ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুম রহমানের বই নিয়ে তিনটি বই

সামিয়া কালাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুম রহমানের বই নিয়ে তিনটি বই

সামিয়া কালাম : ‘ত্রয়ী’ ধারণাটি আমাদের দেশে একেবারেই নতুন। বিষয়বস্তু এক রেখে তিনটি ভিন্ন আঙ্গিক থেকে আলোকপাত করে বই নিয়ে একসাথে তিনটি বই; যেগুলোর প্রচ্ছদ ভিন্ন কিন্তু মূল বিষয় এক। সেই বিষয়টি হলো বই। অর্থাৎ বই নিয়ে তিনটি বই।

বিশ্ব সাহিত্যে নানাবিধ কাজ হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘বই’ নিয়ে কাজ খুব একটা হয়নি। যে কোনো নতুন, কিংবা ভিন্নতা যেমন নজর কাড়ে, তেমনি এক মোড়কে তিনটি আলাদা বই  অবিক্ষিপ্তভাবে বইপ্রেমীদের মুগ্ধ করবে বলেই মনে হয়। বই তিনটির পেইজ মেক-আপ, বাইন্ডিং, প্রচ্ছদ যেমন দৃষ্টি নন্দন, তেমন বিষয়বস্তুও অসাধারণ। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও লেখকের সূক্ষ্ম রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। বই তিনটির নাম যথাক্রমে: ‘কিতাবি কথা’ ‘বই পড়া বই কেনা’ ও ‘বই পড়া’।

‘কিতাবি কথা’ বইতে উঠে এসেছে বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, কবি, গবেষক, দার্শনিক, চিকিৎসক, সাধু-সন্তদের নানা উক্তি। আলোচিত হয়েছে বই নিয়ে প্রবাদ প্রবচন। উঠে এসেছে কিছু নির্দিষ্ট বচনের ব্যাখ্যা। লেখকের কথায়, “বিশ্বে বই নিয়ে কথাবার্তার শেষ নেই। বই যে পড়ে না সে-ও বই নিয়ে দুইখানা কথা বলে। বই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জ্ঞানী ও মুর্খ সবারই ধারণা আছে। তবু কেউ বই পড়ে, কেউ পড়ে না। এই বইয়ে বিখ্যাতদের কয়েকশ উদ্ধৃতি আছে। বই নিয়ে উদ্ধৃতি কেন জরুরি সেটা অন্তত এখানে বাছাই করা বিশটি উদ্ধৃতি থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। আমি নিজের মত করে এখানে উদ্ধৃতিগুলোর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছি উদ্ধৃতিকারীর পরিচয় সহ।”

বইটির একাধিক পৃষ্ঠায় পাদটিকা রয়েছে যা উক্তি এবং প্রবাদগুলোকে পাঠকের কাছে আরো সহজবোধ্য করবে। ‘টুকে রাখা কথা’ শিরোনামের কয়েকটি উক্তির ক্ষেত্রে ডট (...) ব্যবহার করে বক্তার বই সম্পর্কীয় বক্তব্যটুকু তুলে আনা হয়েছে। যা বইটির বিষয়বস্তুকে দিকভ্রান্ত করেনি। পাঠক সহজেই বিষয়টি বুঝবেন। এখানে সম্পাদনার মুন্সিয়ানা চোখে পড়ার মত। এখানেই শেষ নয়, ‘বই নিয়ে দশটি কবিতা’ শিরোনামের অধ্যায়ে চমৎকার একগুচ্ছ ভিন্ন স্বাদের কবিতার সাথে পাঠকের পরিচয় হবে। চেশ্লাভ মিলোজ-এর একটি কবিতার অনুবাদ এখানে তুলে দিচ্ছি :
 

‘তবু বইগুলো রয়ে যাবে ওখানে বইয়ের তাকে,

 

যার জন্ম,

মানুষের থেকে প্রাপ্ত।

কিন্তু প্রভাবময়, উচ্চতায়।”

এবারে আসা যাক ‘বই পড়া বই কেনা’ শিরোনামের বইটিতে। এক মলাটে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, ফ্রান্সিস বেকনের মত ক্লাসিক্যাল লেখকের পাশাপাশি এখানে স্থান পেয়েছে মহিতুল আলম এবং মুম রহমানের মত সমকালীন লেখক তথা গবেষকদের নিবন্ধ। স্যামুয়েল জনসনের প্রবন্ধগুলোর তুলনায়  আমাদের বাংলা ভাষাভাষী লেখকদের প্রবন্ধের মূল বক্তব্য অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক এবং সুপাঠ্য মনে হয়েছে। বিশেষ করে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা ও বই পড়া’ শিরোনামের লেখাটিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় কিছু উক্তি আছে যা সব ধরনের পাঠকেরই পরিচিত। যেমন ওমর খৈয়াম বলছেন: ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি।’

ফ্রান্সিস বেকনের লেখা প্রসঙ্গে লেখক ভূমিকায় বলেছেন: ‘ফ্রান্সিস বেকনের বিখ্যাত কিন্তু অতি ছোট রচনা ‘অন স্টাডি’র বাংলা অনুবাদ এখানে ছাপা হলো। চার শতাধিক বছরের পুরনো এই লেখাকে আজো প্রাসঙ্গিক মনে হলো।’

ভূমিকাটি পড়ে প্রথমেই বেকনের রচনা, ‘আনন্দের জন্য পড়া’ পড়তে শুরু করলাম। এবং মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু কথা এতো বেশি প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তববাদী যে, এই বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য না করে তাঁর লেখার অংশটুকুই তুলে দিলাম: ‘আমার চেনাজানা বহুসংখ্যক মানুষের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটেছে। তারা জানে না কোনটা ভালো, তারা জানে না কোনটা ভালো হওয়ার কথা। তারা জানে না তারা কি পছন্দ করে, তারা জানে না, কোনটা তাদের পছন্দ করা উচিত। আপনি যদি তাদেরকে একটা বই বা ছবি দেখান, আপনি যদি তাদের একটি সুর কিংবা গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে শোনান, দেখবেন তারা নিদারুণভাবে খুঁজতে শুরু করবে এই গানটা কার কিংবা বইটির  লেখক কে? কারণ, যতক্ষণ তারা এটার শিরোনাম দেখতে না পারছে ততক্ষণ তারা বুঝতে পারছে না এটা তারা পছন্দ করবে কি করবে না। শিরোনামহীন একটা কিছু তাদেরকে দিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা পথ হারাবে। তারা বহু আগেই কোনো কিছুকে তার নিজস্ব যোগ্যতার বিবেচনায় গ্রহণ করার ক্ষমতা হারিয়েছে।’

বাংলা ভাষায় নতুন একটি শব্দ সংযোজিত হলো ‘বই বিশ্ব’ শিরোনামের বইটির মাধ্যমে। ‘বই-খোশবাই’ এর অর্থ হরো পুরনো বইয়ের গন্ধ নেয়ার সুখ। অনেকটা স্মৃতি চারণমূলক অত্যন্ত সৃষ্টিশীল একটি লেখা ‘বই-খোশবাই’। ‘বই বিশ্ব’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ এটি। এখানে আরো আছে বেশ কটি চমৎকার লেখা। যার মাঝে ‘বই উৎসর্গ’ শিরোনামের রচনাটির মূল আলোচ্য বিষয় এর শিরোনামেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু জে কে রাওলিংয়ের ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অফ সিক্রেটস’ বইয়ের উৎসর্গ নিয়ে লেখকের মতামতটি পড়ে পাঠকের মনে নানা ভাবনার তরঙ্গ খেলা করবে। লেখকের মতে: ‘সমকালের বিখ্যাত তারকা লেখক জে কে রাওলিং তার  ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অফ সিক্রেটস’ উৎসর্গ করেছেন তার বন্ধু শনকে। তিনি লিখেছেন ‘শন পিত্রফ হ্যারিস, হারিয়ে যাবার চালক ও বাজে আবহাওয়ার বন্ধু।’ উল্লেখ করা দরকার শনের কাছে তিনি গাড়ি চালানো শিখেছেন এবং একাধিক বাজে আবহাওয়াতেও তারা একসাথে ঘুরেছেন। সে সময়গুলোতেই তিনি বন্ধুর সাথে হ্যারি পটার নিয়ে আলোচনা করেছেন। শন পিএফ হ্যারিস তাকে সব সময়ই লেখক হতে উৎসাহ দিয়েছেন। হ্যারিস নাম থেকেই হ্যারি এসেছে কিনা সে প্রশ্নও পাঠক হিসেবে মনে জাগে।’

এছাড়া বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে ‘প্রাচীন বই’, ‘দুনিয়া বদলানো বই’, ‘বইয়ের জাত পাত’ শিরোনামের রচনাগুলোতে। অপরদিকে ‘প্রত্যাখ্যাত বই’ শিরনামের রচনাটি শুরু হয় দুজন ব্যক্তির কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। প্রথাগতভাবে কোনো অনুচ্ছেদ বা আর্টিকেলের শেষে যেমন ছবি কিংবা আলোকচিত্রের সংযুক্তি থাকে, এই বইটিতে সেরকমভাবে চিত্রগুলো সংযুক্ত না হয়ে আস্ত একটা অধ্যায় রয়েছে কেবল বইয়ের আলোকচিত্র নিয়ে। যার শিরোনাম ‘আলোকচিত্র’। বেশ কিছু দুর্লভ বইয়ের  চিত্র এখানে আছে। যদিও আমার কাছে মনে হয়েছে বিভিন্ন দেশের বইমেলার চিত্রগুলো তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করেনি।

‘বিবলিওসমিয়া’র (পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ নেবার সুখানুভূতি) মত বই হাতে নিয়ে সুখের অনুভূতির কোনো ল্যাটিন বা ইংরেজি নাম আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে যে কোনো বই হাতে নিয়ে যদি তৃপ্তি না পাই, মনে একটা ‘ভালো লাগা’র অনুভূতি কাজ না করে, তবে সে বই পড়তে ইচ্ছে করে না। শোভাপ্রকাশ খুব দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের সাথে এই ত্রয়ী বইয়ের কাজ করেছে। বই তিনটি একই মোড়কে পাওয়া যাবে। মূল্য ৬০০ টাকা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়