ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বনে বাঘ ঘরে ঋণ, বারোমাস দীর্ঘশ্বাস

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ২১ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বনে বাঘ ঘরে ঋণ, বারোমাস দীর্ঘশ্বাস

রফিকুল ইসলাম মন্টু: ‘কাল তো আবার মিটিং! কই যে টাকা পাবো? কার কাছে টাকা চাইবো?’- সন্ধ্যার পর রাস্তার ধারে আলো-আঁধারিতে নারী কণ্ঠে কষ্ট জড়ানো উচ্চারণ। কথায় বোঝা গেল কিস্তির টাকা দেয়ার কষ্ট। আয়-রোজগার নেই। তবুও কিস্তির টাকা গুনতে হয়। সুন্দরবন লাগোয়া মথুরাপুর জেলেগ্রামের পথ ধরে হাঁটার সময় কানে আসে এমন দীর্ঘশ্বাস।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের হরিনগরের একটি এলাকা মথুরাপুর। এখানে রয়েছে ৭৫টি পরিবার। যাদের পেশা সুন্দরবনে মাছ কিংবা কাঁকড়া ধরা। এভাবেই জীবন চলে এদের। ভিটেমাটি নেই। বাঁধের পাশেই ঘর। নানামূখী পরিবর্তনে বিপন্ন এদের জীবন। আয় রোজগার কমে গেছে। কিন্তু বিকল্প জীবিকায়নের পথ বের করা খুবই দুরূহ। সেই ছোটবেলা থেকে সুন্দরবনের পেশায় প্রশিক্ষিত এই মানুষেরা অন্য কোনো কাজ জানেন না। তাই সংকট আরও বেশি। দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে তারা অনেকেই ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা নেন। 

সকাল হতেই জেলেগ্রামে কিস্তির আদায়কারী এনজিও কর্মীর দেখা মেলে। সন্ধ্যায় দেখি আরেক এনজিও থেকে আরেকজনকে। এরপর রাতে পল্লীর ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনলাম ওই নারীর আগামীকাল কিস্তি দেয়ার তারিখ। ভাবনা এলো- এত ঋণ, এত সহায়তা! মানুষের অবস্থা বদলাচ্ছে কই? সুন্দরবন লাগোয়া এসব এলাকায় অসংখ্য এনজিও কার্যক্রম চোখে পড়ে। গাছের সঙ্গে, ঘরের চালায়, রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটিতে সাইনবোর্ড গুনে শেষ করা যায় না। মানুষের অবস্থা বদলের পরিমাপ কী আমরা করে দেখেছি, কতটা বদলালো তারা? মানুষের অবস্থার পরিবর্তন ঘটুক। কিস্তির নিঃশ্বাস পথিকের কানে না আসুক- এমন প্রত্যাশা সবার। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কী?
 


মথুরাপুরের মতই সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় বহু নিঃস্ব মানুষের বাস। সুন্দরবনকেন্দ্রিক পুরনো পেশায়, সেই বাপদাদার আমল থেকে। পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে সর্বত্র। সুন্দরবন আগের মতো নেই। অনেক ক্ষেত্রেই সুন্দরবনে জীবিকায়নের পথ রুদ্ধ। প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয় এই মানুষগুলো পেশায় ধাক্কা দিয়েছে। সুন্দরবনের আয় রোজগার দিয়ে যাদের জীবিকা নির্বাহ হতো; তাদের টিকে থাকা কঠিন। এ কারণে পেশাজীবীরা পাত পাতছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে। এক পরিবারে আছে ৫-৬টি পাশবই। প্রতিটি পাশ বইয়ের অনুকূলে সাপ্তাহিক কিস্তিতে টাকা জমা দিতে হয়। অনেকের কাছে এটা সংকট উত্তরণ নয়; বরং এটাকে এক অর্থে সংকট বাড়িয়ে তোলাই বলা যায়।

পরিমলচন্দ্র মণ্ডল। বয়স ৪০। প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে জীবিকার তাগিদে এখানে এসেছিলেন। বাবা কালিপদচন্দ্র মণ্ডলও একই পেশায়। একসময় তাদের ক্ষুদ্র মাছের ব্যবসা ছিল। পরে নিজেরাই মাছধরা শুরু করেন। আর জীবিকার ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেন সুন্দরবন। একখানা ছোট্ট নৌকা আর কিছু বড়শি তাদের সম্বল। রোজগারের সুবিধা অনুযায়ী পরিমল প্রথমে পোনা ধরা দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পরে জাল দিয়ে মাছধরা শুরু করেন। আর এখন মাছ ধরেন বড়শি দিয়ে। কিন্তু এখন রোজগারে ভাটা। আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না- জানালেন পরিমল। পাশ থেকে মিন্টু সানা, গোপাল মণ্ডল, নরেন সরদার যোগ করেন আরও কিছু সমস্যার কথা।

পরিমল মণ্ডলের নৌকায় আরেকজন ভাগীদার আছে। দু’জন মিলে মাছ ধরতে যান সুন্দরবনে। ফরেস্ট অফিস থেকে একবার পাস নিয়ে বনে অবস্থান করতে পারেন সপ্তাহখানেক। এই সময়ের সকল প্রস্তুতি নিয়ে যান তারা। খাবারের জন্য চালডাল, সদায়পাতি নিয়ে যেতে হয়। নৌকায় থাকে রান্নার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা। এক সপ্তাহে ১০-১৫ হাজার টাকার মাছ মেলে। কখনো এরচেয়েও কম পাওয়া যায়। কোনো মৌসুমে ভালো মাছ পড়ে, আবার কোনো মৌসুম একেবারেই মাছশূন্য থাকে। পরিমলের ভাষায়, এই পেশায় আসার আগে মাছের ব্যবসায় তার দিন ভালো ছিল। সংসার চালানো, তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। পরিমল মণ্ডলের অন্যত্র যাওয়ার কিংবা অন্য কাজে ফেরার আর কোনো উপায় নেই। তাই এখানেই সংকটের ভেতরে বাঁচার লড়াই। দিন চলছে ধারদেনা করে।
 


আরেকজন মিন্টুচন্দ্র সানা। বয়স ৫০। সেই ছোটবেলা থেকে বাবা বিষ্ণুপদ সানার সঙ্গে বনে মাছ ধরতে যাওয়া। এখনও সেই পেশায়। জীবনের বাকি ক’টা দিনও হয়তো কাটাতে হবে এই পেশায়। বাড়ি ছিল অন্যত্র, প্রতাপনগরের খুঁটিকাটায়। জীবিকার তাগিদে এসেছেন এখানে। বড়শি দিয়ে পোনা ধরা, মাছধরা এবং নেট দিয়ে পোনা ধরেন। পেশায় দু’ধরণের সমস্যা চিহ্নিত করলেন মিন্টু সানা। প্রথমত, বিভিন্ন ধরনের সরকারি বিধিনিষেধের কারণে বনে যাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক বিপদের কারণে পেশায় আয় রোজগার কম। তাই ধরদেনা করে চলতে হয়। প্রায় ৪০ হাজার টাকার মত দেনা তার।  এগুলো কীভাবে শোধ করবেন জানেন না। জেলেগ্রামের বাসিন্দারা ধারদেনা করে জোড়াতালি দিয়ে জীবনের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করছেন। এনজিওদের ঋণের পাশাপাশি আছে মহাজনী ঋণ। মহাজনী ঋণে ১০০০ টাকায় প্রতিমাসে ১০০ টাকা সুদ গুনতে হয়।

মথুরাপুরের বাসিন্দা গোপালচন্দ্র মণ্ডল জীবনে স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে বনে যান। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সংকটে দিন কাটছে। এমন আরও অনেকজনের সঙ্গে দেখা। সবার অবস্থাই একই রকম। নরেন সরদার প্রায় ৪৫ বছর ধরে মথুরাপুর জেলেগ্রামে বাস করেন। জীবিকা সুন্দরবনে। ছোটবেলা থেকে এই কাজে। জীবনে ৩-৪ বার বাঘের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আর দস্যুদের সঙ্গে দেখা হয় প্রতিমাসেই। বাঘের জন্য পকেটে কোনো টাকা রাখতে না হলেও দস্যুদের জন্য পকেটে অন্তত ৫০০ টাকা রাখতে হয়। দস্যু আস্তানায় বন্দি হলে গুনতে হয় মুক্তিপণ। আর তখনই স্থানীয় দাদনদারদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হয়। সুন্দরবন লাগোয়া শ্যামনগরের ঐতিহ্যবাহী হরিনগর বাজার থেকে কাছেই মথুরাপুর জেলেগ্রাম। এই বাজার থেকে সুন্দরবনের গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নদীর ধারে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামের ঠিক ওপাড়ে সুন্দরবন। বাজার থেকে মথুরাপুর জেলেগ্রামে পৌঁছার আগেই চোখে পড়ে ভাঙন। নদী ক্রমাগত ভাঙছে। বাসিন্দাদের সহায়তায় সম্প্রতি ভাঙন রোধে নদীতীরে পাইলিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে বাঁধের বাইরে এবং ভেতরের বাড়িগুলোর ভাঙনের ঝুঁকিমুক্ত হয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে আরও অনেক সমস্যা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, পয়ঃনিস্কাশন, বিশুদ্ধ পানি ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েই গেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস। এক ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘর একাকার হয়ে মিশে আছে। জীবিকার লড়াই যেখানে প্রধান এবং অনেক কঠিন, সেখানে নিত্যপ্রয়োজনের অন্য বিষয়গুলো দিকে নজর দেয়ার যেন সময় নেই কারও। পানি আনতে হয় দূর থেকে। অসুখে শ্যামনগর উপজেলা সদরের হাসপাতাল ভরসা।

শুধু বনে গেলেই যে বাঘের আক্রমণ হয়, তা নয়। বাঘ আসে মথুরাপুরে লোকালয়ে। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকবার এ এলাকা দিয়ে বাঘ ঢুকেছে লোকালয়ে। প্রাণও গেছে মানুষের। সে গল্পই শোনাচ্ছিলেন জেলেগ্রামের বাসিন্দা আশীষ কুমার মণ্ডল। গ্রামের অন্যান্য সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, এখানকার মানুষ আর্থিকভাবে খুবই সমস্যাগ্রস্ত। এছাড়াও অন্যান্য নাগরিক সমস্যা তো আছেই। ইদানিং বেসরকারি উদ্যোগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা উত্তরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই গ্রামের মানুষেরা টেকসই জীবিকায়ন চান, জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে চান। তিনি বলেন,  সরকারি-বেসরকারি সহায়তা এদের কাছে পৌঁছায় খুবই সামান্য। সরকারের সেবার তালিকায় এদের নাম ওঠে কালেভদ্রে।      

মথুরাপুর জেলেগ্রামের প্রবেশদ্বারে দুটি মন্দির। গ্রামে ঢোকার পথে সার্বজনীন পূজা মন্দিরের পাশে বনবিবি পূজা মন্দির। সাজানো গোছানো পাকা ভবন। অন্যান্য স্থানের মতো এই গ্রামেও আসে পূজাপার্বণ, উৎসব। বনবিবির পূজা হয় বছরে একবার। মুক্ত বাতাস, আঁকাবাঁকা নদী, বন, পাখির ডাক- সব আছে মথুরাপুরে। কিন্তু যেটা নেই, সেটা হচ্ছে আর্থিক নিরাপত্তা। তাইতো খাসজমিতে মাটির ঘরে বসবাস, আর ধারদেনা করে চলা। বনজীবী জেলেদের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয় মথুরাপুরের বাতাস। 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়