ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘বিশ্বে কবিতার বিপ্লব ঘটেছে’

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৮:৪৭, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪
‘বিশ্বে কবিতার বিপ্লব ঘটেছে’

রাইজিংবিডির স্টলে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল (ছবি : শাহীন ভূঁইয়া)

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু। ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান এবং ১৯৯৬-এ খালেদা জিয়ার শাসনামলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তারপর স্বাধীনভাবে লেখালেখি, সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রবাসী বাঙালিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নিউজ এজেন্সি স্বরব্যঞ্জন। দীর্ঘদিন প্রবাসের পত্রপত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। টরেন্টো থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টারে প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের কানাডাস্থ বিশেষ প্রতিনিধি এবং সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের উপদেষ্টা সম্পাদক। এ ছাড়া গবেষণা করছেন ‘কানাডায় ১৯৭১’ নিয়ে। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। বর্তমানে তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে সোমবার আসেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাইজিংবিডি ডটকমের স্টলে। এ সময় কবিতা, বইমেলা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা কেমন দেখছেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
ভালো লাগছে। ভালোলাগার কারণও আছে। যেহেতু আমি নিজে লেখালেখি করি, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। মেলা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনেক স্মৃতি আছে। এখন মেলা অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। তখনকার সময় শুধু বাংলা একাডেমিতেই মেলা হতো। আমরা সারা রাতব্যাপী উৎসব করতাম, আড্ডা দিতাম, হইচই করতাম। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিল, আহমদ আজীজ বা পুরোনো বন্ধুরা যারা ছিল- দেখা গেছে যে রাত ১২টা ১ মিনিটে কবিতা পড়েছি টিএসসিতে, তারপর এখানে (বাংলা একাডেমি) এসে সারা রাত কাটিয়ে দিতাম। ঝিমুতে ঝিমুতে সকাল বেলা বাংলা একাডেমিতে কবিতা পাঠে অংশ নিতাম। আমাদের অনেক রকমের স্মৃতি আছে। আড্ডা, বই, প্রকাশকদের সঙ্গে স্মৃতি আছে।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বিশ্বের অনেক বইমেলায় অংশ নিয়েছেন। অমর একুশে বইমেলার সাথে বিদেশের বইমেলার কোনো পার্থক্য লক্ষ করেছেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
বিশ্বের অনেক বড় বড় বইমেলায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু আমাদের এই মেলা সত‌্যিকার অর্থেই প্রাণের মেলা। পৃথিবীর অন্যান্য মেলার চেয়ে এই মেলা পৃথক এই কারণে যে, একুশে বইমেলা আমাদের ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাসব্যাপী বইমেলা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ফলে শেকড়ের টান থাকে। আমার ভাষার প্রতি, আমার বইয়ের প্রতি, ভালোবাসার প্রতি সে টানটা অবশ্যই বইকেন্দ্রিক।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি বলেছেন অনেক স্মৃতির কথা। সেই সময়ে অনেক আড্ডা হতো। আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা জানি, কিন্তু এখন সেরকম আড্ডা হচ্ছে না বা আমরা পাচ্ছি না..
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
একাধিক কারণ আছে। আমি কয়েক বছর আগে একটা বই লিখেছি। সেটা বাংলা প্রকাশ থেকে বের হয়েছে। সেই বইটি হলো ‘কাছের মানুষ দূরের মানুষ’। সেই ধারাবাহিকতায় এবার একটি বই করার কথা ছিল ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ’। এর মধ্যে যারা চলে গেছেন তাদের নিয়েই মূলত এই বই। আমি এই বইয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছি, সেই সময়ে আমরা একান্নভুক্ত পরিবার ছিলাম (লেখকেরা)। আমার বিয়েতে শামসুর রাহমান এসেছেন। আমার মেয়ে হয়েছে সেখানে রাহমান ভাই গিয়েছেন। আমরা পরস্পর ঝগড়া করতাম, মিলমিশ করতাম, আমাদের আড্ডা ছিল। যেমন দৈনিক বাংলায় বিচিত্রায় আমাদের সারাক্ষণ আড্ডা ছিল। এখন ব্যাপারগুলো সব করপোরেট হয়ে গেছে। এখন বিভিন্ন জায়গায় যেতে অনুমতি নিয়ে যেতে হয়, সবাই নিজ নিজ ডেস্কে বসে থাকে। আরেকটা কারণ হচ্ছে অনলাইন হওয়াতে বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের কারণে অনেকেই সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করে। যে কারণে তার আলাদা একটা সার্কেল তৈরি হয় ভার্চুয়াল জগতে। সবাই সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করে। আরেকটা কারণ হচ্ছে নাগরিক জীবনে জটিলতা। আমাদের সময় এত আড্ডা হতো যে, কোন আড্ডা ছেড়ে কোন আড্ডার কথা বলব। আবদুল মান্নান সৈয়দের বাসায় (গ্রিন রোডে) আড্ডা হতো। সেখানে ফারুক মাহমুদ, শহীদুজ্জামান ফিরোজ, আশরাফ আহমেদ (যারা ছোট কাগজ করতাম) আমরা প্রতি রোববার বসে আলোচনা করতাম। আমরা আড্ডা দেওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ চলে যেতাম। নারায়ণগঞ্জে বোস কেবিনে বসে আমরা আড্ডা দিতাম। আমি এত ব্যস্ততার মধ‌্যেও গতকাল (২০ ফেব্রুয়ারি) বাংলাবাজার গিয়েছিলাম আমার বইয়ের পেস্টিং দেখার জন্য। হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ল বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা। আমি সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম অনেক স্মৃতিস্তম্ভ হয়েছে। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করল, আমার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এটা একটি ইতিহাস। এখনো হয়তো আড্ডা হয়, সেটি সীমিত আড্ডা হয়। আজকাল একটা গ্রুপ তৈরি হচ্ছে, বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। সাহিত্য সম্পাদকরা তাদের একটা সার্কেল তৈরি করছেন। সেই সার্কেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে আড্ডা বা সাহিত্যের বিষয়গুলো।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিপ্লব ঘটে গেছে। দেখা যাচ্ছে যে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা করছেন। সেখানে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটা উন্মেষ হচ্ছে। এ বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
আমি দেখি যে সাধারণ একটি পত্রিকায় নিউজ আসার চেয়ে ফেসবুকে দ্রুত ক্যাচ করে। পত্রিকা সাধারণত পড়ে না। টুইটারটা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা বেশি ব্যবহার করেন। তাদের সর্বশেষ ভাবনাগুলো, খবরগুলো টুইটারে শেয়ার করেন। যেমন আমি দেখলাম, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যখন ট্রাম্প বলল আমরা সব বের করে দেব। তখন জাস্টিন ট্রুডো টুইটারে বলল, আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাব। সংবাদপত্রে আসার আগেই এটা দ্রুত ছড়িয়ে যায়। অথবা ফেসবুকে, গতকাল একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোতে আমার নামের শেষ অংশ বাদ দিয়ে একটা নিউজ করে। এ ঘটনায় ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। প্রথম আলোর আনিসুল হক ফান করে বলেছেন আমাকে ‘মামলা করে দিন’। এটা আমি ফেসবুকে ছোট্ট করে একটা স্ট্যাটাস দিই। এ বিষয়টা দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেটা পত্রিকা হলে হতো না। তবে আমি মনে করি ফেসবুকে কোনো সাহিত্য করার জায়গা না। এটা যোগাযোগ করার একটা মাধ্যম। দেখা যাচ্ছে যে মাত্রা নাই, ছন্দ নাই যা ইচ্ছে লিখে পোস্ট করে দিল। সেখানে প্রচুর লাইক, কমেন্ট পড়ে। অথচ একজন ভালো কবি একটা কবিতা দিল কিন্তু সেখানে কেউ যায় না। পড়েও না। তবে কয়েকটি অনলাইন আছে, সেখানে সাহিত্য পাতা চমৎকার।

 


সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সাইফ বরকতুল্লাহ

সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা যারা সারা বছর সাহিত্যচর্চা করি আমরা দেখি যে বইমেলা আসলে কিছু মৌসুমি লেখকের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।এ ক্ষেত্রে প্রকাশকেরও তো একটা দায়িত্ব আছে...
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
প্রকাশকেরা একটা চাপের মধ্যে থাকেন। তাদের মার্কেটিংয়ের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়। একজন মন্ত্রীর বই বের হলে তার স্ট্যাটাসটা হাই হয় এবং এটা প্রকাশকের পেশার জন্য, বাণিজ্যের জন্য কাজে লাগে। ফলে কিছু বই বের হয়। এটা সব জায়গাতেই হয়।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন। বিশ্বের অনেক কবিদের কবিতা আপনি পড়েছেন। বাংলাদেশের অনেকেরই কবিতা এখন একটা পর্যায়ে চলে গেছে। বলা হয় বিশ্বমানের। ভিন দেশের কবিতা আর আমাদের কবিতার কী রকম পার্থক্য খুঁজে পান?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
পার্থক্য তো আছেই। ভৌগোলিক পার্থক্য, পরিবেশগত, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা যায় যে কবিতার যে বিপ্লবটা- সেটা সারা বিশ্বেই ঘটেছে। এখন অনলাইন সারা পৃথিবীর লোকজন ব্যবহার করে। তবে এটা বলা কঠিন যে বাংলাদেশের কবিতা বিশ্বের কবিতাকে ছাড়িয়ে গেছে। কারণ, সেভাবে অনূদিত হয়নি। তবে আমাদের জীবনযাপন যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তেমনই পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কেউ অ্যাবাস্ট্রেক কবিতা লিখছেন। কেউ কেউ কবিতা থেকে মানুষ সরিয়ে তারা একটা অশরীরী বা একটা অন্য ধরনের বা একটা উন্নত বায়বীয় প্যাটার্নের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ উত্তর আধুনিকতা যেটা বলব, বা পরাবাস্তব, তাদের জীবন দর্শন নিয়ে কবিতায় চাঞ্চল্যকর সৃষ্টি করছে। আমি সেটা তরুণ বন্ধুদের মধ্যে লক্ষ করি। তারা প্রথা ভাঙতে চাচ্ছে। যেমন তারা ছন্দের ধার ধারছে না (দু-একজন ব্যতীত)। যেমন তারা পুন আবৃত্তির কবিতা লিখতে চাইছেন না যেমন শামসুর রাহমান লিখেতন বা আল মাহমুদ যেরকম ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন, তারা সেদিকেও যাচ্ছেন না। তারা (তরুণরা) চেষ্টা করছেন তাদের মতো করে লিখতে। হয়তো তাদের ভাষাটা আমি বুঝতে পারছি না। যেমন আমি যদি আমার মেয়ের কথা বলি, আমি যে চিন্তাভাবনা করি, আমি আমাকে প্রকাশ করতে চাই, কবিতা লিখতে চাই। আমি যেটা ভাবছি সেটা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাই। আমি প্রবাসে আছি, প্রবাসের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে চাই। আমার মেয়ে দেখছি তা না। তার একটি বই আছে ‘রূপকথার ইলিশ’ বাংলা প্রকাশ থেকে বেরিয়েছে (৩য় সংস্করণ হয়েছে)। প্রকাশক বলল তাকে আরেকটা পাণ্ডুলিপি দেওয়ার জন্য। আমি মেয়েকে বললাম তুমি একটা পাণ্ডুলিপি রেডি কর, ও বলল, বাবা আমার কাছে স্টোরি নেই। আমি তাকে একটা স্টোরি দিলাম, বাংলাদেশে তোমার ভাই-বোন, বন্ধু রেখে এসেছ, কানাডায় কিছু বন্ধু-বান্ধব তৈরি হয়েছে- এটা নিয়ে লিখতে পার। মেয়ে আমাকে বলল, বাবা এটা আমার পারসোনাল লাইফ। এই যে ছোট মেয়ে তার পারসোনাল লাইফ তৈরি হয়ে গেছে। তার চিন্তা, তার ভাবনা যে আমার লাইফ আমার। কিন্তু আমি তা করছি না। আমি নিজেক প্রকাশ করছি। আমি আমার মেয়ের উদাহরণ দিলাম এই কারণে যে তার চিন্তাভাবনা আর আমার চিন্তাভাবনা অনেকটাই মিল নেই। ঠিক আমার তরুণ বন্ধুদেরও একই অবস্থা।

সাইফ বরকতুল্লাহ : এখন যারা কবিতা লিখছেন তাদের অধিকাংশই ছন্দের দিকে মনোযোগী নন। কী ভাবছেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
এটা জানতে হবে। কবিতা লিখতে কবিতার বিন্যাস, ছন্দ জানতে হবে। সব ধরনের কবিতা পড়তে হবে।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনাকে ধন্যবাদ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :
তোমাকেও ধন্যবাদ।

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/ এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়