ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পার্বত্য অঞ্চলের বর্ষবরণ || শাকুর মজিদ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১৩ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পার্বত্য অঞ্চলের বর্ষবরণ || শাকুর মজিদ

বর্ষবরণের উৎসবে জলকেলিতে মেতেছে পাহাড়ি তরুণ-তরুণী

বান্দরবান, খাগরাছড়ি আর রাঙামাটি এ তিনটি জেলা নিয়েই বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ২৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম, যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের এক দশমাংশ। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ১৪ লাখ জনগোষ্ঠীর বাস। এদের মধ্যে বাঙালি আর পাহাড়ি আদিবাসী সংখ্যায় প্রায় সমানে সমান। আদিবাসী ১২টি গোষ্ঠীর সাথে সমতল থেকে অভিবাসিত হওয়া প্রায় ৭ লাখ বাঙালি এক  সৌহার্দময় পরিবেশ নিয়ে এই পাহাড়ি এলাকায় বাস করেন।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের এই জনগোষ্ঠী বাংলা সনের পথম দিনটি উদযাপন করার জন্য আয়োজন করেন ‘বৈসাবি’র।  ত্রিপুরাদের বৈসুক বা বৈসু, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’- এই তিন উৎসবের সমন্বিত নাম বৈসাবি। ২০১০ সালে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর এই বৈসাবি আয়োজন দেখতে গিয়েছিলাম। রাঙামাটি, কাপ্তাই আর বান্দরবানে পুরো তিনদিন ঘুরে দেখেছি তাদের এই আয়োজন।

চাকমাদের বিজু : রাঙামাটি চাকমা অধ্যুষিত এলাকা। সারাদেশে প্রায় ৪ লাখ চাকমা আদিবাসীর বসবাস হলেও খোদ এই রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় প্রায় ৩ লাখ চাকমার বাস। নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর পেশা নিয়ে প্রায় ৬শ বছর ধরে চাকমারা এই অঞ্চলে বসবাস করছে।এরা প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রাঙামাটিতে বৌদ্ধদের একটি বড় প্রার্থনা কেন্দ্র আছে। বাংলা নববর্ষের সময় এই বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে চাকমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

চাকমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু। বাংলা বছরের শেষ দু’দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিন, এ তিন দিনজুড়ে তারা বিজু উৎসব পালন করে। ভোরবেলা পানিতে ফুল ছিটিয়ে উৎসবের সূচনা করে চাকমা কিশোরীরা। দ্বিতীয় দিন চলে আপ্যায়নের আয়োজন। চাকমারা মনে করে অন্তত দশটি পরিবারকে যদি আপ্যায়িত না করা হয় আর নিজে যদি অন্তত সাতটি বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত না খায়, তবে সে খুব বড় আত্মার চাকমা নয়। এই বিজু উৎসব উপলক্ষ্যে চাকমারা বেশ কয়েক পদের সবজি দিয়ে পাজন  তৈরি করে। পাজনের সাথে থাকে নিজেদের বানানো বিশেষ ধরনের পানীয়। এই বিজু উৎসবটি রাঙামাটিতে পালিত হয় সর্বজনীনভাবে। পাহাড়ি বাঙালি এক সাথে মিলে মিশে উপভোগ করেন এমন আমুদে আয়োজন।

সাংগ্রাই জল উৎসব : রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই এর দূরত্ব এখন কমে এসেছে। নতুন সড়কপথ তৈরি হয়েছে পাহাড় কেটে। ডানে বামে কাপ্তাই হ্রদের অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসা যায় চিতমরম খেয়া ঘাটে। এই খেয়াঘাটের ওপারেই চিতমরম ইউনিয়ন পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদের আয়োজনে মারমা উপজাতি গোষ্ঠীর বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন চিংম্রং সাংগ্রাই। মারমা আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী  এই উৎসবে যোগ দিতে দূর দূরান্ত থেকে উৎসাহী জনগোষ্ঠীর সমাগম হয় এখানে। ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে বসে মেলা। নিজের হাতে, ঘরে বানানো কারু শিল্পে মারমাদের হাত ভালো। তাদেরই হাতে বানানো নানা রকমের সামগ্রীর পসরা নিয়ে দোকানিরা বসেন এখানে। জমজমাট মেলা চলে ৩দিন ধরে।

এই মারমা জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী সম্প্রদায়। এরা সংখ্যায় প্রায় দু’লাখ। যদিও পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবান জেলায় তাদের বাস বেশি, তবুও এই রাঙামাটি বা খাগড়াছড়িতেও তাদের বাস আছে। এরা কথা বলে নিজস্ব ভাষায়। এই মারমা সম্প্রদায়ের নিজস্ব বর্ণমালা আছে। এই আয়োজনে সবচেয়ে বড় অংশটি হচ্ছে সাংগ্রাই জল উৎসব। একটা বড় নৌকা মাঠের উপর এনে রেখে পানি দিয়ে ভর্তি করা হয়। একপাশে ছেলেরা দাঁড়ায় অপরপাশে মেয়েরা। হুইসেল বাঁজলে পরস্পকে পানি ছিটানো শুরু করে।

মারামাদের আরেকটি বড় জল উৎসব দেখেছিলাম বেতবুনিয়া হাইস্কুল মাঠে। বাংলদেশে পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ২ লাখ মারমার আদি বাসস্থান ছিল বর্তমান মিয়ানমারে। প্রায় চারশ বছর ধরে মারমা আদিবাসী সম্প্রদায় স্বদেশীয় ভাষা এবং সংস্কৃতি এখনো লালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসা মারমা আদিবাসী গোষ্ঠী ও পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় নতুন বছরে এমন আয়োজন করে থাকেন। এ আয়োজনের মূলে থাকে আনুষ্ঠানিক জল উৎসব। এই উৎসবে জল ছিটানো হয় নারী পুরুষ দুই দলের মধ্যে। মাঝখানে রাখা থাকে জলের প্রাত্র। খেলা নিয়ন্ত্রকের ইঙ্গিত পাওয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় জল ছোড়াছোড়ির খেলা। ছেলারা মেয়েদের আর মেয়েরা ছেলেদের জল ছিটায়। আনুষ্ঠানি জল ছোড়াছুড়ির বাইরে পুরো চত্বরটি জুড়েই পানি ছোড়াছুড়ির আয়োজন থাকে এখানে।

শিশু কিশোরেরাই এই মজাদার খেলায় অনেক বেশি মেতে থাকে। পানি ছিটানোর জন্য প্লাষ্টিকের বোতলই তাদের প্রধান সম্বল। তরুণ তরুণীরাও পানি হাতে বসে থাকেন না। বৈশাখের রৌদ্রতাপে প্রিয়জনের মাথায় পানি ঢেলে শরীরটাকে শীতল করেন। নতুন বছরের প্রথম তিন দিন ধরেই চলে এমন জল ছিটানোর উৎসব। বিগত বছরের দুঃখ দুর্দশা ধুয়ে মুছে নতুন করে আরেকটি বছরকে স্বাগত জানানোর এমন আয়োজন পার্বত্য অঞ্চলে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। এসব আয়োজন থাকে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক জল ছিাটানোর আরেকটি আয়োজন পেযেছিলাম বান্দরবানের শহর কেন্দ্র থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের কলতলী গ্রামে।

কলতলীর  মারমা : বৈশাখের প্রথম দিনগুলোতে মারমা তরুণীরা পথচারী আর বাসের যাত্রীদেরও আনন্দের ভাগীদার করার জন্য পানি ছোড়াছুড়িতে উম্মুখ থাকে। মারমারা আকৃতিতে একটু ছোট আকারের হয়ে থাকে। চোখের নিচের হাড় সামান্য উঁচু এবং কালো চুলে। তাদের চোখ ছোট নাক চ্যাপ্টা এবং শরীরের রং পৃতাভ্র। নতুন বছরে নানা রকম আমোদে উচ্ছ্বাসে মেতেছিল পুরো গ্রাম। পাহাড়ের তলায় একটা পুকুর আছে, এ পুকুরে আয়োজন হয় সাঁতার প্রতিযোগীতার। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই মিলে উপভোগ করে এমন আমুদে আয়োজনের। নতুন বছরের প্রথম দিনে পুরনো বছরের সব জঞ্জাল ধুয়ে ফেলার বাসনায় নিজেদের মধ্যে জল ছিটানোর মজার খেলায় মত্ত হয়ে থাকেন গ্রামবাসী। ছেলে বুড়ো কেউই বাদ যান না এমন আমুদে আয়োজন থেকে।

এ পানি ছোড়াছুড়ি দু’রকমের হয়ে থাকে। সামনে থেকে ছলাৎ করে পানি ছিটানো হয় প্রিয়জন বা সমবয়সীদের উপর, শ্রদ্ধা, সম্মান ও স্নেহের সাথে পানি ঢালা হয় আস্তে করে শরীরের উপর থেকে মাথা বা ঘারের উপর। ভাইয়ের প্রতি বোনের কিংবা বোনের প্রতি ভাইয়ের নববর্ষের আশীর্বাদ হিসেবে কাঁধের উপর থেকে ধীরে ধীরে কোমলভাবে জলধারা বিলানো হয়।পুরনো বছরের দুঃখ দুর্দশা, গ্লানি আর ক্লান্তি ধুয়ে মুছে ফেলে নতুন বছরে তরতাজা শুদ্ধ শরীর নিয়ে জীবন শুরু করার তাগিদ থেকেই মূলত তাদের এই জল ছিটানো উৎসব।

ছবি : লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়