ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যেভাবে লেখা হলো ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বর’

শামস সাইদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে লেখা হলো ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বর’

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর উপন্যাস কীভাবে লিখলাম, কেন লিখলাম? এমন প্রশ্ন অনেকেরই। এই কৌতূহলটা এখন আমার নিজেরও। কীভাবে এই বিশাল প্লট আমার মাথায় ঢুকে পড়ল।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বলতে আমরা জানি একটা বাড়িকে। এই ৩২ এতটাই পরিচিত যে অন্য সব ৩২ ম্লান হয়ে গেছে। আসলে ৩২ নম্বর কোনো বাড়ি নয়। একটি সড়ক। ধানমন্ডিতে। এই সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি ৩২ নম্বর নামেই পরিচিত। এই বাড়িটি বাকিংহাম প্যালেস, হোয়াইট হাউস, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট, রাইসিনা হিল কিংবা ক্রেমলিনের মতো সরকারি মর্যাদা নেই। বা ছিলও না কখনো। ছিল না কোনো নামও। ৩২ নামেই পরিচিত। তবে এই বাড়িটি বাঙালি জাতির ভালোবাসার রাজ্যে এক অন্যান্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। এই বাড়িটির আলাদা একটা ইতিহাস আছে। যা পৃথিবীর অন্যকোনো বাড়ির আছে বলে মনে হয় না।

সেই ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন থেকেই বাঙালির মনের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে অসন্তোষ। বাড়তে থাকে অপশাসনের হাত থেকে মুক্তির আকাক্ষ্ম। শেখ মুজিবুর রহমান দিন দিন আরো বেশি গণমানুষের নেতা হয়ে উঠতে থাকেন। আর ৩২ নম্বরের বাড়িটি হয়ে উঠতে থাকে মুক্তির প্রতীক। গণমানুষের ভরসা ও আশ্রয়স্থল। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলন, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন-এসব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সবই করেছেন এই ৩২ নম্বর বাড়িতে। ’৭১-এর উত্তাল দিনগুলোয় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও জাতির পিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে ভিড় করেছিলেন। এছাড়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের রূপরেখাও এ বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে এই বাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিতেন সে অনুসারেই চলত দেশ ও বাঙালি জাতি। দৈনিক আজাদ পত্রিকা লিখেছিল ‘বিশ্ববাসীর কাছে আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট যে বাংলার শাসন ক্ষমতা এখন আর সামরিক কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে নাই বরং তা সাত কোটি মানুষের ভালোবাসার শক্তিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এখন বাংলার শাসন ক্ষমতার একমাত্র উৎস হইয়া পড়িয়াছে।’

বঙ্গবন্ধুর বাসভবন তখন অঘোষিত সরকারি সদর দপ্তরে পরিণত হয়েছিল। বাঙালির আশা-আকাঙ্খার ঠিকানা হয়েছিল। হয়ে উঠেছিল নিরাপদ আশ্রয়। আবার শত্রুদের চক্ষুশূল। দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে এই বাড়ি ছাড়েননি বঙ্গবন্ধু। ওঠেননি সরকারি আলিশান বাসভবনে। স্বাধীনতার আগে পরে আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিংও হয়েছে এই বাড়িতে। যদিও কংগ্রেসের অনেক মিটিং নেতাজির বাড়িতে হয়েছে। তবে ৩২ নম্বরের মতো সংগ্রামের সদর দপ্তরে পরিণত হয়নি। পরিণত হয়নি একটি জাতির ঠিকানায়। ৩২ নম্বর একটি জাতির ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল।

সত্যি বলতে এই বাড়ি নিয়ে উপন্যাস লেখার কোনো পরিকল্পনা ছিল না আমার। কোনোদিন ভাবিনি। আবার হঠাৎ করে যে লেখা শুরু করেছি এমনও নয়। আজ থেকে বারো বছর আগে কোনো  এক আগস্টে আমি গিয়েছিলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। সেটাই ছিল আমার প্রথম যাওয়া। কৌতূহল নিয়ে দেখেছিলাম এই বাড়িটা। এই বাড়িতে বঙ্গবন্ধু থাকতেন। বাড়ির ভেতরও ঢুকেছিলাম। ঘুরে দেখেছিলাম একরুম থেকে অন্যরুম। বাড়িটা তখন জাদুঘর। তাই প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন এই বাড়িতে। সেদিনইও অনেক মানুষ দেখেছিলাম। তবে কারো মুখে হাসি দেখিনি। একজনকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম সেদিন। কেন কাঁদছেন জানি না। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার কান্না দেখে নয়। সেটা এইজন্য যে বাড়িতে সব কিছু আছে। হয় তো তেমনি সাজানো নেই। এলোমেলো স্মৃতিতে ভরপুর বাড়িটা। শুধু সেই স্বপ্নের মানুষরা নেই। এক সকালে মেরে ফেলল তাদের সবাইকে। কেন? কী অপরাধ ছিল তাদের? এমন একটা প্রশ্ন তখনই আমার মাথায় এসেছিল। তার উত্তর আজও আমি পাইনি। সে সময়ও এই বাড়ি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। শুধু এতটুকুই জানি এই বাড়িটা বঙ্গবন্ধুর। এখানেই থাকতেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। এর বাইরে তেমন কিছু জানা ছিল না।

তবে সেদিন মনে হয়েছিল বিবিসির সংবাদদাতা ব্রায়ন বারণের কথা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে সংবাদ বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে প্রতিষ্ঠিত হবেন। যখন এ ঘটনা ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেটবিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থান পূণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’ সেদিন মনে হয়েছিল ব্রায়নের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হয়েছে।

এরপর আমি খুঁজতে থাকি এই বাড়ির ইতিহাস। জানতে চেষ্টা করি এই বাড়িটা আসলে কী। দেখলাম এটা সাধারণ একটা বাড়ি তবে সাধারণ নয়। এই বাড়ির ইতিহাস আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করেছিল। যত না সৃষ্টি করেছিল। তখন ভাবলাম এই বাড়িটা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। সেটা আমার জন্য অত্যাবশক হয়ে পড়েছিল, চাপ মুক্তির জন্য। যন্ত্রণা দূর করার জন্য। উপন্যাস লিখতে হলে তো নতুন একটা জার্নি শুরু করতে হয়। নতুন করে পড়াশোনা করতে হবে। শুরু করলাম পড়াশোনা। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। চার বছর পড়াশোনা করার পরে মনে হলো এখন উপন্যাস লেখায় হাত দিতে পারি। তবে প্রতিনিয়তই আমাকে অবাক করেছে এই বাড়ির ইতিহাস। কী এক বাড়ি, যে বাড়িতে একটা শিতাতপযন্ত্র পর্যন্ত নেই। আলিশান কোনো বাড়ি নয়। মধ্যবিত্ত কোনো এক বাঙালি পরিবারে বাড়ির বাইরে কিছু ভাবা যায় না।

লিখতে বসে তিন মাসের কিছু বেশি সময় এই উপন্যাস আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছিল আমাকে। দূরে সরিয়ে রেখেছিল পৃথিবীর সব ভাবনা থেকে। ডুবে গেছিলাম একটা ইতিহাসের পুকুরে। প্রতিটা শব্দই তুলে আনতে হয়েছে সেখান থেকে। আবার ছুটতে হয়েছে কারো কাছে তথ্যের জন্য। এভাবেই চলছে লেখা। এক সময় দেখলাম ইতিহাসের পুকুর থেকে নদীতে নেমে পড়েছি। মানে বাড়ছে কল্পনার পরিধি। বাড়ছে শব্দ। বাড়ছে পৃষ্ঠা। এবার যেন ইতিহাসের সমুদ্রে সাঁতার কাটছি। কল্পনা বাড়তে বাড়তে কোথায় যাচ্ছে জানি না। হারিয়ে ফেলেছি শব্দের নিয়ন্ত্রণ। দেখলাম পরিধি বেশ বড় হয়েছে। ভাবলাম উপন্যাসটা দুইখণ্ড করব। কিন্তু কয়েকদিন পরে দেখলাম তাতেও আটকাতে পারছি না। পাঁচশ, আটশ ছাড়িয়ে কল্পনা যেখানে গিয়ে তার রথ দাঁড় করাল সেখানে গিয়ে দেখি চার হাজারের বেশি পৃষ্ঠা হবে। তখন আর শব্দে বা পৃষ্ঠায় নয়, সময় হিসেবে এই উপন্যাসকে খণ্ডিত করলাম। তাতে ছয় খণ্ড  হলো।

তিন মাস পর দেখলাম উপন্যাসটা প্রথম খণ্ডের গন্তব্য স্পর্শ করেছে। ২ লক্ষ ৪৭ হাজার শব্দে গিয়ে শেষ হয়েছে। আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কীভাবে লেখাটা শেষ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম অনেকখানি ভালোবাসা আর প্রবল মনোবল ছাড়া এই শব্দগুলোকে এক করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এভাবেই লেখা হয়ে গেল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।

এই উপন্যাসে আমি বঙ্গবন্ধু কিংবা তার পরিবারের কাহিনি লিখিনি। কোনো রচনাও লিখিনি। একটি বাড়ির গল্প লিখেছি। একটা বাড়ির কিছু খণ্ড খণ্ড মুহূর্ত তুলে ধরেছি। যাতে ওঠে এসেছে একটি পারিবারের কথা, একটি জাতির কথা, একটি দেশের কথা, একজন নেতার কথা, একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টির কথা, একটি জাতির স্বপ্ন, আশা আকাক্ষ্মা, আশ্রয়, সংগ্রাম, স্বাধীনতা আবার একটি রাতের কাহিনি। সব হারিয়ে শূন্য এই বাড়িতে ফিরে আসা এক বঙ্গকন্যার কথা। আবার একটি জাদুঘরের কথা। তাতে যতটুকু তুলে ধরা দরকার এর বাইরে বাহুল্য তেমন কিছু লিখি নাই।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় (২০১৮) উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে অন্বেষা প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। দাম ৬০০ টাকা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়