ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলাদেশে ডায়াসপোরা সাহিত্যপাঠে সমস্যা

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০০, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশে ডায়াসপোরা সাহিত্যপাঠে সমস্যা

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন ||

বাংলাদেশে স্বদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের ক্ষেত্রে মোটা দাগে দুটি অভিযোগ ওঠে। এক. তারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখক নন; কিন্তু তারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। দুই. তারা বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন।

প্রথম অভিযোগ নিয়ে কথা হলো, বাংলাদেশের ভেতরেও কিন্তু শ্রেষ্ঠ লেখকদের জনপ্রিয়তা ও পঠন-পাঠন কম। অনেক দুর্বল লেখক এখানেও জনপ্রিয় হচ্ছেন। তুলনামূলক বিচারে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের চেয়ে হুমায়ূন আহমেদ বড় লেখক নন। কিন্তু দেখা যাবে, হুমায়ূন আহমেদের একটি বই যে পরিমাণ কপি বিক্রি হয়েছে, হাসান আজিজুল হকের সমগ্র বই মিলেও হয়ত তত কপি বিক্রি হয়নি। ভারতের প্রসঙ্গ টেনেও আমরা বলতে পারি, বিশ্বে ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকরা কিন্তু সেই দেশের শ্রেষ্ঠ লেখক নন। অরুন্ধতী-ঝুম্পা লাহিড়ীর চেয়েও অনেক ভালো লেখক সেখানে আছেন। ইংরেজি বাদে ভারতীয় কোনো না কোনো ভাষায় লিখছেন। একই কথা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও খাটে। তাই এই অভিযোগ করে লাভ নেই।

দ্বিতীয় অভিযোগ নিয়ে কথা হলো, বাংলাদেশে বসে আমরা যারা লিখছি, তারাও কি সবসময় বাংলাদেশকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি? তাছাড়া এই সঠিক-বেঠিক নির্ণয় করা হবে কোন ভিত্তিতে? লেখক স্বাভাবিকভাবে তার ভার্সনটা বেছে নেবেন, পাঠক সেটি মিলিয়ে নেবেন নিজের সঙ্গে। পাঠকের সত্য, লেখকের সত্য সবসময় একসত্য হয়ে উঠবে না। তাছাড়া ডায়াসপোরা লেখকদের সবসময় এই বিতর্কে জড়াতে হয়েছে। সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক ইশিগুরো অল্পবয়সে জাপান ছেড়ে লন্ডন চলে যান। লন্ডনে বসে তিনি জাপানি প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লিখেছেন। তার লেখার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান। তিনি বলছেন, ‘স্মৃতি খুব অনির্ভরযোগ্য।’ অন্যত্র বলছেন, ‘আমি যেমনটি বলি, আমি নিশ্চিত এই অভিব্যক্তি যথার্থ নয়, কিন্তু এভাবেই গোধূলিটা স্মৃতিতে আমার আছে।’ একই কথা নাইপলও বলছেন তাঁর ‘এ ওয়ে ইন দি ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসে। তিনি বলছেন, ‘আমরা (ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী) বংশানুক্রমে যা ধারণ করি, সবকিছু বুঝে করি না। ফলে কখনো কখনো আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের অপরিচিত মনে হয়।’ রুশদিকে বলতে হয়েছে, ‘আমরা স্বশরীরে ভারতে এখন নেই, অনিবার্যভাবে এর অর্থ হলো, ঠিক যে-জিনিসটা আমরা হারিয়েছি সেটা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়; এককথায়, আমরা তৈরি করে বসব কাহিনি, সত্যিকারের শহর বা গ্রাম নয়, বরং এমন শহর বা গ্রাম যা কোথাও দেখা যায় না, কল্পনায় স্বদেশ, অনেকগুলো মনগড়া ভারত।’ [‘কল্পনায় স্বভূমি’, অনুবাদ : অভিজিৎ মুখার্জি]

এভাবেই বিশ্বসাহিত্যে স্বদেশ-বিদেশ ভেঙে যে অন্তর্বয়ান ও মহাবয়ানের মিশ্রণে নতুন এক বিশ্ববয়ানের সৃষ্টি হচ্ছে, তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি নাইপল-রুশদি-ইশিগুরোর মতো লেখকদের গ্রহণ করতে পারি, এটা জেনেও যে তারা তাদের পিতৃমাতৃভূমির বিশ্বস্ত কথক নন, তাহলে স্বদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের গ্রহণ করতে সমস্যা কোথায়? তার মানে এই নয় যে, তাদের সমালোচনা হবে না। তাদের সাহিত্যমান ও অসঙ্গতি ধরে গঠনমূলক সমালোচনা হোক। কিন্তু সেটা করতে হলে তাদের আগে গ্রহণ করতে হবে। পড়তে হবে, পরস্পরকে জানতে হবে।

তাহমিমা আনাম ও তার গার্মেন্টস গল্প ধরে সৃষ্ট বিতর্ক
২০১৭ সালে ‘গার্মেন্টস’ ছোটগল্পের জন্য ও’হেনরি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক তাহমিমা আনাম। ‘বাংলা ট্রিবিউন’ ও দৈনিক ‘প্রথম আলো’র সাহিত্যপাতায় গল্পটির অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ফেসবুকে পুরস্কৃত গল্পের সঙ্গে সঙ্গে লেখক তাহমিমা আনামের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের লেখকবৃন্দ। এর আগে তাহমিমা আমান তার প্রথম উপন্যাস ‘আ গোল্ডেন এজ’ (A Golden Age, ২০০৭)-এর জন্য ২০০৮ সালে কমনওয়েলথ সেরা প্রথম বই পুরস্কার পেলে এবং দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য গুড মুসলিম’ (২০১১)-এর জন্য ‘ম্যান এশিয়ান লিটারারি প্রাইজ’-এর জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হলে একইরকম সমালোচনা হয়েছিল। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক চান না তাহমিমা আনামের লেখা বাংলাতে অনূদিত হোক, বা বাংলা ভাষাভাষীর পাঠক পড়ুক। যেমন তাহমিমা আনামের আলোচ্য গল্পটি আমি বাংলায় অনুবাদ করার পর কথাশিল্পী জাকির তালুকদার তার ফেসবুক ওয়ালে আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে পোস্ট দেন, ‘এখন আছো ঘোরের মধ্যে। এখনো গল্প লেখা শেখোনি। (অনেকেই সারাজীবনে শিখতে পারে না)। সেটা পুষিয়ে নিচ্ছ কেবলমাত্র ওপরঅলাদের তোষামোদি করে, প্রভাবশালীদের সাথে লিঙ্ক তৈরি করে। এই গল্প (গার্মেন্টস, তাহমিমা আনাম) অনুবাদ করার পেছনেও তোমার সেই একই উদ্দেশ্য।’ (ফেসবুক পোস্ট, জাকির তালুকদার)

এখন প্রশ্ন হলো, এই সমালোচনার পেছনে কারণটা কী? তাহমিমা আনামের সমস্যা কী- উনি স্বনামধন্য পিতার কন্যা; এটা? নাকি উনি মধ্যমানের লেখক হয়েও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছেন; এটা?

আমরা ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের ক্ষেত্রে একটা বিষয় বোধহয় গুলিয়ে ফেলছি- তাহমিমা আনাম বাংলাদেশে থেকে বাংলা ভাষায় লেখেন না। কাজেই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তিনি বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যভাণ্ডার মানসম্মত অনুবাদ হয়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্যবাজারে যাচ্ছে না; এটা আমাদের জাতীয় আফসোস। এর জন্য তাহমিমা আনাম দায়ী নন। তাই তাহমিমা না লিখলে বাংলাদেশ থেকে আরো যোগ্য কেউ তার আসনে থাকতেন, সেটা বলা যাচ্ছে না। তার কিছু লেখা আমি পড়েছি। নিশ্চিত করেই খুব আপ্লুত হওয়ার মতো কিছু পাইনি। কিন্তু এটাও সত্য তাহমিমা আনামের চেয়ে অনেক খারাপ লিখে বাংলাদেশে মিডিয়ার বদৌলতে জনপ্রিয় লেখক বনে গেছেন অনেকে।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহমিমা আনাম তার লেখায় বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন কি না? ইংরেজিতে লেখার কারণে তার বক্তব্য যেহেতু বিশ্ববাসীর নজরে আসছে, কাজেই বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার অধিকার তার নেই বলে আমরা মনে করতে পারি। পূর্বেই বলেছি নাইপল-রুশদির বিরুদ্ধেও তাদের পৈতৃকভূমি ভারতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগ উঠেছে। ডায়াসপোরা থেকে যারা লেখেন, তাদের এইসব সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে স্বদেশি পাঠকরা আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। এটা তো ঠিক যে, তাহমিমার মতো ইউরোপের বাইরে থেকে যারা ইংরেজি মাধ্যমে লিখছেন, তারা স্বদেশি পাঠকদের জন্য লেখেন না, লেখেন সেসব বিদেশি পাঠকের জন্য, যারা তাকে পড়েন। ওরহান পামুক স্পষ্ট করে বলছেন, ‘আজকের বিশ্বের সাহিত্যিকরা তাদের স্বদেশি মেজরিটির জন্য কম লিখেছেন (যারা তাদের পড়ে না)। তারা লিখছেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঠককুলের জন্য, যারা তাদের পড়ে।’ [তুমি কার জন্য লেখ? তর্জমায় বর্তমান আলোচক] পামুকের কথার প্রমাণ পাই আমরা যখন জানতে পারি নোবেলজয়ী ইশিগুরোর অধিকাংশ বইয়ের কাহিনি স্বদেশ নিয়ে হলেও স্বদেশের বেশিরভাগ লাইব্রেরিতে তার বই পাওয়া যায় না। নোবেল জয়ের আগের চিত্র এটা। এখন হয়ত বদলেছে। 

ইশিগুরোর মতো তাহমিমা আনামও স্বদেশ নিয়ে লিখছেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন। শিল্পমানে তার লেখা কতটা সমৃদ্ধ, সেটা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হতে পারে যেটা কখনোই হয়নি। যা হয়েছে সেটা হলো তার পারিবারিক পরিচয় ধরে টানাটানি।

তাহমিমা আনাম হালে ও’হেনরির নামে প্রবর্তিত যে পুরস্কারটা পেয়েছেন, সেটা খুব উল্লেখযোগ্য কোনো পুরস্কার নয়। আমরা আলোচনা করছি আমাদের দেশের লেখক এটা পেয়েছেন বলে, না হলে আমরা এর নামই জানতাম না হয়তো। অথচ ১৯১৮ সাল থেকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রতিবছর কানাডা-আমেরিকার সাময়িকীতে প্রকাশিত গল্প থেকে একটা নির্বাচিত গল্পের সংকলন বের হয়। সেই সংকলনে স্থান পায় এই পুরস্কৃত গল্পগুলো। এ বছর তাহমিমার সঙ্গে আরো কয়েকজন পেয়েছেন। তালিকায় রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক শ্রুতি স্বামী, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন পরমাণু রেডিওলজিস্ট অমিত মজুমদার ও লেখক জয় চক্রবর্তী। আমি অন্যদের গল্প পড়েছি। গল্পগুলোর যে মান, তাতে তাহমিমার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। বাংলাদেশে সমালোচনা হচ্ছে তাহমিমা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার জন্য। আমি নিজেও মনে করি ‘গার্মেন্টস’ গল্পে দৃশ্যত কিছু অসংগতি আছে।

বর্তমান বাংলাদেশে আর পঞ্চায়েত প্রথা চালু আছে বলে আমি মনে করি না। থাকলেও সকলের সামনে নারীকে নগ্ন করা হয় বলে আমার জানা নেই। বিদেশের পাঠকরা সেটা বুঝতে পারবেন না। গল্পে দেখানো হচ্ছে, ঘরভাড়া নেওয়ার জন্য তিনজন গার্মেন্টস কর্মী নারী একজন পুরুষকে একসঙ্গে কাজি অফিসে বিয়ে করছে। ঢাকার প্রেক্ষাপটে খুবই অবাস্তব একটা ঘটনা। গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য মেসের ব্যবস্থা আছে। বিয়ে না করেই হাজার হাজার মেয়ে থাকছেন সেখানে। বলা হচ্ছে, দুলাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় দোকানে কাজ করে, তার স্ট্যাটাস গার্মেন্টস কর্মীদের ওপরে। অথচ দেখা যাচ্ছে সে স্ত্রীদের কাছে পালা করে থাকে, খায় এবং স্ত্রীদের টাকায় নিজের অক্ষমতার চিকিৎসা করাবে বলে চিন্তা করে। বাংলাদেশের সংগ্রামী গার্মেন্টস কন্যাদের এত ঠ্যাকা পড়েনি যে ঘরভাড়া নেওয়ার জন্য অক্ষম এক পুরুষকে বিয়ে করে সারারাত তার পিঠ চুলকে দিতে হবে! গার্মেন্টস কর্মীরা এখন অনেক বেশি স্বাবলম্বী। এটা লেখকের মাথায় রাখা উচিত ছিল। এসব বিষয় হয়তো বিদেশি পাঠকের নজরে আসবে না, কিন্তু এ দেশের পাঠকের কাছে বিষয়টি ঠিকই চোখে পড়বে। বিশেষ করে তিনি যখন ডায়াসপোরা (পড়ুন বাইরের) লেখক হিসেবে চিহ্নিত। এসব কারণে লেখক তাহমিমা আনামের লেখা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু যা হয়েছে তা ব্যক্তি তাহমিমা আনামকে নিয়ে টানাটানি। ফেসবুকে এক সিনিয়র লেখক ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘তাহমিমা আনাম আবার কে? আমি তো জানি তিনি মাহফুজ আনামের মেয়ে।’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘She (তাহমিমা আনাম) is the daughter of Mr Mahfuz Anam. Is it not enough?’

লেখক রেজা ঘটক লিখেছেন, ‘ধরুন, মিস আনাম তার বাবাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ধানমন্ডি ফেরার পথে টয়োটা এসি গাড়িতে বসে, পাশে বসা বাবার কাছে খুব আহ্লাদি ঢংয়ে জানতে চাইলেন, আচ্ছা বাবা, রানা প্লাজার ঘটনাটা কী? জবাবে মিস্টার আনাম মেয়েকে বুঝিয়ে বললেন যে সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আর মারা যাওয়া বেশিরভাগ মানুষ গার্মেন্টস শ্রমিক। গরীব মানুষ। যাদের সম্পর্কে মিস আনামের সত্যিকার অর্থেই কোনো ধারণা নাই। রানা প্লাজার ওই দুর্ঘটনা সারাবিশ্বের মিডিয়ায় তখন খুব আলোড়ন তুলেছিল। তাই গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে মিস আনামের মাথায় একটি গল্পের প্লট দানা বাধতেই পারে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতার বাইরে গিয়ে প্রান্তিক এই শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে ফান করার স্পর্ধা কেবল তারাই দেখাতে পারে, যারা নিজের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে না। [‘গার্মেন্টস’ ও একজন বাস্তবতা বিবর্জিত মিস আনাম!!!, রেজা ঘটক, সামহোয়্যারইনব্লগ]

অথচ আমরা জানি সাহিত্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই। আমি যেটার সমালোচনা করলাম, সেই দিকটারই বিকল্প ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন আরেক ডায়াসপোরা লেখক তসলিমা নাসরিন। তিনি তার একটি কলামে লিখেছেন, ‘অনেকে বলছে গার্মেন্টসের মেয়েরা এত অসহায় নয় যে, বাড়ি পাওয়ার জন্য বিয়ে করতে হবে। তাদের জন্য মেসের ব্যবস্থা আছে। না হয় আছে। তাহমিমা কিন্তু কোনও তথ্যনির্ভর প্রবন্ধ লেখেননি। তিনি গল্প লিখেছেন। গল্পে কল্পনা থাকে। তারপরও আমি বলবো, বাংলাদেশের অসহায় গরীব মেয়েরা শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য অথবা মানুষের গালিগালাজ শোনা বন্ধ করার জন্য অহরহ বিবাহিত পুরুষ, বাপের বয়সী পুরুষ, মাথা-খারাপ পুরুষ, পঙ্গু পুরুষ, চরিত্রহীন পুরুষ, অক্ষম পুরুষকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তাহমিমা আনামের গল্পের মেয়েরা শুধু একটু ঘরভাড়া পাওয়ার জন্য বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু একটি মেয়ে উত্থানরহিত স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে চাইছে না। সেই মেয়েই খুব নিঃশব্দে একটি প্রতিবাদ করে। সে একা থাকে, নিজের যৌনতা নিয়ে ভাবে।’ [তাহমিমা আনামের গল্প, তসলিমা নাসরিন, বাংলা ট্রিবিউন]

গল্পের ভাষা ও নির্মিতির প্রশংসা করে আরেক বাংলা ভাষার ডায়াসপোরা লেখক পূরবী বসু লেখেন, ‘গল্পটি অতি সহজ সরল ভাষায় সরাসরি লিখিত বলেই এর তেমন সাহিত্যমূল্য নেই একথা বলা যাবে না । বলা যাবে না এজন্যে যে এই গল্পে বেশ কিছু সূক্ষ্ম চিত্রকল্প ও নির্মাণকৌশল লক্ষ্য করা যায়। পুনঃপুনঃ নাকে ভেসে আসা সেই পরিচিত বিস্কুটের সুগন্ধ এবং বিদেশি নারীর ব্যবহার্য প্যাডেড প্যান্টির প্রসঙ্গ উত্থাপন, এবং এই প্যান্টি ব্যবহারে উচ্চকিত শারীরিক আবেদনের রহস্য উন্মোচনের প্রতীকী ব্যঞ্জনা রয়েছে। স্বল্প পরিসরে-অতি কম কথায়, নির্দিষ্ট বিরতিতে উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে একের পর এক নাটকীয় পরিস্থিতি তুলে ধরার মাঝে মাঝে জেসমিনের অতীত রোমন্থনের বর্ণনায় মুনশিয়ানা চোখে পড়ে।’ [তাহমিমা আনামের ‘গার্মেন্টস’ প্রসঙ্গে, পূরবী বসু, বিডিআর্টস]

ডায়াসপোরা লেখকদের বিরুদ্ধে যে পিতৃমাতৃভূমির ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার অভিযোগ ওঠে, এই ‘ভাবমূর্তি’ শব্দটাকে আমরা সাহিত্যে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি? যে কোনো সার্থক গল্প উপন্যাসই তার স্বকালের সামাজিক অসংগতির দিকে আঙুল তোলে। এটা করা মানেই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা নয়। স্বদেশে থেকে লেখকরা স্বদেশের পাঠকের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন না। একইকথা লেখার কারণে অভিযুক্ত হচ্ছেন ডায়াসপোরা লেখকরা। কারণ তাদের লেখা যেহেতু ইংরেজি ভাষায় ভিনদেশের গণমাধ্যমে বা গ্রন্থাকারে বের হচ্ছে, তাই পড়ছেনও বিদেশি পাঠকরা। স্বদেশের পাঠকরা নিজ দেশের অনেক বিষয় ভিনদেশিদের সাথে শেয়ার করতে চান না। তারা চান বিদেশিরা সবসময় নিজ দেশের ইতিবাচক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানুক। কিন্তু সাহিত্যে কারও মুখপাত্র নয়। ঔপন্যাসিক সুসান সোনটাগ একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘একজন সিরিয়াস লেখক নিজের ছাড়া অন্য কারো মুখপাত্র নন। এখানেই সাহিত্যের মহত্ত্ব’। 

এই জায়গা থেকেই হয়ত তানিয়া মোর্শেদ তাহমিমা আনামের বিরুদ্ধে যে দেশের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে, তার জবাব দিয়েছেন এই বলে, “ভাবমূর্তি’ নষ্ট হচ্ছে ভেবে যারা কষ্ট পাচ্ছেন তারা ভাবুন, আপনি বা কেউ স্বীকার না করলেও সত্যটা প্রকাশিত হচ্ছেই, হবেই। সত্যকে অস্বীকার করে, ধামাচাপা দিয়ে আর কত কাল? লেখক কি এ কারণেও সমালোচনার শিকার হচ্ছেন, তিনি একজন বাংলাদেশী নারী হয়ে গল্পে “যৌনতা” নিয়ে এসেছেন তাই?” [তাহমিমা আনামের ‘গার্মেন্টস’ কি ‘ভাবমূর্তি’ সমস্যা?, তানিয়া মোর্শেদ, উইমেন চ্যাপ্টার]

তাহমিমার বাবা বাংলাদেশে কিছুটা প্রভাবশালী বলে তাহমিমা ওসব সম্মাননা, প্রকাশনা সুবিধা পাচ্ছেন এই ধারণা অযৌক্তিক। তিনি যা পাচ্ছেন নিজের যোগ্যতা-বলেই পাচ্ছেন। ইউরোপ আমেরিকাতেই যে সবসময় মেধার সঠিক ও যথার্থ মূল্যায়ন হয় তাও না। মার্কেট আর মান পৃথিবীর কোথাও সমান্তরালে চলে না। আমাদের অনেকের ধারণা বিদেশে কেউ পুরস্কার পেলেই বিরাট কিছু হয়ে গেল। এই ধারণা থেকে সত্যিকার অর্থেই যারা পরশ্রীকাতর তারা পুরস্কৃত লেখক শিল্পীর পেছনে লেগে যান। এই যে চলচ্চিত্র পরিচালক আশরাফ শিশিরের ‘গাড়িওয়ালা’ সিনেমাটি ছয়টি মহাদেশের ২৬টি দেশের ৭৮টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হলো এবং রেকর্ডসংখ্যক পুরস্কার পেল। তাতেই তো আর ‘গাড়িওয়ালা’ সিনেমাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সিনেমা হয়ে গেল না। এই সিনেমাটি যে বছর নির্মিত হয়েছে সে বছরই দেশে তার চেয়ে ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এখন বিদেশে ‘গাড়িওয়ালা’ প্রশংসিত বলেই যে সেটি মহৎশিল্পের আসনে বসে গেল এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হতে হবে আমাদেরও। তার চেয়ে বড় কথা কারও বিদেশে কারও অর্জনের পেছনে ‘কারণ’ অনুসন্ধান করার আগে আমাদের সেলিব্রেট করতে শিখতে হবে।

স্বদেশে ডায়াসপোরা: আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি
আমি নিজে দেশান্তরী লেখক নই, ফলে তাত্ত্বিকভাবে ডায়াসপোরা লেখক হিসেবে নিজেকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। কিন্তু অনুভূতির জায়গা থেকে আমরা অনেকেই স্বদেশেই ডায়াসপোরা, অর্থাৎ (পাকিস্তানি ডায়াসপোরা জুলফিকার ঘোষের ভাষ্যে) নেটিভ এলিয়েন। ডায়াসপোরা লেখকদের অনুভূতি ও সংকটটা আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি কারণ আমি নিজে আরও অনেকের মতো স্বদেশে স্থানচ্যুতির শিকার। স্থানচ্যুতির বিষয়টা আমাকে সবসময় পীড়া দেয়। যখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র তখন গ্রাম ছেড়ে মেহেরপুর শহরে চলে এসেছি। সেখানে আমাকে নতুন ধরনের সমাজ বাস্তবতা এবং শিক্ষিত সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে চলে এসেছি কুষ্টিয়া শহরে। এখানে এসে নতুন ভাবধারার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন কথ্যভাষা। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে উত্তর বঙ্গের জলবায়ু থেকে শুরু করে মানুষের ভাষা ও আচরণগত কিছু পার্থক্য আছে। রাজশাহী শহরে ৬টি বছর আমাকে সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়েছে। বর্তমানে বাস করছি রাজধানী শহরে। এই শহরই এখন আমার চিরস্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন অনিয়মিত যোগাযোগের কারণে জন্মশহরের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। স্থান বদলের সাথে সাথে একটু একটু করে আমি আমার জন্মস্থান থেকে সরে এসেছি। অথচ আমার কথাসাহিত্যের প্রধান প্রেক্ষাপট আমার গ্রাম। গ্রামের নানা ঘটনা ও চরিত্র আমার গল্পে উঠে এসেছে। কিন্তু আমি যে গ্রামটিকে ভেতরে ধারণ করে এসব লিখছি সেই গ্রামটি বাস্তবে আর কোথাও নেই। প্রযুক্তি বিপ্লব এবং নগর সভ্যতার বিস্তার আমার গ্রামটিকে কেড়ে নিয়েছে। গ্রামটিও এখন কেন্দ্রের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু পরিবর্তিত গ্রামটি আমার অচেনা। আমি যে গ্রামটি নিয়ে লিখছি সেটি আমার স্মৃতিতে আছে। স্মৃতি সবসময় নির্ভরযোগ্য না। ফলে আমার লেখা আমার জন্মশহরের যে অল্পসংখ্যক পাঠক পড়েছেন তাদের কাছে আমি তাদের যাপিত বাস্তবতার বিশ্বস্ত কথক হতে পারিনি।

আমি কারও বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য লিখিও না। গল্পের প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাকে যাপিত বাস্তবতার অনেককিছু বিনির্মাণ করতে হয়েছে। যেমন, ‘বাঁশিওয়ালা মজ্জেল’ গল্পে মজ্জেলের মৃত্যু দিয়ে গল্প শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবের মজ্জেল এখনো জীবিত। বাঁশি বাজানো নিয়ে তাকে গাঁয়ে কখনো কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। তার চেয়ে আপত্তি উঠেছে গল্পের এই অংশটাতে : ‘মজ্জেল তখন আট সন্তানের বাবা- পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। একটির সঙ্গেও মজ্জেলের চেহারার মিল নেই। মাঝরাতে মজ্জেলের বউয়ের বিছানা থেকে একেক দিন একেকজনকে উঠে আসতে দেখা যেত বলে রটনা আছে। বছর বিয়াতো মজ্জেলের বউ।’ [বাঁশিওয়ালা মজ্জেল, অতীত একটা ভিনদেশ] মজ্জেলের বউ বছরে বছরে সন্তানের মা হতো, এটা সত্য; কিন্তু সেই সন্তানের বাবা মজ্জেলই। তার সন্তানদের চেহারা মজ্জেলের কার্বন-কপি। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে আমি অনেককিছু বদলে ফেলেছি। আমার ছেলেবেলায় দেখা সেই বাঁশিওয়ালা মজ্জেলের বিশ্বস্ত-জীবনীকার হওয়ার ইচ্ছা থেকে গল্পটি আমি লিখিনি। একইভাবে ‘আলীমেয়েলির প্রস্থান’, ‘চক্করকাটা জটি’, ‘আরও একটি রাতের অপেক্ষায়’ গল্পগুলোতে শৈশোবে দেখা আলীমেয়েলি, জটি, সফেলাকে তাদের চরিত্রের কোনো একটা দিক ঠিক রেখে বাকিটা আমি নির্মাণ করেছি। ফলে ডায়াসপোরা লেখকরা যেমন প্রায়শই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে স্বদেশি পাঠকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হন, তেমনি আমাকেও আমার উৎসের পাঠকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি সচেতনভাবে পাঠক হিসেবে তাদের এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। আমি লিখতে চেয়েছি বৃহত্তর বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য। আমার কাঙ্ক্ষিত পাঠক কখনোই আত্মীয়স্বজন না। যেমনটি অরহান পামুক বলছেন যে, তিনি তার সংখ্যালঘু স্বদেশি পাঠকদের জন্য লেখেন না, তিনি লেখেন সেই সকল বাইরের পাঠকের জন্য যারা তাকে পড়েন। অর্থাৎ স্বদেশি পাঠকদের লক্ষ্য করে ডায়াসপোরা লেখকদের লিখতে হলে তাদের অনেককিছু নিজে থেকে সেন্সর করে নিতে হবে, যেটা একজন প্রকৃত লেখক কিছুতেই চাইবেন না।

এখন প্রশ্ন হলো, এই অবিশ্বস্ত স্মৃতি থেকে একজন লেখক কেন লিখছেন? প্রশ্নের উত্তরটা ইশিগুরো দিয়েছেন এভাবে, ‘…প্রথমদিকে যখন আমি উপন্যাস লিখতে শুরু করি, জাপানের পটভূমিতেই শুরু করেছিলাম; এটা করার পেছনে কিছু ব্যক্তিগত কারণও ছিল; আবেগের তাড়নায় আমি চাইতাম আমার নিজস্ব জাপানকে আমি আমার মতো করে নির্মাণ করব; এবং তাই করতে চেয়েছি।’ [সাক্ষাৎকার : গাবি উড, দ্য টেলিগ্রাফ]

প্রায় একইকথা বলছেন ব্রিটিশ ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখক সালমান রুশদি। তিনি বলছেন, ‘এই যে আমরা সশরীরে ভারতে এখন নেই, অনিবার্যভাবে এর অর্থ হলো, ঠিক যে-জিনিসটা আমরা হারিয়েছি সেটা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়; এককথায়, আমরা তৈরি করে বসবো কাহিনি, সত্যিকারের শহর বা গ্রাম নয়, বরং এমন শহর বা গ্রাম যা কোথাও দেখা যায় না, কল্পনায় স্বদেশ, অনেকগুলো মনগড়া ভারত।’ [‘কল্পনায় স্বভূমি’, অনুবাদ : অভিজিৎ মুখার্জি]

এভাবেই আমরা যদি আমাদের নিজেদের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশি ডায়াসপোরিক লেখকদের পাঠ করার চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের ভেতর চমৎকার একধরনের বোঝাপড়া তৈরি হতে পারে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়