ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘শালতা’ এখন লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাস

এম.শাহীন গোলদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘শালতা’ এখন লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাস

সাতক্ষীরা সংবাদদাতা : পলি জমে একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে তালার সীমান্ত নদী শালতা। সুযোগে এক শ্রেণির দখলবাজদের কবলে পড়েছে এই নদী। তারা গড়ে তুলছে বাড়ি ঘর ও মাছের ঘের।

যে নদীটি সচল রেখেছিল লাখো মানুষের জীবন, যে নদীকে ঘিরে দু’ পাড়ের গ্রামজুড়ে ছিল প্রাণচাঞ্চল্য,  নদী থেকে পানি সেচ দিয়ে ফলাতো তাজা সবজিসহ নানা ফসলাদি, মৎস্যজীবীদের হতো জীবিকা নির্বাহ,  মানুষকে দিয়েছিল কাজের সন্ধান, মৃতপ্রায় সেই নদী এখন লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

এক পাড়ে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কাঠবুনিয়া, আরেক পাড়ে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রাম। মাঝদিয়ে বয়ে গেছে এক সময়ের খরস্রোতা এই শালতা নদী। একাংশ বুড়িভদ্রার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং অপর অংশ শিবসা নদীর সাথে। এরই মধ্যে ১৬, ১৭/১ নং পোল্ডারের আওতাধীন ১৮ কিলোমিটার নদী একেবারেই মরে গেছে । কিছু অংশ মিশে হয়েছে সমতল ভূমি আর সেখানে উঠেছে বাড়িঘর, অন্যান্য অবৈধ্ স্থাপনা। যেখানে নিচু সেখানে বাঁধদিয়ে এক শ্রেণির মানুষ মেতেছে চিংড়ির ঘের ব্যবসায়।

শালতা তীরবর্তী তালা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানা যায়, কপোতাক্ষ ভরাটের পর তালা উপজেলার খলিলনগর, তালা সদর, তেঁতুলিয়া এবং ইসলামকাটী ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের কমপক্ষে এক লাখ বাসিন্দা চরম ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন ।

কাঠবুনিয়া, বৈটেয়ারা, বাটুলতলা, মহান্দী, নলতা, খলিলনগর, মাছিয়াড়া, বয়ারশিং, মুড়োবুনিয়া, পুটিমারী ও সুন্দরবুনিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষের অভিযোগের আঙ্গুল পানি উন্নয়ন বোর্ডের দিকে।

তাদের দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের গাফিলতি এবং নদী ভরাটের জায়গা ইজারা দেওয়ার কারণে আজ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তাই শালতা নদী খননই লাখ লাখ মানুষের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন তারা।

সম্প্রতি শালতা বাঁচাও কমিটির আয়োজনে এবং বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ ও পানি কমিটির সহযোগিতায় শালতা নদীর পুনর্জীবনের লক্ষ্যে নদী অববাহিকার ভুক্তভোগী মানুষ ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে।

বৈঠকে বলা হয়, শালতা মরে যাওয়ায় এলাকায় বর্ষার ছয়মাস জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, এ সময় মানুষ কাজহীন হয়ে পড়ে । রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, যাতায়াত ব্যবস্থা অসহনীয় হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসা সেবায় চরম সংকট দেখা দেয়, কেউ মারাত্মক অসুস্থ্ হলে রাস্তাঘাট অচল থাকায় অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বৈঠকে বলা হয়, শালতা পূর্ণখনন হলে এলকার মানুষ যেমন জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাবে তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়বে। কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে বাইরে পাড়ি জমাতে হবে না বাসিন্দাদের। তাই এই মুহুর্তে দ্রুত শালতা খনন করে লাখো মানুষের জীবন বাঁচানো জরুরী।

এলাকাবাসী আরো বলছেন, শালতা নদী খননের আগে সীমানা নির্ধারণ করা জরুরী। অনেকস্থানেই নদীর চিহ্নমাত্র নেই। কেউ কেউ একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে ভরাট নদীর বুকে বাড়িঘর তুলেছে, মাছের ঘের করেছে। খননের আগে সীমানা নির্ধারণ করা এবং সকল অবৈধ্ স্থাপনা উচ্ছেদ করা না হলে সংঘাতের আশংকা দেখা দিবে। সরকারি ম্যাপে এই নদীর চওড়া কোথাও ৪৫০ ফুট, কোথাও ৫০০ ফুট আবার কোথাও ৪০০ ফুট।

ডুমুরিয়া উপজেলার বৈটেয়ারা গ্রামের বাসিন্দা দিপংঙ্কর মন্ডল (৫২) জানান, শালতা নদীর বুকে ভেসে গেছে এক সময় বহু ঘর-বাড়ি, ভেসে গেছে অনেকের জীবন। আর এখন সেই শালতার বুকে গড়ে উঠেছে ঘের-বসত বাড়ি। এক সময় এই নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলতো কিন্তু এখন সেখানে মানুষ মটরসাইকেল, ভ্যান চালিয়ে পার হয়। নদী ভরাট হওয়ায় দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।

তালা উপজেলার হাজরাকাটী গ্রামের সুভাষ ঘোষ বলেন, ‘নদীর নাব্যতা থাকাকালে বিলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ধান হত। হরকোজ ধান, বালাম ধান, পাটনাই ধান’র খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। সে সব ধান আজ হারিয়ে গেছে। যেসব মানুষ কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করতো, তারা এখন বেকার। কিছু মানুষ মাছের ঘেরে কাজ করতে পারলেও অনেকেই রোজগারের প্রয়োজনে এলাকার বাইরে ইট ভাটায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

শালতা বাঁচাও কমিটির সভাপতি সাবেক খলিলনগর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার ইমান আলী জানান, ইতিমধ্যে জোয়ার-ভাটা না থাকার কারণে পলি পড়ে শালতাও ভরাট হয়ে গেছে। শালতা এখন এই এলাকার মরণব্যাধি।

সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, ‘আমি পাঁচবার শালতা খনন নিয়ে সংসদে উত্থাপন করেছি কিন্তু তার কোন গুরুত্ব আসেনি। কারণ শালতার যে অংশটি খনন হবে তার বেশির ভাগ ডুমুরিয়া উপজেলার ভিতরে তাই ওই এলাকার স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি বিয়টি বিবেচনা করেন তাহলে সম্ভাবনা আছে।’



রাইজিংবিডি/সাতক্ষীরা/২৫ ডিসেম্বর ২০১৭/এম.শাহীন গোলদার/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়