচিত এই মামলার অভিযুক্তদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করার পাশাপাশি জাতির এই গৌরবময় ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরা।

লেখক: সংগঠক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়