ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ঈদ এলেও আনন্দ নেই উপকূলে

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৯ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদ এলেও আনন্দ নেই উপকূলে

জুনাইদ আল হাবিব : ‘স্যার, আঙ্গোরে এ ঈদে স্যুট দিবেন? গাঙ্গে সব ভাইঙ্গা নিয়া গেছে। অন আরেকজন আঙ্গোরে তার বাড়িতে এক্কানা জাগা দিছে। আর আব্বা নাই। মা পারবে না, ক’দিন ধইরা অসুখ মা’র।’

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর কালকিনির মেঘনাতীর দিয়ে হাঁটলে এগিয়ে আসে সাত বছর বয়সী এক শিশু। মুহূতেই কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই ওর মুখ থেকে ভেসে আসলো শব্দগুলো। নাম কী তোমার? ‘সবুজ’। কী করো, বাড়ি কই? ‘মানুষের কোনো কাজ-টাজ পাইলে করি, আর ঘুরাঘুরি করি। ওই যে (তর্জনী উঁচিয়ে) ঘরটা আঙ্গো।’

ওর দাবি, গত রমজান ঈদে ‘আলোকযাত্রা-কোস্টাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’ টিম থেকে মেঘনাপাড়ের শিশুদের ঈদবস্ত্র দিয়েছে। ওর গায়ে থাকা জামাটি সে সময়কার বলে জানায় সবুজ। এ কোরবানির ঈদে কেউ এখন পর্যন্ত ওদের জন্য ঈদবস্ত্র নিয়ে আসেনি। সবুজের ঈদটা হয়তো গত ঈদের মতো কাটবে না। এজন্যই সবুজের আকুতি, এ ঈদে নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করার জন্য।

আরেকটু হাঁটলে দেখা ওর সমবয়সী শিশু সানজিদার সঙ্গে। ওর গল্পটাও ঠিক সবুজের মতো। নদীভাঙনে নিঃস্ব ওর পরিবার। মেঘনাপাড়ে ঘুরে ঘুরে সানজিদা জ্বালানি খুঁজছে। এ খুঁজাতেই লাভ তার। যত বেশি জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে, তত বেশি টাকা পাবে সানজিদা। ঈদের পোশাক কিনেছ? এ প্রশ্নে সানজিদা মলিন মুখে বললো, ‘না না এখনো কিনিনি। কিভাবে কিনবো? দেখেন না, এগুলো টোগাই টোগাই বেচমু। পরে পেটকে ভাত দিতে হবে। খাইতে ঠিকমতো কষ্ট বাজি যা, আবার নতুন স্যুট? কোথায় পাবো?’

চর মার্টিনের কিশোর নিরব। ভাঙনের পর অন্যের বাড়িতে আশ্রয় মিললেও স্কুল ফেরা হয়নি তার। খড়-কুটার বেষ্টনী দিয়ে ওদের ঘর। ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘরের ভাঙা দৃশ্য চোখে ভেসে আসলো। সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা সব একাই বইতে হয় নিরবের মা আয়েশা আক্তারকে। চিন্তায় থাকেন কখন নিরবের মুখে দু’মুঠো ভাত দিবেন। বিলাসিতার কথা চিন্তাও করা কঠিন এ সংসারের পক্ষে।

চর মার্টিনের বলিরপোল বাজারের একটু দক্ষিণের শাকিল। শাকিলও ওর কাঁধের বয়সের। কখনো রিকশা, কখনো ট্রাক্টরে জমি চাষাবাদ করে ও। রাস্তার পাশেই থাকে তারা। ভিটে-মাটি কিনে বাড়ি-ঘর করার স্বপ্ন দেখতে সাহস পায় না তারা। স্কুলে ক’দিন পড়তেও গিয়েছিল শাকিল। কিন্তু ওর কপাল ফিরলো না। খাতা-কলম ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী কেনার সামর্থ্য না থাকায় পড়ালেখা থেকে ছিটকে পড়তে হয় তাকে। এখন পর্যন্ত স্কুল ফেরা হয়নি শাকিলের। ঈদের নতুন পোশাক পাওয়া না পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় দিনগুলো কাটছে তার।

এমন বাস্তবতা দ্বীপ রমনী মোহনেও। এই চরের অনেক শিশু কখনো স্কুলের বারান্দায় পা রাখেনি।  দলবেঁধে ওরা নানা প্রজাতির মাছ ধরছে। কাদা মাটি ওদের সবার গায়ে লেগে আছে। এখন ওদের কাজই এটা। কিছু মাছ ধরতে পারলে অন্তত মতিরহাট ঘাটে নিয়ে বিক্রি করে টুকটাক বাজার সদাই করা যাবে।

অনেকের গায়েই কোনো পোশাক চোখে পড়েনি। যে ক’জনের পরনে জামা দেখা গেল, তাদের কারো জামা ছেঁড়া, কারো পুরোনো। ওদের মধ্যে রিয়াজ, শিহাব, রহিমসহ অনেকেই বললো, তাদের ঈদে নতুন পোশাক প্রয়োজন।

ওদের অভিভাবকরা বললেন, ‘কিভাবে হোলাহাইনরে ঈদের কাপড়-চোপড় দিমু? এই চরে এমনে বাঁচা দায়। গাঙ্গে না ভাঙলে এখানে কি থাকতাম? অসুখ-বিসুখ হলে ঠিকমতো চিকিৎসা পাইনা। আগেতো বাঁচতে হবে। আমাগো খবর কে লয়? এখানে আছি, না মরি গেছি কেউতো এক্কানা খবরও নিবে না। ভোটের সময় আসে ভোট দিতাম। এরপরে আর আমরা মানুষের কাতারেও থাকিনা।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়