ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ডিজিটাল উপকূল-৪

উপকূলে দুর্যোগ মোকাবেলায় সঙ্গী তথ্যপ্রযুক্তি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৯ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলে দুর্যোগ মোকাবেলায় সঙ্গী তথ্যপ্রযুক্তি



‘ঝড়ের রাত। ধেয়ে আসছে দুর্যোগ। বিদ্যুত চলে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। কোনো খবর পাচ্ছি না। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। মোবাইলের বাটন টিপে জেনে নেই শেষ খবরটা। ভয়ের কারণ নেই। ঝড়ের গতিবেগ পাল্টে গেছে। ঝড়  অন্যদিকে ছুঁটছে।’

তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভরসা পাওয়া এবং নিজেদের নিরাপদে রাখার এই গল্প শোনাচ্ছিলেন ভোলার মনপুরা উপজেলার সমুদ্র মোহনার চর নিজামের বাসিন্দা মজিবর রহমান। সর্বশেষ আপডেট জানতে তিনি মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের খবর পান সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসে। এই প্রান্তিকে অবস্থানের কারণে দুর্যোগের তথ্য তার সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে। মজিবর রহমান বলেন, ‘হাতের মুঠোয় সবকিছু পেয়ে বেঁচে থাকার ভরসা তৈরি হয়েছে। যাতায়াতের দিক থেকে চর নিজাম বিচ্ছিন্ন হলেও আনলাইনে এখানকার মানুষ সারাক্ষণ সংযুক্ত থাকছে কেন্দ্রের সঙ্গে। রাত যতই গভীর হোক, ঝড়ের রাতে যতই আঁধার নামুক, তথ্যপ্রযুক্তি দ্বীপের মানুষদের পথ দেখায়। সাহস যোগায়। অথচ এক সময় এখানকার মানুষ ঝড়ের সংকেত পেলে দিশেহারা হয়ে পড়ত জীবন সঙ্কটের কথা ভেবে।’

কক্সবাজারের দ্বীপ মহেশখালীর ধলঘাটার বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, ‘দুর্যোগের সিগন্যাল ঘোষণা করা হলে সবার দৃষ্টি যায় মোবাইল স্ক্রীনের দিকে। বাটন টিপে সহজেই জানা যায় সর্বশেষ তথ্য। রাষ্ট্রের উত্তপ্ত পরিস্থিতির খবর কিংবা বর্হিবিশ্বের খবর জানতেও একই কৌশল। এখানে খবরের কাগজ আসে না। কিন্তু মোবাইল থেকে সব ধরণের খবরসহ জীবন বদলের নানান তথ্য পাই।’ 

এভাবেই দেশের সর্বদক্ষিণে জেগে থাকা সমুদ্র তীরবর্তী বিচ্ছিন্ন উপকূলের মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে কেন্দ্রের সঙ্গে। অনলাইন নিউজপোর্টাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের তথ্যভিত্তিক সাইট মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে বিপন্ন মানুষের কাছে। এককালের অন্ধকারে ডুবে থাকা জনপদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সেখানে যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির আলো। একইভাবে দুর্যোগকালে রেডিও’র সহায়তার কথা জানাচ্ছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের রেডিও শ্রোতা আবুল হোসেন। সেখানে তিনি নিয়মিত শোনেন স্থানীয় রেডিও ‘সাগরগিরি’। এখান থেকেই পান দুর্যোগসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য। স্থানীয় পর্যায়ের নানান তথ্য পান রেডিও থেকে। উপস্থিত আরও কয়েকজন শ্রোতা জানালেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই রেডিও মানুষের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত করবে কিনা, এলাকার মানুষ বুঝতে পারছিলেন না। এই সময় রেডিও তাদের পথ দেখায়। শুধু জরুরি আবহাওয়া বার্তা নয়, সেইসঙ্গে দিক-নির্দেশনাও প্রচার করে। দুর্যোগে বিদ্যুৎ না থাকলেও জেনারেটর দিয়ে স্টেশনের কার্যক্রম চালু রাখা হয়।
 


সংশ্লিষ্টরা জানালেন, সমুদ্র উপকূলবর্তী এই এলাকায় কমিউনিটি রেডিওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জরুরি আবহাওয়া বার্তা প্রচারে। বিদ্যুৎ চলে গেলে এই এলাকার সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা সমুদ্রের জেলেরা কোনো ধরনের তথ্য পান না। এমনকি সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলে থাকা লোকজনও তথ্য শূন্যতায় থাকেন। ফলে জরুরি মুহূর্তে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এ কারণেই কমিউনিটি পর্যায়ের এই রেডিও স্থানীয় মানুষদের জরুরি বার্তা দিয়ে, দিক-নির্দেশনা দিয়ে সচেতন করতে পারছে।

দেশের উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে ৮টি কমিউনিটি রেডিও। এগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরার রেডিও নলতা, খুলনার কয়রায় রেডিও সুন্দরবন, বরগুনার লোকবেতার, বরগুনার আমতলীর কৃষি রেডিও, কক্সবাজারের টেকনাফের রেডিও নাফ, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের রেডিও সাগরগিরি, ভোলার চরফ্যাসনের রেডিও মেঘনা এবং নোয়াখালীর হাতিয়ার রেডিও সাগরদ্বীপ। এসব রেডিও স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, উপকূল অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে এ রেডিওগুলো আবহাওয়া বার্তা তথা দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ‘রোয়ানু’, ‘মহাসেন’সহ বিভিন্ন দুর্যোগে রেডিওগুলো বার্তা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রান্তিক জনপদের বহু মানুষ মোবাইলেই রেডিও’র বার্তা শুনতে পারছেন; এজন্য রেডিও সেটের প্রয়োজন পড়ে না।

কমিউনিটি রেডিও স্টেশন সূত্র বলেছে, দুর্যোগের সময় সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ বিষয়ক মনিটরিং সেলের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং সমন্বয় রেখে স্টেশনগুলো কাজ করে। রেডক্রিসেন্ট, স্কাউট ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সাথেও কমিউনিটি রেডিও স্টেশনসমূহ যোগাযোগ রেখে তাদের কাছ থেকে বার্তা, তথ্য নিয়ে সম্প্রচার করে। রেডিও স্টেশনগুলো স্থানীয় প্রশাসন থেকে সরবরাহকৃত বার্তাসমূহ সম্প্রচারের পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এ ছাড়াও দুর্যোগের সময় খবর, কথিকা, সর্বশেষ বার্তা, পূর্বে প্রস্তুতকৃত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সরকারি বিভিন্ন হ্যান্ডবুক, বুকলেট, লিফলেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে শ্রোতাদের সহায়তা করে। দুর্যোগের সময় ছাড়াও ‘উপকূল জীবন’ নামের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠান দুর্যোগের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক বার্তা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। দুর্যোগ পূর্ব ও পরবর্তী প্রস্তুতি এবং প্রশমনের মধ্যদিয়ে উপকূলের জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ঝুঁকিসমূহ সম্পর্কে বার্তা দেয়া এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয় এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

জানা গেছে, উপকূলে কমিউনিটি রেডিও স্টেশনগুলো ঘিরে রেডিও শ্রোতা ক্লাব গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে স্বেচ্ছাসেবক দল। এরা নিজেদের পরিবার, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ গতিপ্রকৃতি, ভয়াবহতা, করণীয়, আশ্রয়স্থলের তথ্য, ঠিকানা, সংবাদসহ বিভিন্ন তথ্য পৌঁছে দেন। করণীয় সম্পর্কে সকলকে সজাগ করেন। তারা কমিউনিটি রেডিওর শ্রোতা এবং শ্রোতাক্লাবের সদস্য হিসেবে তথ্য নিয়ে আশেপাশের লোকজনকে তথ্য প্রদান করেন। একই সাথে তারাই আবার মাঠ পর্যায়ের খবর রেডিও স্টেশনে পৌঁছে দেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।

সীতাকুন্ডে অবস্থিত রেডিও সাগরগিরি’র প্রযোজক (কারিগরি) সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে অ্যাডভোকেসির কাজে কমিউনিটি পর্যায়ের এ রেডিও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে এলাকার তরুণ সমাজ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও একদল শ্রোতা তৈরি হচ্ছে, যারা রেডিওর খবরের ওপর নির্ভর করে নিজেদের জীবনমানের পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। দুর্যোগকালে শ্রোতাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে রেডিও।’   সাগরগিরি পরিচালনাকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা’র নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েক বছরে উপকূল অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর সুফল পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রেডিওর মাধ্যমে তারা আরও কার্যকরভাবে এই সেবা পাচ্ছে। জীবনের প্রয়োজনে মানুষের হাতে থাকা ছোট মোবাইলটা দিয়েই তারা রেডিও শুনতে পারছে। তৃণমূলের মানুষদের যত বেশি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা যাবে, তারা ততটাই দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবেন।’
 


সূত্র বলছে, উপকূলের প্রান্তিক জনপদে অবস্থিত ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোও আবহাওয়া বার্তা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আবহাওয়া খারাপ হলে দুর্যোগের তথ্য জানতে বহু মানুষ ভিড় করেন ওই সেন্টারগুলোতে। অধিকাংশ স্থানে বিদ্যুৎ চলে গেলেও বিশেষ ব্যবস্থায় চালু থাকে ডিজিটাল সেন্টার। এই সেন্টারগুলোতে এলে যে আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যাবে; সে বিষয়টি অধিকাংশ মানুষের জানা। সেন্টারগুলো স্থানীয় বাজারে অবস্থিত হওয়ায় মানুষজন সহজেই সেখানে যেতে পারেন।

সমুদ্রের কাছে জেগে থাকা পটুয়াখালীর এক দ্বীপ চরমোন্তাজ। এখানকার ঘাটে ভেড়ে মাছধরা ট্রলার। হাজারো জেলে, মাছ ব্যবসায়ী আর মাছধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পদচারণায় বছরের অধিকাংশ সময় মুখর থাকে এই দ্বীপ। ‘স্লুইজ বাজার’ নামের এক টুকরো রাজধানী ঘিরে জেগে থাকে তাদের জীবন। অবস্থাটা এমন যে, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে (স্লুইজ বাজার) গিয়ে সিনেমা দেখা। নানা কাজে মানুষ ছুটে আসে এই বাজারে। এখানে অবস্থিত চরমোন্তাজ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। দুর্যোগের সময় ঘাটের বহু জেলে আবহাওয়া বার্তা শুনতে সেন্টারে ভিড় করেন। সেন্টারের পরিচালক আল-মামুন বলেন, ‘দুর্যোগের সময় কেন্দ্রের ছোট্ট কক্ষে বহু মানুষের ভিড় জমে। তারা আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য জানতে চান। বহু জেলে মাছ ধরতে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। তারা নদীতে নামবেন কিনা, সে সিদ্ধান্তের জন্য ছুটে আসেন ডিজিটাল সেন্টারে।’

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা জানান, নদী ও সাগরে প্রতিদিন হাজার হাজার জেলে মৎস্য শিকারে যায়। এদের কাছে বিভিন্নভাবে আবহাওয়া বার্তা পৌঁছায়। এদের অনেকে বরগুনার কমিউনিটি রেডিও স্টেশন লোকবেতার থেকে প্রচারিত বার্তা শুনে পদক্ষেপ নেয়। মাছ ধরতে নামবে কিনা, ঝড়ের গতি কোন দিকে যাচ্ছে, এসবের জন্য তারা রেডিওর উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।  কথা হলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত আরও কয়েকজনের সঙ্গে। দুর্যোগের তথ্য কোথা থেকে পান? এমন প্রশ্নের জবাবে ভোলার চরফ্যাসনের শামরাজের জাবের হোসেন, লক্ষ্মীপুরের টাংকি বাজারের মো. লোকমান, রামগতির চর গজারিয়ার আলাউদ্দিন মাস্টার, ভোলার ইলিশার জেসমিন, দুলাল হাওলাদার- সকলেরই একই কথা মোবাইলে অথবা বাজারে কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে থবর জানি। এদের সকলেই জানালেন, এখন যেভাবে হাতের কাছে খবর পাই, আগে সেই সুবিধা ছিল না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়