ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বরেন্দ্রর প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পাখি

তানজিমুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বরেন্দ্রর প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পাখি

প্রতীকী চিত্র

তানজিমুল হক, রাজশাহী : ‘পাখি-সব করে রব রাতি পোহাইল, কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’ মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিখ্যাত কবিতার এই চরণের মতোই ছিল বরেন্দ্রর প্রকৃতি। কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রকৃতিতে পাখিদের সে কিচিরমিচির এখন আর নেই।

বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন আর রাত পোহালে পাখির কণ্ঠ শোনা যায় না। পাখি বিশারদদের অভিমত, বন উজাড়, বাড়ির আশপাশে পুরোনো গাছ কেটে ফেলার কারণে আশ্রয় হারাচ্ছে পাখি। এ ছাড়া খেতে উচ্চমাত্রার কীটনাশকের ব্যবহার ও শিকারিদের কারণে পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুধু বরেন্দ্র অঞ্চল নয়, সারা দেশে গত ১৫ বছরে অন্য প্রাণীর তুলনায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির হার সবচেয়ে বেশি। দেশের ৫৬৬ প্রজাতির পাখির মধ্যে গত কয়েক দশকে ১৯টি প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। দেশি পাখির ওপর ২০১৪-১৫ সালে হালনাগাদ তালিকা তৈরি করে গত বছরের ২২ জুন তালিকা প্রকাশ করেছে পরিবেশ ও বন বিভাগ। সেই জরিপে উঠে এসেছে এমন চিত্র।

তালিকার বাইরে বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাস করা পরিচিত, অপরিচিত অনেক পাখিই বিলুপ্ত হয়েছে। আবার অনেক পাখি বিলুপ্তি হওয়ার পথে।

বন বিভাগের হালনাগাদ ওই তালিকায় বাংলাদেশে এক হাজার ৬১৯ প্রজাতির বন্য প্রাণীর কোনটির কী অবস্থা তা নিয়েও তৈরি করা হয়েছে লাল তালিকা (রেড লিস্ট)। এটি যৌথভাবে তৈরি করেছে বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)।

এতে প্রকাশ পায় যে, দেশে ৩৯০টি বন্য প্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। এর মধ্যে গত ১৫ বছরে পাখি প্রজাতি বেশি বিলুপ্ত হয়েছে। দেশের ৫৬৬ প্রজাতির মধ্যে ১৯টি প্রজাতির পাখি এখন আর দেখা যায় না।

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত পাখির মধ্যে রয়েছে- লালমুখ দাগিডানা, সারল, ধূসর মেটে তিতির, বাংলার বিখ্যাত বালি হাঁস, গোলাপি হাঁস, বড় হাড়গিল বা মদনটাক, ধলাপেট বগ, সাদাফোটা গগন রেড, রাজ শকুন, দাগি বুক টিয়াঠুঁটি, লালমাথা টিয়াঠুঁটি, গাছ আঁচড়া, সবুজ ময়ূর। এই পাখিগুলো মূলত বাঁশঝাড়, বন জঙ্গল বা নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। এ ছাড়া মাত্র দেড় যুগ আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠ-ঘাটে, বাড়ির পাশের গাছ-পালা, ঝোপঝাড়ে টিয়া, ফিঙ্গে, বুলবুলি, শালিক, টুনটুনি, কেঁচকেচি, প্যাঁচা, আবলকিসহ অনেক পাখির দেখা মিলত। কিন্তু এ পাখিগুলোও এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। 

রাজশাহী বিভাগীয় বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা আমজাদ আলী জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে পুরোনো গাছ কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। আমরা এ অঞ্চলে নতুনভাবে গাছ লাগাচ্ছি। এ গাছগুলোর বয়স বাড়লে পাখির আবাসন সমস্যার সমাধান হবে। আমরা আশা করছি, বরেন্দ্র অঞ্চলে আবারও পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

তিনি বলেন, ‘গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ হাড়ুপুর এলাকা থেকে একটি মদনটাক উদ্ধার করা হয়েছে। এ পাখিটি এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে। আমাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পাখিটির সেবাযত্ন করছি। এভাবে অন্য কোনো বিলুপ্ত পাখি উদ্ধার হলেও আমরা সেটিকে বাঁচিয়ে রেখে অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য, বিলুপ্তপ্রায় পাখিগুলো যেন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে না যায়।’

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে পাখি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে ফসল খেতে অতিমাত্রার কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে পাখির খাবার ছোট মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ মরে যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই পাখির খাবারের স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। পাখি খাবার না পেয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে থাকছে না। পাশাপাশি উচ্চমাত্রার কীটনাশক খেতে ব্যবহারের ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর বিষাক্ত পানি খেয়ে পাখি মারা যাচ্ছে।’ 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘যেকোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। এর একটি হলো, নিরাপত্তা এবং অপরটি খাদ্যের নিশ্চয়তা। পাখির বেঁচে থাকা বা অস্তিত্বের জন্যও এ দুটি বিষয় মুখ্য। পাখির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়েছে প্রাকৃতিক কারণে নয়। এর জন্য বেশি দায়ী মানুষের সচেতনতার অভাব।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন শুধুমাত্র শালিক এবং কাকের আধিক্য দেখা যায়। অন্য পাখিগুলোর অস্তিত্ব সংকটের মুখে। অন্য পাখি কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে খাদ্যসংকট।’



রাইজিংবিডি/রাজশাহী/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তানজিমুল হক/টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়