ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আলোক লতিকা স্বর্ণলতা

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আলোক লতিকা স্বর্ণলতা

রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার গোগগ্রাম ইউনিয়নে বিড়ইল গ্রামের পাশে সাঁওতাল পাড়ায় স্বর্ণলতা (ছবি : তৌহিদুল আবেদীন)

খান মো. শাহনেওয়াজ : বাংলাদেশের প্রকৃতিতে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে যে কয়েকটি লতা, তাদের অন্যতম হচ্ছে স্বর্ণলতা বা আলোকলতা। শ্যামল বাংলার পথে প্রান্তরে আপন রূপের মহিমা ছড়ায় এই উদ্ভিদ তার নিজের মত করে।

দেশের সব জায়গায় দেখা যায় স্বর্ণলতা। গ্রামে বসবাসকারী বা গ্রামে যাতায়াত আছে এমন সব বয়সী মানুষ এই উদ্ভিদকে চেনেন। পরজীবী এই উদ্ভিদ বেশিরভাগ দেখা যায় বড়ই গাছের কাণ্ডে। এর সবুজাভ উজ্জ্বল রঙ বহুদূর থেকে নজর কেড়ে নেয়। এই লতিকার বেড়ে ওঠা ও ফুল ফোটার ভরা মৌসুম মুলত পৌষ থেকে চৈত্র মাস। তবে এই সময়ের আগে ও পরেও এই উদ্ভিদ জন্মে এবং এতে ফুল ফোঁটে, ফল আসে। ভরা মৌসুমের বাইরেও বেঁচে থাকে স্বর্ণলতা।

বাংলাদেশের আবহাওয়া স্বর্ণলতার জন্য অত্যন্ত অনুকূল। ফলে গ্রামে ও পাহাড়ি এলাকায় উপযুক্ত আশ্রয়ী গাছে অনায়াসে জন্ম নেয় স্বর্ণলতা। এর জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটে প্রাকৃতিক উপায়েই। তবে আজকাল শহরে ও নগরে বৃক্ষপ্রেমীরা ভালবেসে স্বর্ণলতাকে আশ্রয় দিচ্ছেন বাড়ীর আঙিনায়। তবে সে সংখ্যাও খুব বেশি নয়।

এখন স্বর্ণলতার ভরা মৌসুম। গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও এর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। কোথাও কোথাও কেবল জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য এর ডগা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় রমনা উদ্যানে প্রতিবছরই নজর কেড়ে নেয় স্বর্ণলতা। এবারও এই লতা কিছু গাছে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে। রমনায় সুপ্রিম কোর্ট ভবনের (প্রাক্তন সড়ক ভবন) উত্তর পাশে রমনা পার্কের সীমানা রেলিং ছেয়ে থাকা অনেক গাছে এর লতা বেড়ে উঠছে। গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠা স্বর্ণলতার এখন ভরা যৌবন।

ঢাকার নবাবগঞ্জে মুন্সিনগর গ্রামে স্বর্ণলতা (ছবি : শামীম আহমেদ)


আমাদের দেশে এই লতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগে। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল আর ঢাকার ভাওয়াল অঞ্চলে এই লতা এখন প্রকৃতিকে মোহনীয় রূপ দিয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায় পথে পথে চোখে পড়বে স্বর্ণলতা। আর ঢাকা বিভাগের গাজীপুরে ভাওয়াল গাজীপুর, সাতখামাইর ও শ্রীপুর এলাকায় গাছে গাছে মিলবে স্বর্ণলতা। ঢাকার নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় স্বর্ণলতা এখন ছড়িয়ে চলেছে হলদে আভা।

রাজশাহীর বাসিন্দা বৃক্ষপ্রেমী তৌহিদুল আবেদীন জানান, গোদাগাড়ীর গোগগ্রাম ইউনিয়নে সাঁওতাল পাড়া স্বর্ণলতায় ভরে গেছে। তৌহিদুল আবেদীনের গ্রামের বাড়ি ওই এলাকায়। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণলতায় ভরা গ্রামে সে এক অসাধারণ দৃশ্য। গোগগ্রাম ইউনিয়নের বিড়ইলগ্রাম থেকে জগপুর গ্রামে যেতে গাছে গাছে চোখে পড়ে স্বর্ণলতা বা আলোকলতা। এই দৃশ্য দেখে যে কারও মন ভরে উঠবে। যে কেউ আসতে পারেন। রাজশাহী নগরী থেকে বাসে বা অন্য কোন যানবাহনে রাজাবাড়িতে এসে নামতে হবে। তারপর ভটভটিতে চেপে ৮-১০কিলোমিটার ভেতরে বিড়ইল গ্রামের পাশেই সাঁওতাল পাড়া। সেখানে রয়েছে স্বর্ণলতা।’

ঢাকা জেলার ডেমরার সারুলিয়া এলাকার বাসিন্দা, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বৃক্ষপ্রেমী শামীম আহমেদ জানান, তাদের এলাকায় অনেক গাছেই এখন চোখে পড়ে স্বর্ণলতা। চারদিন আগে তিনি গিয়েছিলেন নবাবগঞ্জে। সেখানেও তিনি অনেক গাছেই দেখেছেন স্বর্ণলতা। কিছু লতা পূর্ণতা পেয়েছে, কিছু কেবল বেড়ে উঠছে। তবে যেগুলো প্রধান সড়কের পাশে সেগুলোর অবস্থা খুব করুন। ধুলায় ঢাকা পড়ায় স্বাস্থ্য ও ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। একটু ‍ভেতরে মেঠোপথে যেখানে আছে স্বর্ণলতা সেগুলোর অবস্থা মোটামুটি ভালো।

ফেসবুকে বৃক্ষপ্রেমিদের গ্রুপ ‘সবুজ বাগান সোসাইটির’ সদস্য ও রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা ফারজানা ইসলাম মুনিয়া বলেন, ‘এই উদ্ভিদ নিজেই যেন ফুল! আমার বাসার কাছেই ছোট্ট একটি খালি জায়গার কোনায় একটা কূল গাছে এই লতা আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ঝুরি ঝুরি হলদে সুতা ঝুলে আছে। এর ওপরে রোদ পড়লে চকচক করে, ভীষণ সুন্দর। বাড়ির সামনে জায়গা নেই; নইলে বড়ই গাছ লাগিয়ে ওতে দিয়ে দিতাম।’

রাজধানী ঢাকার রমনায় রমনা পার্কের সীমানা রেলিংয়ে স্বর্ণলতা (ছবি: খান মো. শাহনেওয়াজ)


স্বর্ণলতা পরজীবী উদ্ভিদ। গাছেই এর জন্ম, গাছেই এর বেড়ে ওঠা ও বংশ বিস্তার। এর ইংরেজি নাম জায়ান্ট ডডার (giant dodder). বৈজ্ঞানিক নাম কাসকিউটা রিফ্লেক্সা (Cuscuta reflexa). কাসকিউটা (Cuscuta) গণের এই উদ্ভিদের প্রজাতি রয়েছে ১৭০ টির মতো। বাংলাদেশে একে শূণ্য লতা নামেও ডাকা হয়। এটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ এবং পত্রহীন। জীবন্ত গাছে জন্ম নিয়ে গাছকে অবলম্বন করেই টিকে থাকে। যে গাছে জন্মায় সেই গাছের ডাল ও কাণ্ড থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে।

এই লতার হস্টেরিয়া (Hosteria)  নামের চোষক অঙ্গ থাকে যার মাধ্যমে এটি আশ্রয়ী গাছ থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। দ্রুত বর্ধণশীল এ লতা অনেক শাখা প্রশাখা তৈরি করে অল্পদিনেই আশ্রয়ী গাছটিকে পুরো ছেয়ে ফেলে।

এতে ফুল আসে বসন্ত ঋতুতে। ফুল হয় ছোট, বৃত্তি হয় ২ মিলিমিটার এবং দল ৩ থেকে ৫ মিলিমিটার। এতে ফল ধরে এবং পাকে গ্রীষ্ম ঋতুতে। বীজ থেকে বংশবৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশে এর কয়েকটি প্রজাতি দেখা যায়। আমাদের দেশে একে ওষধি লতা হিসেবেও গণ্য করা হয়।

দুই-তিন যুগ আগেও দেশের যে কোন স্থানে পথে প্রান্তরে ব্যাপকভাবে চোখে পড়তো স্বর্ণলতা। বড়ই গাছই মূলত এর প্রধান ধারক গাছ। কিন্তু বর্তমানে পাড়াগাঁয়ে পথের পাশে বড়ই গাছ আর অবহেলা অনাদরে সহজে বেড়ে ওঠে না। যদিও বা কোথাও বেড়ে ওঠে এর মালিক দাঁড়িয়ে যায় এবং পরিকল্পিত ও বেশি ফলনের প্রয়োজনে প্রতি বছরই একটা সময়ে এর ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়। ফলে অবলম্বন হারায় স্বর্ণলতা। সেই গাছে নতুন ডালপালা গজায় কিন্তু স্বর্ণলতা আসে না। যদিও বা আসে তাকে আগাছা হিসেবে উপড়ে ফেলা হয়। আর এভাবেই কমে যাচ্ছে স্বর্ণলতা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়