ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘বিশৃঙ্খল স্টল বিন্যাসের কারণে নতুন প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন’

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বিশৃঙ্খল স্টল বিন্যাসের কারণে নতুন প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন’

তামান্না সেতু লেখক ও সংস্কৃতি কর্মী। বাতিঘর সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ের পরিচালক। এ ছাড়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘পাললিক সৌরভ’র সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রধান নির্বাহী হিসেবে। লেখালেখিতে অসাধারণ সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য পেয়েছেন “আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬”। গতকাল এক আড্ডায় বইমেলা এবং এর বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অহ নওরোজ।

কেমন আছেন?
তামান্না সেতু :
বেশ ভালোই আছি

এবারের বইমেলার সঙ্গে গত বইমেলাগুলোর মূল পার্থক্যটি কোথায় মনে হচ্ছে?
তামান্না সেতু :
পার্থক্য হচ্ছে আগের বইমেলায় ভিড়টা প্রোডাক্টিভ ছিল। ভিড় যেদিন হচ্ছিল বেশ ভালোই বই বিক্রি হচ্ছিল। এবারের ভিড় গতবারের তুলনায় কম এবং বই কেনার হারও কম। ভিড়ের তুলনায় কেনাকাটার পরিমাণ কম। একজন প্রকাশক হিসেবেই যে আমি শুধু আশাহত তা নয়, একজন সুনাগরিক হিসেবেও আশাহত।

এর জন্য কি আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কোনো অস্থিরতা দায়ী?
তামান্না সেতু :
আমার কাছে মনে হচ্ছে না যে, এর পেছনে কোনো অস্থিরতা দায়ী। আমরা যদি পেছনে তাকাই- ২০১৬ এবং ২০১৭, এই সময়টাতে কিন্তু বইমেলা নিয়ে আমার এক রকম আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। কারণ অভিজিৎ রায় মারা গেলেন, দীপন ভাই মারা গেলেন এই সময়টাতে। এত কিছুর পরও ওই বছরগুলোতে বইয়ের বিক্রির হার কম ছিল না।

তাহলে কি কারণে বই বিক্রির হার কম?
তামান্না সেতু :
আমার কাছে মনে হচ্ছে গ্রাজুয়ালি এইটা মনে হয় কমবে। এই যে দেখতে শুরু করলাম, এইটা বোধহয় কমতেই থাকবে। আর এর পেছনের কারণ হলো আমরা সন্তানদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করছি না। আর এটি নিয়মিত হলে আরো ১০ বছর পরে নতুন পাঠকের পরিমাণ হয়তো কমে ১০ ভাগের এক ভাগে চলে আসবে।

অনেককে দেখা যায় বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে, এর পেছনে লগ্নি করে পকেটের টাকাও। এই সংকটটার পেছনে দায়ী আসলে কারা?
তামান্না সেতু :
আমার কাছে মনে হয় এর পেছনে দায়ী আমরা প্রতিটি জনগণ। সব সমস্যার এক সমস্যা হলো বাচ্চাদের বই পড়ার ইচ্ছা গড়ে না তোলা। তুলনামূলক এটি দিন দিন কমছে। এখনকার জেনারেশনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই- হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল খুব পড়ছে শিশুরা। কিন্তু এর বাইরেই সাহিত্যের আসল পৃথিবী সেটি তারা বুঝতে চাইছে না, পারছে না, বাবা মায়েরাও সাহায্য করছে না সে বিষয়ে। আর যদিও এর বাইরে কোনো বই পড়ে থাকে তার পরিমাণ অনেক কম।

এর পেছনে ভালো বই আবিষ্কার করে খুঁজে বের না করার ইচ্ছাটাও তো দায়ী।
তামান্না সেতু :
সেটা তো অবশ্যই। আমাদের অধিকাংশ পাঠক অনেকটা হুজুগে টাইপের। কারো নাম শুনলে হয়েছে একবার। সেই পাঠকের বই ছাড়া খুঁজে বের করে অন্য কারো বই যে কিনবে সেই সময় যেন নেই। এই কথাটি কিন্তু জাফর ইকবাল স্যার নিজেও বলেন। একদিন জাফর ইকবার স্যারের সাথে আমরা গোলটেবিল বৈঠকে বসে ছিলাম। সে সময়ে এক ছাত্র বলল, সে শুধু জাফর ইকবাল স্যার এবং হুমায়ূন স্যারের লেখা পড়ে। এটা শোনার সাথে সাথে জাফর ইকবার স্যার ধমক দিয়ে বললেন, তার মানে তুমি এখনো চানাচুর খাও। এর বাইরে পড়, বই এক্সপ্লোর কর।

এবারের বইমেলায় কেমন ধরনের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে?
তামান্না সেতু :
এবারের বইমেলায় দেখছি ক্যারিয়ার নিয়ে করা কিছু বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। যদিও এই ধরনের বই আমি প্রকাশ করিনি। আমি বলব না এগুলোর দরকার নেই, কিন্তু যেভাবে এগুলোর ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। আবার এসব বইয়ের নামও চটকদার, “এক মিনিটে ইংরেজি শিক্ষা” গাইডবই টাইপের বই। কিন্তু এটা তো সৃজনশীল লেখকদের মেলা। যারা বিক্রি করছে তারা করছে, আমি জানি না বাংলা একাডেমি কীভাবে এটার অনুমতি দিল; কিন্তু বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। বাবা মা-ই উৎসাহ দিচ্ছেন। সুতরাং মননশীলতার জায়গা নিয়ে বাবা-মা ভাবছেন না, ভাবছেন শিশুর ক্যারিয়ার নিয়ে। অথচ মননশীলতার জায়গাটা যদি ঠিক না থাকে ক্যারিয়ার তৈরি করে কী হবে?

লিটল ম্যাগাজিন কর্নার এইবার উদ্যান অংশে আনার পরিকল্পনা ছিল, পরে আবার সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?
তামান্না সেতু :
আমার কাছে মনে হয়, লিটল ম্যাগাজিন কর্নার মূল মেলার সাথে অর্থাৎ উদ্যান অংশে রাখা উচিত। তাতে করে পাঠক দুইটি লিটল ম্যাগাজিন বেশি দেখার সুযোগ পাবেন। আমি মনে করি এই বিষয়টি নিয়ে আবারো ভাবা উচিত। হুজুগে চিন্তায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।

এবারের বইমেলায় আপনার নতুন বই কয়টা এসেছে?
তামান্না সেতু :
আমার বই সাধারণত বইমেলাকে উপলক্ষ করে বের হয় না। তবে গতবারের বইমেলার পর থেকে এবারের বইমেলার আগ পর্যন্ত যে বইগুলো বের হয়েছে ৩টি বই; শিশুদের জন্য লেখা “ভবিষ্যতের জন্য”-এর পরের সিক্যুয়াল এসেছে। এসেছে “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়” শিরোনামের একটি বই, এই বইটি শিশুদের বয়ঃসন্ধির ওপরে লেখা। ওই সময়টাতে তারা যে প্রবলেম ফেস করে সেগুলোর ওপরে লেখা। ওই সময়টাতে বাবা মায়ের কাছে অনেকেই হেল্প পায় না, আশা করি এই বইটা ওদের ওই সময়ের সঙ্গী হবে। এ ছাড়া একটি গল্পের বই এসেছে যার নাম “মা আর আমি স্বপ্ন দেখি”। এটার মূল মেসেজ কর্মজীবী মায়েদের নিয়ে। কর্মজীবী মায়েরা সাধারণত বাচ্চাকে সময় দিতে পারে না, অনেক বাচ্চা একটি উপলব্ধি করতে পারে না। এই বইটি বাচ্চাদের সেই উপলব্ধির জায়গাটি উন্নত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

একজন প্রকাশক হিসেবে, এইবার বইমেলার কোন দিকগুলোতে আরো উন্নয়ন  করার দরকার বলে মনে করেন?
তামান্না সেতু :
প্রকাশক হিসেবে যদি বলি, তাহলে প্রথমে আমি বলব স্টল বিন্যাস ঠিকভাবে করা উচিত। যাতে করে সব স্টলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। বিশেষ করে এই বিশৃঙ্খল স্টল বিন্যাসের সমস্যার কারণে প্রকাশকরা ক্ষতির মুখে পড়ছে বেশি। যেহেতু নতুন প্রকাশকদের ডিস্ট্রিবিউশন কম সেহেতু তাদের সারা বছরের অধিকাংশ বইই বিক্রি হয় এই বইমেলায় আর বইমেলায় এসে এমন ব্যাপারের মুখোমুখি হলে তো ক্ষতির মুখে পড়তেই হয়।

এ ছাড়া বাংলা একাডেমির কিছু নিয়ম আছে লিফ্লেটিং করা যাবে না। কিন্তু মানুষ এগুলো মানছে, কিছু মানছে না। বইমেলা প্রাঙ্গণ ঘুরলেই দেখা যাবে লিফলেটের ছড়াছড়ি। এই বিষয়টির ওপর বাংলা একাডেমির নজর দেওয়া উচিত ছিল। আর একজন লেখক জানেন যে, এগুলো পরিবেশ নষ্ট করে তারপরও তিনি কীভাবে লিফলেট দেন মাথায় আসে না। এইটা একজন প্রকৃতি লেখকের কাজ হতে পারে না।

এবারে কেমন ধরনের বই কিনবেন?
তামান্না সেতু :
প্রতিবারের মতো এবারো নতুন লেখকদের বই কিনব বেশি। আমি ৬০ ভাগ টাকা বরাদ্দ রাখি নতুন লেখকদের জন্য। ভালো লেখা খুঁজে বের করব। আসলে আমাদের সবারই উচিত নতুনদের পৃষ্ঠপোষকতা করা।

এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তামান্না সেতু :
আপনাকে ধন্যবাদ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/অহ/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়