ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জলে ভাসা জীবন (প্রথম পর্ব)

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলে ভাসা জীবন (প্রথম পর্ব)

জুনাইদ আল হাবিব : ‘ছবিগুলো কিত্তো তোলেন? আঙ্গো কেউ কোনো খোঁজখবর নেয় না। শুধুক্যাল ছবি তোলে তোলে নিয়ে যায়। কোনো লাভ নাই। আমাগোল্লাই কোনো কিচ্ছু থাকে না। ভোটের সময় ভাই ভাই, চিনির সময় আমি নাই, গমের সময় একপা নেন।’

- এভাবেই আক্ষেপ ছুড়ে কথাগুলো বলছিলেন একজন ভাসমান নারী জেলে। নাম ফাতেমা আক্তার। বয়সের দিকে ৪০ ছুঁতে চলেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে দ্বীপ জেলা ভোলার শিবপুরের বাসিন্দা হলেও ফাতেমা আক্তারের জীবন ঠিকানাবিহীন। আজ এক জায়গায় তো কাল আবার আরেক জায়গায় যান জীবিকার টানে। যেখানেই মাছের দেখা পান, সেখানেই ভাত জোটে। বর্তমান অবস্থান লক্ষ্মীপুরে।

মেঘনাপাড়ের মতিরহাট সৈকতে গিয়ে ছবি তুলতে গেলে অচেনা মানুষের ছবি তোলা দেখে একপ্রকার ক্ষেপেই গেলেন। সারা জীবন শুধু দেখেই এসেছেন, কত মানুষ ছবি তুলেছেন, কলমের কালি খরচ করে নাম নিয়েছেন, কিন্তু ফাতেমার ভাগ্য বদল হয়নি। একটু কাছে গেলাম। বুঝিয়ে বললাম, আপনাদের খবর সরকারের উপরিমহল জানে না। সেজন্য আপনারা তথ্য দিন, আপনাদের জন্য লিখবো। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে নয়, কোনো না কোনো দিন হলেও আপনাদের কথা সরকার ভাববে। এবার একটু সান্ত্বনা পেলেন ফাতেমা আক্তার। পরপরই বললেন, ‘দ্যাখেন কিভাবে সংসার, পোলাপাইন নিয়া থাকি। আমাগোর জন্য কেউ কিছু নিয়া আসে না। নৌকা দিয়ে মাছ ধরি আবার সে নৌকায় থাকি। নিজেরা না খেয়ে থাকতে রাজি। কিন্তু পোলাপাইনরে কিভাবে উপায়া রাখি? আমাগো কথা একটু বলবেন সরকারের কাছে।’

 



ফাতেমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাজির তাঁর মা কহিনুর বেগম। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। বৃদ্ধ হলেও কাজ থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেননি। বৃদ্ধ বয়সে যার মাথা গোঁজার জায়গা নেই, তিনি কীভাবে কাজ না করে খাবেন? সেটাও একটা ভাবার বিষয়। কহিনুর বেগম খুব ব্যস্ত। নদীতে গিয়ে কিছু মাছ পেয়েছেন। সে মাছ ঘাটে বিক্রি করে বাজার-সদাই এনেছেন। টমেটো, আলু, ধনিয়া। বেশ তাড়াহুড়া করছেন। দুপুরের খাওয়া এখনো পেটে স্থান পায়নি। অথচ সময় তখন পড়ন্ত বিকেল। এখন কহিনুর বেগমের চুলায় রান্না হবে, দুমুঠো ভাত পেট ভরে খাবেন। কহিনুর বেগমের সঙ্গে গল্প শেষে দেখা আরেকজন ভাসমান নারী জেলে শান্তা আক্তারের সঙ্গে। কয়েক বছর হবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বামী মনির হোসেন নদীতে গেছেন। তাই শান্তাও বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন রান্না-বান্নায়।

হারুণ মাঝি ও হুমায়ুন মাঝি। দুজনের বয়স ৫৫ ও ২২। মাত্র নৌকায় মাছ ধরে ফিরেছেন। পেটে খিদা মেটানোর মতো কিছু মাছ পেয়েছেন। এক নৌকায় মাছ ধরেন। আরেক নৌকায় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকেন। দুজনেই বললেন, তারা সৌর বিদ্যুতের বাতি জ্বালাতে চান তাদের নৌকায়। তাই সেজন্য চেষ্টা করছেন বেশ কঠোরভাবে।

মেঘনাপাড়ে সারি সারি ব্যতিক্রমী এসব নৌকা দেখলে যে কেউ বুঝবেন এগুলো স্থানীয় কোনো জেলেদের নৌকা নয়। অতিথি পাখির মতোই এখানে ভাসমান জেলেদের আগমন ঘটে। আবার ফিরে যায় তারা। সাধারণত এরা মানতা জনগোষ্ঠী হিসেবেই অধিক পরিচিত।

 



মেঘনাতীরের মতিরহাট বাজারের দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁয়ে এবারের গন্তব্য বাজারের উত্তর প্রান্তে। জোয়ার পানির ওপর ভাসছে তাঁদের নৌকা। কথা হয় কুলছুম আরা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমন দেশে থাই, যেন আঙ্গো কেউ নেই। গাঙ্গে থাই বলে আঙ্গো দিকে কেউ চায় না। একমাত্র আল্লার ওপর ভরসা করি বাঁচি আছি। কত মানুষ সরকারের কাছ থেকে টন টন চাল পায়। আমরা পাই না। আঙ্গো কতা কেউ কয় না।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়