ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

প্রান্তিকের পাঠাগারে পাঠকের ভিড়

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রান্তিকের পাঠাগারে পাঠকের ভিড়

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সাতক্ষীরার তালা ঘুরে : একে একে ভিড় বাড়ছে। বাড়ছে পাঠকের সংখ্যা, বইয়ের সংখ্যা। শেলফের পর শেলফ। থরে থরে সাজানো বইপত্র। মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, কী নেই এখানে? হাজারো বইয়ের ভিড়ে পাঠক খুঁজে নিচ্ছেন তার পছন্দেরটি।

আবার বইপত্রের সঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রায় সকল সংবাদপত্র এখানে রাখা পাঠকের জন্য। রয়েছে অনলাইনের খবরাখবর পড়ার সুযোগ।

গণ-গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগটি চোখে পড়ল পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা সদরে। নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা আ. সালাম গণ-গ্রন্থাগার’। প্রথমে এটি ‘তালা গণ-গ্রন্থাগার’ নামে যাত্রা শুরু করলেও ২০১১ সালে নতুন নামকরণ করা হয়। এলাকার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে একটি উন্নততর সমাজ গঠনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা আ. সালাম গণ-গ্রন্থাগার নামের এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ।

উদ্যোক্তারা জানালেন, আবদুস সালাম মোড়ল মুক্তিযুদ্ধে তালা অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ও দেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি নিরহঙ্কারী, নির্লোভী, দুর্নীতিমুক্ত ও ত্যাগী  মহান মানুষ ছিলেন। আজীবন তিনি ছিলেন গণ-মানুষের নিঃস্বার্থ সেবক। শিশু-কিশোর ও যুবকরা যাতে এই মহান মুক্তিযোদ্ধার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় সে প্রত্যাশায় এই নামকরণ করা হয়।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে স্বপ্ন। ভাড়া করা ঘর থেকে এখন স্বপ্ন ডানা মেলছে নিজস্ব ভবনে বইয়ের জগৎ গড়ে তোলার। সে কথাই শোনাচ্ছিলেন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান উত্তরণ-এর পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তরুণদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে, আলোকিত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাঠাগারের কোনো বিকল্প নেই। পিছিয়ে থাকা জনপদের ছেলেমেয়েরা এখানে এসে জ্ঞান আহরণে ব্যস্ত থাকে। এভাবে তারা নিজেদেরকে দক্ষ করে গড়ে তুলছে।’

এ ধরনের পাঠাগারের উদ্যোগ কেন নেওয়া হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে উদ্যোক্তারা জানালেন, একান্ত প্রতিকূল পরিবেশে সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই বেড়ে উঠছে এ অঞ্চলের শিশু, কিশোর ও যুবকরা। দক্ষতার অভাব, বেকারত্ব ও নৈরাশ্যের কারণে যুবসমাজ সহজে বিপথগামী হয়ে পড়ছে। ফলে নানা প্রকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে তাদের অনেকের মধ্যে মাদকাসক্ত, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও মূল্যবোধের অভাব দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মারাত্মক আর্থসামাজিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এখনই এ সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন থেকেই পাঠাগারের এই উদ্যোগের সূত্রপাত।

উদ্যোক্তারা জানান, প্রান্তিক জনপদ তালায় সরকার বা সরকারের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো বাদে উল্লিখিত সমস্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার মতো তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে কাজ করলেও সেগুলো আর্থিক ও তাত্ত্বিক দিক দিয়ে খুবই দুর্বল। এ জন্য এমন একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। পাঠাগার এবং পাঠাগারকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড এলাকার তরুণ-যুবকদের দক্ষ করে তুলতে সহায়তা করবে। তারা স্বাধীনভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের সমস্যাবলি যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারবে। একই সঙ্গে দেশে ও দেশের বাইরে নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।

গ্রন্থাগার থেকে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, গ্রন্থাগারের সংগ্রহে বর্তমানে আছে প্রায় ১০ হাজার বই ও ১০০০ ই-বুক রয়েছে। ৩৪টি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা এবং বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল রয়েছে এখানে। এখানে রয়েছে রেফারেন্স বই সমৃদ্ধ রেফারেন্স গ্যালারি। রয়েছে ৮০ জন পাঠকের ব্যবহার উপযোগী ২টি পাঠকক্ষ এবং ৩টি কম্পিউটার। ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে ফ্রি ওয়াইফাই-এর ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। রয়েছে ২৫ জনের ব্যবহার উপযোগী কম্পিউটার প্রশিক্ষণকক্ষ। গ্রন্থাগারে আছে ইমার্জেন্সি রেসপন্স উপকরণ সম্বলিত ডিজাস্টার রিসোর্স সেন্টার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ বাংলাদেশের অন্যান্য লাইব্রেরির সঙ্গে এই গ্রন্থাগারের রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ। ৩ জন সার্বক্ষণিক কর্মী ও ২৪৭ জন স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই গ্রন্থাগারটি।

গ্রন্থাগার সূত্র জানায়, এই গ্রন্থাগারে দুই ধরনের সদস্য রয়েছেন। নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত। নিবন্ধিত সদস্যদের বই প্রদান করা হয়। একজন নিবন্ধিত সদস্য একত্রে অনধিক ২টি বই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংগ্রহে রাখতে পারে। অনিবন্ধিত সদস্যরা শুধু অফিস চলাকালীন গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষে বই নিয়ে পড়তে পারে। আবেদনপত্র ক্রয় বাবদ ২০ টাকা ও ভর্তি ফি বাবদ ২০০ টাকা জমা দিয়ে যে কেউ গ্রন্থাগারের নিবন্ধিত সদস্য হতে পারেন।

গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের লক্ষ্যে গণ-গ্রন্থাগারের উদ্যোগে স্থানীয় সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে সৃজনশীল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের লেখা কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ নিয়ে প্রতি তিন মাস পরপর দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা আ. সালাম গণ-গ্রন্থাগারে ৩৪টি দৈনিক (আঞ্চলিক ও জাতীয়) পত্রিকা পাঠকদের পড়ার জন্য সরবরাহ করা হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল, সাপ্তাহিক,পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থাকে। পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী সংরক্ষিত পুরাতন পত্রিকা পড়া ও প্রয়োজনে ফটোকপি করার সুযোগ দেওয়া হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর প্রতি সহিংসতা, কৃষি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্যোগ বিষয়ের ওপর সংবাদপত্র ক্লিপিং সংরক্ষণ করা হয়।

মাত্র অল্প কয়েক বছরে প্রান্তিক জনপদে তরুণ-যুবকদের মাঝে এই গণ-গ্রন্থাগার ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সকাল-দুপুর-বিকেলে পাঠাগারের টেবিলে টেবিলে পাঠকের ভিড় জমে। তরুণ পাঠকেরা জ্ঞান অন্বেষণে ছুটে আসেন এখানে। এর মাধ্যমে তারা নিজেরা আলোকিত হচ্ছে, আলোকিত করে তুলছে গোটা এলাকা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়