ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন: উৎসের গভীরে

সাইফুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাষা আন্দোলন: উৎসের গভীরে

সাইফুজ্জামান: ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের বাতিঘর। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র পশ্চিম ও পূর্ব দুই অংশে বিভক্ত ছিল। ভৌগোলিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিস্তর পার্থক্য দুই অঞ্চলে প্রকট ছিল। ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রচার মাধ্যমে উর্দু প্রচলনের সুপারিশ করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় বাংলা বিষয় বাদ দেয়া হয়। মুদ্রা ও ডাকটিকেট থেকে বাংলা বর্ণমালা বর্জন করা হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকারের ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা বাংলা ভাষাভাষি পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত জনমনে ক্ষোভ ও দ্রোহের সঞ্চার করে। পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীরা ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করে। এ সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দানের দাবি উত্থাপন করা হয়। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে আবুল মনসুর আহমদ উল্লেখ করেন, ‘উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ নিরক্ষর এবং সরকারি সকল পদের ক্ষেত্রেই অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।’

বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এ পরিষদের আহবায়ক মনোনীত হন তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নুরুল হক ভূইয়া। পরে সংসদ সদস্য শামসুল হক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাবে ইংরেজি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি সরকারি কাজে বাংলা প্রচলনের বিষয়টি অনুমোদনের অনুরোধ করেন। তমিজউদ্দীন খানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সদস্যরা এ প্রস্তাবেব বিরোধিতা করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে প্রতিবাদ জানায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৯ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র বুদ্ধিজীবী এক সমাবেশে মিলিত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি উত্থাপন করে। শামসুল আলমকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। ১১ মার্চ বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহাবুব, রওশন আলম প্রমুখদের। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন- উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রছাত্রীরা এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একই বিষয়ে বক্তৃতা দেন। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা ‘না, না’ চিৎকারে প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের উপস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি উত্থাপন করা হয়।

১৯৪৮ সালে আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন পল্টন ময়দানে বক্তৃতায় উল্লেখ করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’।  ঘোষণার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা ও ৩০ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার এক সমাবেশ থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ভঙ্গ করবে বলে জানান হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। পুলিশ সভাস্থলের চারপাশে পাহারা দিতে থাকে। জমায়েত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি বর্ষণ শুরু করে। আইন পরিষদের সদস্যরা আইন সভায় যোগ দিতে আসলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের বাধা দেয়। পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। আবদুল জব্বার, রফিক উদ্দীন, আবদুস সালাম, আবুল বরকত ও কিশোর আহিউল্লাহ নিহত হয়। ঐ দিন গণপরিষদের অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি মুহূর্তে মওলানা তর্কবাগীশ ভবন ত্যাগ করে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ২২ ফেব্রুয়ারির রাত থেকে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। ছাত্ররা ইট সংগ্রহ করে। বালির সাথে সিমেন্ট মিশিয়ে স্তম্ভ তৈরি করা হয়। তিনশ ছাত্রদের সাথে দুই জন পেশাদার রাজমিস্ত্রি কাজে যোগ দেয়। শহীদ মিনারের নকশা তৈরি করেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সাঈদ হায়দার। তার সাথে সঙ্গী ছিলেন বদরুল আলম। মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত শহীদ মিনার ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের পিতা।

ভাষা আন্দোলন জাতীয় জাগৃতির স্মারক। ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল না। গ্রাম, ইউনিয়ন, মহকুমা ও জেলা শহরে ঢাকায় পড়তে আসা একদল ছাত্রছাত্রীরা ফিরে গিয়ে আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরে। পোস্টার লেখা, লিফলেট তৈরি করা সভা সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন-সংগ্রাম বেগবান করে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি স্মরণীয় মুহূর্তে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত ও ঘটনাবলি জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশ অফিস আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। শুদ্ধ বাংলা লেখা আজো সম্ভব হয়নি। বিপণিবিতান, স্কুল, কলেজের সাইনবোর্ডে ভুল বাংলা ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পরিবারে বাংলা ভাষার চর্চা নেই। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে হিন্দি, ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া তাদের পাশ্চাত্য চেতনায় আচ্ছন্ন করছে। এ প্রজন্মকে বাঙালিয়ানায় উদ্বুদ্ধ করা, বীর যোদ্ধাদের গৌরবগাথার সাথে পরিচিত করার কার্যক্রম পরিবার থেকে শুরু করতে হবে প্রথমে। বাঙালির অর্জন, গৌরব ধারণ করতে হবে। ভাষা আন্দোলন জাতীয় গৌরবের মাইলফলক। এ আন্দোলনের পথ ধরে এসছে ধারাবাহিক সংগ্রাম ও অর্জন। বাংলাদেশ দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। তরণ প্রজন্ম পৃথিবীব্যাপী মেধা, জ্ঞানে, যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। তারা যেন শেকড়-বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দেশপ্রেম প্রতিটি বাঙালির অহঙ্কার।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়