ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গল্পের গল্প : খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক

মোজাফ্ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গল্পের গল্প : খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক

মোজাফ্ফর হোসেন : আলোচ্য গল্পগ্রন্থের অধিকাংশ গল্প সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে লেখা। সচেতনভাবে আগের গল্পগ্রন্থ ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ থেকে বের হতে চেয়েছি। নির্মিতি এবং ভাষাতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। গ্রন্থভুক্ত দুটি গল্প বাদে বাকিগুলো গত দুই বছরে লেখা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত। গ্রন্থভুক্ত করার সময় কয়েকটি গল্পের শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ‘কড়া নাড়ার শব্দে’ এবং ‘লেখক যখন চরিত্র’ গল্পদুটি অন্য শিরোনামে ‘আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ’ শীর্ষক দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থে ছিল। পুনলিখন করা হয়েছে বলে প্রাসঙ্গিক শিরোনামে এখানে স্থান পেল।

অনেকে আমার ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ গল্পগ্রন্থ পড়ে গল্পে ফর্মহীনতার কথা বলেছেন। বলেছেন গল্পে নির্মিতি বলে কিছু নেই। হঠাৎ শুরু, হঠাতই শেষ। গল্পে ‘গল্প’ আছে, আবার নেই। অব্যাখ্যাত উপকরণ নিয়েও কথা বলেছেন কেউ কেউ। জাদুবাস্তব, পরাবাস্তব নাম পড়ানো হয়েছে। এর কারণ হতে পারে, আমি জন্মসূত্রে যে পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি সেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামির পাশাপাশি নানারকম অতিপ্রাকৃত ঘটনা, লোকবিশ্বাস, জনশ্রুতি ও মিথ ছিল। এর অনেককিছুই হয়ত এখন আর আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমার গল্প সবসময় আমার বিশ্বাসের তোয়াক্কা করে না। ফলে অসচেতনভাবেই অনেককিছু চলে আসে। তবে গ্রন্থের গল্পগুলোতে সেই প্রবণতা কিছুটা রয়ে গেছে। অধিকাংশ গল্পের বিষয়বস্তু আমার জীবন থেকে আসা। নির্মাণশৈলি এবং বয়ন-স্বরটা গল্প নিজেই নির্ধারণ করে নিয়েছে। তবে আমি মনে করি, যে গল্পটা আগে থেকেই তৈরি সেটি সাহিত্য না। ফলে গল্পের স্বার্থে আমাকে নিজের জীবন বিনির্মাণ করতে হয়েছে। কতটুকু বাস্তব, কতটুকু নির্মিতি একসময় আমি নিজেই গুলিয়ে ফেলেছি। মনে হয়েছে, ভাইস-ভার্সা-বাস্তবটাই নির্মিতি, কারণ ওটা অন্যকারো রচনা। আর আমি যেটা নির্মাণ করছি সেটাই আমার বাস্তবতা। মার্কিন কল্পকাহিনি লেখক লইস ম্যাকমাস্টার বুজোল্ড যথার্থই I am who I choose to be. I have always been what I chose, though not always what I pleased.

সাহিত্যের প্রধান কাজ হলো, ব্যক্তির সম্ভাবনাগুলো খুঁজে খুঁজে বের করা। ব্যক্তির সেই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে বিদ্যমান থাকতেও পারে, নাও পারে। মার্ক টোয়েন যে কারণে বলছেন- Fiction is obliged to stick to possibilities, Truth isn’t. যদি সম্ভাবনা থেকেই আধুনিক সাহিত্যের সৃষ্টি হয় তাহলে সাহিত্য আর জীবনের হুবহু দর্পণ থাকে না। অর্থাৎ অ্যারিস্টটলের ‘আর্ট ইজ ইমিটেশন অব লাইফ’ কথাটার আধুনিক ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, অস্কার ওয়াইল্ড যেমনটি বলছেন, Literature (art) always anticipates life. It does not copy it, but molds it to its purpose. অর্থাৎ সাহিত্য বস্তুগত বাস্তবতার নিরিখেই একটা নিজস্ব বায়বীয় বাস্তবতা সৃষ্টি করে। জীবন যেমন এখানে নির্মিতির অংশ হয়ে ওঠে, তেমন নির্মিতি হয়ে ওঠে জীবনের অংশ। জীবন ও নির্মিতির এই মিথস্ক্রিয়াকে তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোস্ট মাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।’ অন্যত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখন ঘটে নি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।’ ফকনার একই কথা একটু ঘুরিয়ে বলছেন-‘গল্পটা (‘দ্য রোজ ফর এমিলি’) কল্পনা থেকে এসেছে। কিন্তু ওই বাস্তবতা চারপাশে বিদ্যমান। গল্পটা নতুন কোনো বাস্তবতাকে আবিষ্কার করেনি। তরুণীরা কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন- দেখে-সংসার চায়, সন্তান চায়-এটা আমার আবিষ্কার নয়। কিন্তু ওই মেয়েটির (এমিলি) যে নির্দিষ্ট ট্র্যাজিক পরিণতি সেটা আমার তৈরি।’

অনুরূপভাবে বর্তমান সংকলনের ‘আলীমেয়েলির প্রস্থান ও ইতিহাসের বিস্মরণ পথে’ গল্পে সমাজ বা পরিস্থিতিটা আমার নির্মাণ নয়। আলীমেয়েলি নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ সত্যি সত্যি আমাদের গ্রামে আছেন। আহলে হাদিস এবং হানাফি মাজহাবের ভেতর একটা প্রকাশ্য দ্বন্দ্বও আছে সেখানে। এবং এটাও সত্য যে আহলে হাদিসের আমিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এই গল্পে নির্দিষ্ট করে আলীমেয়েলির যে ট্র্যাজিক পরিণতি সেটা আমার সৃষ্টি। একইভাবে জটিকে আমি ছোটবেলায় স্কুলপথে তিনবার চক্কর দিয়ে হাঁটতে দেখেছি। এই পর্যন্তই। বাকিটা আমি এই সময়ের কতক অ্যাবসার্ড প্রবণতার সঙ্গে মিলিয়ে গল্পটা তৈরি করেছি। অস্বাভাবিকতা এমনভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে যে স্বাভাবিকতায় আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে। আমরা এখন খাঁটি মানুষ দেখলে চমকে উঠি। কোনো সৎ মানুষকে পুলিশ হতে দেখলে বলি ‘ও ওর উপযুক্ত পেশায় যায় নি’। ‘স্মৃতির দরজা খুলে’ গল্পে ভূগোলটা আমার তৈরি না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আমরা হযরত শাহ মখদুমের দরগার সামনে পদ্মাপাড়ে বসে থেকেছি রাতের পর রাত। গল্পকথকের বাবার চরিত্রটা নিয়েছি আমি আমার গ্রাম থেকে। কথায় কথায় দেশভাগ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে এসেছে। তবে মূলগল্প বলে এখানে কিছু নেই। কতগুলো গল্পের কোলাজ। ‘অন্ধকারে বসে থাকেন বনসাই বাবা’ গল্পের বাবাটার ভেতর আমার বাবার ছায়া লুকিয়ে আছে। কড়া মেজাজের বাবাকে মায়ের মৃত্যুর পর দেখেছি শিশুর মতো অসহায় বনে যেতে। ‘কড়া নাড়ার শব্দে’ গল্পটা আমি লিখি মায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর। এ ধরনের অব্যাখ্যাত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমাকে তখন যেতে হয়েছে। ‘গল্পটি পুরুষের কিন্তু কোনো পুরুষ বুঝবে না’ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত রূপা ধর্ষণ-হত্যা ঘটনা থেকে তাড়িত হয়ে লেখা। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন সুরমা জাহিদ। তিনি এবার মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। তাঁর মুখে শোনা, প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্বেও এক নারী তাঁর সদ্যপ্রসূত যুদ্ধশিশুকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে পারেননি। এরপর লিখি ‘আলোটুকু ফুটে রইল ফুল হয়ে’ গল্পটি।

‘খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক’ গল্পটি লেখা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক, আমার সরাসরি শিক্ষক, রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যারকে নির্মমভাবে হত্যার পর। তাঁকে হত্যা করার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। তখন দেশজুড়ে আরও অনেক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বসতবাড়ি ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর লেখা ‘একজন সংখ্যালঘুর বেঁচে থাকা’ গল্পটি। ঘটনার আগে-পরে একাধিক পুরোহিত ও হিন্দু ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয় কিংবা গুমের ঘটনা ঘটে। ‘গার্মেন্টস’ গল্পে নারী গার্মেন্টসকর্মীদের যৌননির্যাতন ও মানবেতর জীবনযাপনের গল্পকে উপজীব্য করে লেখা। এভাবেই সংকলনভুক্ত গল্পগুলোতে এই সময়ের যাতনা এবং আমার যাপিত-অনুধাবিত বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে। এর বাইরে ‘কড়া নাড়ার শব্দে’ ও ‘লেখক যখন চরিত্র’ গল্পদুটি আলাদা। পরাবাস্তব গল্প। নির্দিষ্ট করে স্থান-কাল বলে কিছু নেই। নির্মাণ এখানে ভেঙে পড়েছে। ‘একা থাকার অসুখ থেকে’ ও ‘জন্মপূর্ব আত্মকাহিনি’ গল্পদুটিও মেজাজে আলাদা। ন্যারেটর এখানে কিশোর। নিষ্ঠুর বাস্তবতার ভেতরে তার পুনর্জন্ম ঘটছে।

আশা করতে পারি, শৈলী ও গল্পের ভাষাভঙ্গি সব মিলিয়ে সচেতন পাঠকের কাছে বইটি সমাদৃত হবে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় (২০১৮) ‘খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ।
 

আরো পড়ুন : যেভাবে লেখা হলো ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বর’

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়