ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণ এবং আমরা

রিশিত খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২২, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরিবেশ দূষণ এবং আমরা

রিশিত খান : শব্দদূষণ রাজধানীসহ সারাদেশে নাগরিকদের জন্য বিরক্তিকর এবং মারাত্মক একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই দূষণের ফলে নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের এক কোটিরও বেশি লোক শব্দদূষণজনিত রোগে ভুগছে। শব্দদূষণে প্রতি হাজারে একজন বধির হয়ে জন্মায় এবং জন্মের পর আরও একজন বধির হয়ে যায়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ একটি শিশুকে বেড়ে ওঠার আগেই বধির হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাকে করে তুলছে অমনোযোগী ও বিকারগ্রস্ত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ সমস্যা এখন বৈশ্বিক সমস্যাও বলা যায়।

 

সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে পাঁচ বছর বয়সী ছয় লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত হয়ে যত শিশুর মৃত্যু হয়, এ সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।

 

ইউনিসেফের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৩০ কোটি শিশু এমন এলাকায় বাস করছে, যেখানকার বায়ু অত্যধিক দূষিত। এসব এলাকার বায়ু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত নিরাপদ সীমার ছয় গুণ বেশি দূষিত।

 

ইউনিসেফ কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বায়ু দূষিত এলাকার তথ্য এবং এসব এলাকায় বাস করা শিশুর সংখ্যাকে সমন্বয় করে গবেষণাটি করেছে। ডব্লিউএইচও নির্ধারিত সীমার ছয় গুণ বেশি মাত্রায় দূষিত এলাকায় যে ৩০ কোটি শিশু বাস করছে, তার মধ্যে ২২ কোটির বাস দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের সংখ্যা ভারতেই বেশি। আর সাত কোটি শিশু বাস করে পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষত চীনে।

 

এ গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ (২০০ কোটি) শিশু বাস করে এমন জায়গায়, যেখানে বাইরের বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। যানবাহনের দূষণ, জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার, ধুলা এবং বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া বাইরের দূষণের মূল কারণ। দক্ষিণ এশিয়ার ৬২ কোটি শিশু এমন পরিবেশে বাস করে। বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরের বায়ুদূষণের হার অনেক বেশি।

 

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, তারা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। এ ছাড়া শিশুদের ফুসফুসের কোষের স্তর দূষিত কণায় অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি ক্ষুদ্র দূষিত কণা মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের ঝিল্লি ভেদ করে। এতে শিশুর বুদ্ধির বিকাশে স্থায়ী ক্ষতি সাধিত হয়। এমনকি দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ভ্রূণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

২০১৪ সালের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯১টি দেশের ১ হাজার ৬০০টি শহরের মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। সংস্থাটি এ জরিপ চালায় ঘরে ও বাইরের দূষণের ওপর।

 

জরিপে বলা হয়, অতিদূষিত ২৫টি শহরের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের অবস্থান ১৭তম। গাজীপুর ২১ এবং ঢাকার অবস্থান ২৩তম। দিল্লি হচ্ছে সবচেয়ে দূষিত নগরী।

 

ঢাকায়ও শব্দদূষণ বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন ছাড়াও দ্রুত নগরায়নের ফলে যত্রতত্র শোনা যায় ইট, বালু, সিমেন্ট মেশানোর মেশিনের গড় গড় বিরক্তিকর শব্দ। শিল্প-কারখানার যান্ত্রিক শব্দ ছাড়াও বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার ও দোকানের উচ্চমাত্রার মিউজিক, মাইক, যানবাহন চলাচলের শব্দে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শব্দদূষণ।

 

অভিযোগ রয়েছে, মোটর যান ও মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশ ঠিক মতো মানা হচ্ছে না বলেই বেড়ে চলেছে শব্দদূষণের মাত্রা। বিশেষ করে শব্দদূষণ রোধে আইনের ধারাগুলো যেমন ‘বাংলাদেশ মোটরযান অধ্যাদেশ’ ১৯৯৭-তে বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক এলাকাগুলোর ১০০ মিটারের মধ্যে গাড়ির হর্ন বাজানো নিষেধ। এ আইনগুলো যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বলেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে ওই শব্দদূষণের মাত্রা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়।

 

রাজধানীতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে শব্দের গড় মাত্রা দৈনিক ৭৬ ডেসিবেল, নাবিস্কো মোড়ে ৮১ ডেসিবেল, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় ৮২ ডেসিবেল, ফার্মগেট পুলিশবক্স এলাকায় ৮৫ ডেসিবেল, নিউমার্কেট বলাকা সিনেমা হল এলাকায় ৮২ ডেসিবেল, শাপলা চত্বরে ৮৫ ডেসিবেল, শ্যামলী সিনেমা হল এলাকায় ৮০ ডেসিবেল এবং বাংলামোটর মোড়ে ৯০ ডেসিবেল। ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বলা হয়, ৩০ থেকে ৬৫ ডেসিবেল শব্দ নার্ভাসনেস এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, ৬৫ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ হৃদরোগ, ৯০ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ আলসার, শ্রবণে ব্যাঘাত, স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন এবং ১২০ ডেসিবলের বেশি শব্দে শ্রবণযন্ত্রে ব্যথা এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তিহীন করতে পারে।

 

এদিকে শব্দদূষণ বিধিমালায় আবাসিক এলাকায় ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন বা মিক্সার মেশিনের ব্যবহার সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘শব্দদূষণ : জনসচেতনা এবং করণীয়’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গাড়ির হর্ন এবং শব্দদূষণের ফলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা শহরের ৩৩টি স্কুলের ১৩ থেকে ১৯ বছরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, শব্দদূষণের ফলে ছাত্রদের মধ্যে বিরক্তিবোধ, মাথাধরা এবং মনোসংযোগ সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে তাদের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরক্তিবোধের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

 

সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনে তাদের মতামত তুলে ধরে বলা হয়, শব্দদূষণে হার্টের সমস্যা, ঘুমের অসুবিধা, শিশুর মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মোটর গাড়ির হর্ন, সংকেত কিংবা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের তথ্য মতে, শব্দদূষণ মানুষের স্নায়ুগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সব সময় এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ হতে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে টিনিটাস বলে। কানের যন্ত্র নিয়েও সে ভাল শুনতে পারে না। শুধু যে কানের সমস্যা হয়, তা নয়। এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের। হঠাৎ গাড়ির শব্দে তারা লাফিয়ে উঠছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারা মানসিকভাবে ভীতু হয়ে পড়ছে। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে মনোসংযোগের বিঘœ ঘটে। যার কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমাগত সব ধরনের উচ্চ শব্দই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।

 

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ শব্দদূষণের মাত্রা কোথায় কত তা জানেই না। এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানার প্রশ্নই ওঠে না। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও মফস্বল শহরগুলোতে শব্দদূষণের সমস্যা একই হারে দেখা বিদ্যমান। শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে। শব্দদূষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সচেতন হতে হবে সর্বাগ্রে। বাংলাদেশের গাড়ির চালকদের সিংহভাগই অজ্ঞ। বিশ্ব সংস্থার মান অনুযায়ী শব্দে গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৪৫ ডেসিবল, অথচ অজ্ঞ চালকরা এর ধারই ধারে না। যানজটের মধ্যে দাঁড়িয়ে অহেতুক হর্ন বাজাতে থাকে। ঢাকার শব্দের মাত্রা গড়ে ৮০ ডেসিবেলের ওপরে। আর গাড়ির হর্ন ১৪০ ডেসিবেলের বেশি। যার কারণে শব্দদূষণের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সচেতন করতে হবে। সেই সঙ্গে শব্দদূষণ বিধিমালার যে কোনোটি লঙ্ঘন করলে পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং শব্দদূষণের শাস্তি হিসেবে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এই আইনটি যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে।

 

শব্দদূষণ নীরব ঘাতক। অনেক বিলম্বে হলেও সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে সাড়া দিয়েছে। শব্দদূষণ রোধ করতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন করতে হবে, বিভিন্ন সামাজিক-পরিবেশবাদী সংগঠন ও প্রচার মাধ্যমগুলোকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ডিসেম্বর ২০১৬/রিশিত/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়