ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অটুট থাকুক জেলের হাসি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ১৭ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অটুট থাকুক জেলের হাসি

রফিকুল ইসলাম মন্টু: জালভর্তি ইলিশ ধরা পড়লে জেলের মুখে হাসি ফোটে। জেলেপাড়ায় বয়ে যায় আনন্দ। জেলে স্বপ্ন দেখে নতুন কিছু করার। সংবাদ মাধ্যমে বড় শিরোনাম হয়। কিন্তু মাছ না পড়লে তাদের মুখ মলিন হয়। মৌসুম শেষের লোকসান দেখে হতাশ হয় জেলেরা। এবারের বর্ষায় প্রধান ইলিশ মৌসুমে দুটো চিত্রই দেখা গেছে। ইলিশ আহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবার একেবারেই মাছ পড়েনি এমন সময়ও গেছে; আবার অনেক বেশি মাছ পড়েছে, এমন সময়ও গেছে। তবে মাছ পড়ার সময়টা খুবই কম- মাত্র ১০-১২ দিন। গোটা মৌসুম মোটামুটি মাছ পড়লে জেলেরা পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সারা মৌসুম না পড়ে মাত্র কয়েকদিন মাছ পড়াতে জেলেরা ততটা লাভবান হতে পারেননি। আবার সব স্থানে সমানভাবে মাছও পড়েনি। চরফ্যাসনের ঢালচরের নিচের দিকে সমুদ্র মোহনায় কিছু মাছ পাওয়া গেলেও মেঘনার অধিকাংশ স্থানে ইলিশ পড়েনি।

নিষিদ্ধ সময়ে জেলেরা পরের মৌসুমের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকেন। ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার দক্ষিণে রিজির খাল মাছঘাট সরেজমিন ঘুরে দেখি, বহু জেলে প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। প্রায় সকলের হাতে জাল মেরামতের কাজ। বাঁধের ওপর স্তুপ করে রাখা হয়েছে জালসহ মাছধরার অন্যান্য উপকরণ। শুকনো খালে মাছধরার ট্রলার তুলে রাখা হয়েছে। জালের কাজ শেষ হলে জেলেরা ট্রলার মেরামতে নামবেন। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সামনের ২৯ অক্টোবর থেকে তাদের মাছ ধরার প্রস্তুতি। এখানেই আলাপ হলো কয়েকজনের সঙ্গে। শফিউল্লাহ, নিজাম উদ্দিন, সাইফুল্লাহসহ আরও অনেকে জানালেন, এবার জেলেরা ভালো নেই। মাছধরা মৌসুম শেষ হওয়ার সাতদিন পরে তারা এখন আবার সেই ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ অবস্থায় চলে গেছেন। কঠোর পরিশ্রমে মাছ ধরে কোনো মৌসুমেই তারা বাড়তি সঞ্চয় করতে পারেন না। এবারের অবস্থা আরও খারাপ।

ইলিশ আহরণের জন্য খ্যাত এলাকা হিসাবে পরিচিত চরফ্যাসনের ঢালচরের আনন্দবাজার এলাকায় হাঁটছিলাম। তখন প্রধান ইলিশ ধরার মৌসুম কেবল শেষ হয়েছে। ইলিশ ট্রলারের একজন ভাগী শফিক ফরাজীর সঙ্গে দেখা। ঘারের ওপর একটি ভারি বস্তা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আলাপে জানা গেল, প্রধান ইলিশ ধরার মৌসুমের চার মাস নদীতে থেকে ৭০ হাজার টাকা ভাগে পেয়েছেন। এ টাকার অধিকাংশ আবার আগাম নেওয়া হয়েছিল। তার মানে এখন আর খুব বেশি টাকা অবশিষ্ট নেই। খানিক দূরে আবদুর রশিদ কানু আর খলিলুর রহমানের সঙ্গে দেখা। এরা মাঝি। মাছধরা ট্রলারের মালিক। আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নিয়ে এরা ট্রলার গড়েন, জাল কেনেন। সাধারণ জেলে অর্থাৎ ভাগীদের থেকে এদের অবস্থান একটু ওপরে। এবারে ইলিশ মৌসুমে তাদের দৈন্যের কথা জানালেন দু’জনই।
 


এবার ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারির পূর্বমুহূর্তে জেলেরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলেছেন। তারা বলেছেন, প্রতি বছর পূর্নিমা সামনে রেখে মা-ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়- এবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। এবার অমাবস্যা সামনে রেখে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জেলেদের দাবি, ইলিশ সাধারণত পূর্নিমায় ডিম ছাড়ে। সেক্ষেত্রে আর ৭ থেকে ১০ দিন পরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে জেলেরা আরও কিছু মাছ পেয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতেন। নিষেধাজ্ঞা শুরুর একদিন আগে ৬ অক্টোবর কয়েকজন জেলে আমাকে নিয়ে যান মাছের আড়তে। সেখানে অন্তত ২০০ ইলিশ ধরে দেখান, এগুলোর পেটে এখনও ডিম আসেনি। তার মানে একদিন পর থেকে এইসব ইলিশ ডিম ছাড়বে- এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং ওই ডিম পরিপক্ক হতে আরও অন্তত ১০-১৫ দিন সময় লাগবে। বিশেজ্ঞদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান নেই জেলের। তারা বাস্তবটা দেখাতে পারেন মাত্র। আমাকে দেখালেন, কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই। মা-ইলিশ রক্ষা করে ইলিশের বংশ বাড়ানোর সঙ্গে তো মৎস্যজীবীদের জীবনটাও জড়িত! সুতরাং ইলিশ রক্ষার কোন উদ্যোগেই আপত্তি নেই জেলেদের। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জেলেদের স্বার্থটাও বিবেচনা করতে হবে।

উপকূলের বহু জেলের সঙ্গে আলাপে জানতে পারি, এ অঞ্চলের জেলেরা প্রতিনিয়ত হাজারো সংকটের শিকার। প্রাকৃতিক বিপদ ক্রমেই বাড়ছে। আছে দস্যুদের আক্রমণ। সব সমস্যা কাটিয়ে জেলেরা যখন মাছের দিকে চোখ রাখেন, সেখানে দেখতে পান মাছশূন্যতা। অস্বাভাবিকভাবে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে মৎস্যজীবীদের জীবনজীবিকায়। এর ওপর আবার দাদনদারের অত্যাচার সইতে হয়। তবে সেসব আলোচনা আজকের বিষয় নয়। আজকের আলোচনা মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। কারণ এই নিষেধাজ্ঞা ঘিরে বছরের বিভিন্ন সময়ে মৎস্যজীদের জীবনে বহুমূখী সংকট নেমে আসে। বছরের অন্যান্য সময়ের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে আরও সাতদিন নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকট যে আরও খানিক বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

উপকূল অঞ্চলে মাছধরায় নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ের কথা আমি জানি। মাছধরা বন্ধ থাকার সময়ে মাছঘাট, জেলেপল্লীসহ উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে দেখেছি মৎস্যজীবীদের মলিন মুখ। কর্মব্যস্ত মানুষগুলো হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকেন। ধারদেনা করে চলেন। অনেকে আবার কাজের সন্ধানে ছুটে যান শহরের দিকে। বছরে এমন অবরোধের সময় দু’বার আসে। প্রথমটি আসে দু’মাসের জন্য। শুরু হয় পহেলা মার্চ থেকে। শেষ হয় ৩০ এপ্রিল। এসময় জাটকা ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ দিতে মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। আরেকটি অবরোধ ছিল অক্টোবরের ২৫ তারিখ থেকে নভেম্বরের ১০ তারিখ সময়কালে ১৫ দিনের জন্য। এটি এখন ১৫ থেকে ২২দিনে উন্নীত হয়েছে। এবং সময়কাল পিছিয়ে আনা হয়েছে অক্টোবরের ৭ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত। অবরোধকালে মৎস্যজীবীদের জন্য সরকার থেকে বরাদ্দ থাকে। কিন্তু মাঠের তথ্যসূত্র বলছে, খুবই সীমিত সংখ্যক মৎস্যজীবী এই সহায়তা পাচ্ছেন। সহায়তাপ্রাপ্ত মৎস্যজীবীর সংখ্যা মোট মৎস্যজীবীর মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি নয়। দুই দফায় ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞায় সরকারি সহায়তার চিত্র যেখানে এতটা হতাশার, সেখানে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বৃদ্ধির ফলে তাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে দেখা জরুরি।

ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জেলেদের কাছ থেকে কখনোই কোন আপত্তি আসেনি। তবে সঠিক সময়ে মা-ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি তাদের। জেলেদের একটি পক্ষ বলছে, মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার সঠিক সময় নির্ধারণ করতে না পেরে নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়িয়ে জেলেদের ক্ষতিগ্রস্থ করা হচ্ছে। এই শ্রেণীর জেলের মতে, অক্টোবরের বড় পূর্ণিমার জো-তে মা ইলিশ তিনদিনের মধ্যেই ডিম ছাড়ে। পূর্ণিমার আগের দিন, পূর্ণিমার দিন ও পূর্ণিমার পরের দিন। এই জো সামনে রেখে মা ইলিশ গভীর সমুদ্র থেকে উঠে এসে মেঘনা নদীতে ডিম ছাড়ে। সে ক্ষেত্রে পূর্ণিমা সামনে রেখে আগে-পরে সাতদিন মাছধরা নিষিদ্ধ করলেই যথেষ্ট ছিল। এতে মৎস্যজীবীরা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির মুখোমুখি হত। আবার অনেক মৎস্য ব্যবসায়ীর দাবি, শীতল কক্ষে বসে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে মৎস্যজীবী ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের তো ক্ষতিগ্রস্থ করাই হচ্ছে, সেই সঙ্গে আমাদের দেশের মাছ অন্য দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। তবে যে সমালোচনাই থাকুক না কেন, ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সুফল যে মৎস্যজীবীরা পান, সে বিষয়ে তাদের কোন সন্দেহ নেই। তবে মাছধরা ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বাস্তবসম্মত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবি তাদের।
 


আমাদের দেশে ইলিশ রক্ষায় বর্তমানে দুটো বড় উদ্যোগ চোখে পড়ে। একটি মার্চ-এপ্রিলে জাটকা মৌসুমে, অপরটি অক্টোবর-নভেম্বরে প্রজনন মৌসুমে। এর বাইরেও ইলিশ রক্ষায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনও তেমন কোন কাজ হচ্ছে না। মার্চ-এপ্রিলে ইলিশের পোনা মোটামুটি খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়। তখন বড় হওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তার আগে কিংবা ডিম ছাড়ার পরে ইলিশ রক্ষায় কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অক্টোবর-নভেম্বরে ইলিশের ডিম ছাড়া হয়ে গেলে ডিসেম্বর থেকে ইলিশ পোনা বড় হতে শুরু করে। কিন্তু এই সময়ে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় দুই ধরণের জাল অন্যান্য মাছের পোনার সঙ্গে ইলিশের পোনাও মেরে ফেলছে। লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার, মতিরহাট, ভোলার মির্জাকালু, মনপুরায় মেঘনা নদীর মোহনায় এমন হাজার হাজার জাল ইলিশ পোনা ধ্বংস করছে। নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দুই ধরনের জাল শুধু ইলিশ নয়, মাছের বংশই ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর একটি হচ্ছে বিহুন্দি জাল, অপরটি মশারি বেড় জাল। গভীর স্রোতের মুখে বিহুন্দি জাল আর নদীর মোহনায় বেড় জাল পাতা হয়। উত্তাল সময় আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এই তিনমাস বাদে অন্য সময়গুলোতে এই জাল পাতা অব্যাহত থাকে। নিষিদ্ধ এই জাল উপকূলের মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করলেও এর বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, সে প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুধুমাত্র বিহুন্দি আর বেড় জাল বন্ধ করা গেলে উপকূলে মাছ ধরে শেষ করা যাবে না। শুধু মাছের পোনা বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

পক্ষে-বিপক্ষে যে মতামতই থাকুক না কেন, ইলিশ সংরক্ষণে সব ধরণের ব্যবস্থাই নিতে হবে। রূপালি সম্পদ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সরকারি উদ্যোগের পাশে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। কিন্তু সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষগুলোকে বাঁচতে দিন। তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ দিন। সেইসঙ্গে আইন ভঙ্গ করে নিষিদ্ধ জালে মাছের পোনা নিধনকারীদের বিরুদ্ধে নিন কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। প্রকৃত জেলেরা বাঁচুক। তাদের মুখের হাসি অটুট থাকুক।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়