ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কান্না

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কান্না

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : আমরা কাঁদি। প্রত্যেক মানুষ জীবনে বহুবার কাঁদে। বিষাদে হৃদয় ভারাক্রান্ত হলে মানুষ কাঁদে। কখনো কখনো আনন্দেও কাঁদে। যদিও আনন্দে কাঁদার সৌভাগ্য সবার জীবনে আসে না। আর আসলেও বেশিবার আসে না। মানুষ জীবনে দুঃখের কান্নায় বেশি কাঁদে।

তবে দুঃখে কাঁদাও কিন্তু সহজ নয়। বহু মানুষ আছে যারা দুঃখেও কাঁদতে পারে না। কান্নার জন্য দয়া উদ্রেক হওয়ার মতো হৃদয় দরকার। সবার এমন হৃদয় নেই।

কান্না আসলে সিক্রেটোমোটর ফেনোমেননের একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা চোখের ল্যাক্রিমাল অংশ থেকে পানি আকারে বের হয়। মানবদেহের মস্তিষ্কের সঙ্গে ল্যাক্রিমাল গ্লান্ডের অন্তঃযোগাযোগ রয়েছে। যার ফলে যখনই আমাদের মস্তিষ্কে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়, তখনই ল্যাক্রিমাল গ্লান্ডে আঘাত করে এবং এর ফলে আমরা কান্না করি।

বিজ্ঞানিরা মনে করেন, মানুষ যখনই কষ্ট অনুভব করে, তখন কান্নার মাধ্যমে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। যার ফলে সে হালকা এবং প্রশান্ত অনুভব করে। এ কারণে দেখা যায় কান্না করলে মানসিক চাপ অনেক কমে আসে।

সকল দয়ালু মানুষ কাঁদে। তবে সবাই একইভাবে কাঁদে না। যারা নিজেকে সংবরণ করতে পারে, তাদের হৃদয় কাঁদলেও চোখে-মুখে তার প্রকাশ ঘটে কম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। নির্বাক তাকিয়ে থেকে, সবার থেকে একা থেকে- নিজের মধ্যে নিজে বোঝাপড়ার চেষ্টা করে। আর যারা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, তারা নিজের কষ্টকে প্রকাশ করে ফেলে। কখনো কখনো তা বাড়াবাড়ির পর্যায়েও চলে যায়। বিলাপ-প্রলাপ করে সবাইকে অস্থির করে তোলে।

কান্নার ধরন বোঝাতে ইংরেজি ভাষায় দুটি শব্দ প্রয়োগ করা হয়। ‘ক্রাইং’ এবং ‘উইপ’। চিৎকার করে কান্না এবং ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না। সবাই কষ্টে কাঁদে। কিন্তু কষ্টের মধ্যেও যে নিজেকে ধরে রাখতে পারে, সে বিজ্ঞ।

তবে সবাই কিন্তু কাঁদতে পারে না। কান্না সহজ কাজও নয়। কান্নার একটি প্রতিযোগিতা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রতিযোগীদের জন্য অসাধ্য কাজটি ছিল সবার সামনে কাঁদতে হবে। শুধু মিছে মিছে হাউমাউ করলে হবে না। চোখ দিয়ে অশ্রু বের করতে হবে। সেদিন দেখলাম- অশ্রু বিসর্জন কতটা কঠিন কাজ।

আবার আমার এক নিকটাত্মীয়কে দেখেছি- তার জন্য কান্না কতটা সহজ। আধুনিক এবং উচ্চপদস্থ এই ব্যাংকার নাটক বা সিনেমায় কষ্টের দৃশ্যও এড়িয়ে চলেন। দয়ালু মানুষটিকে অসহায়-দুঃখীদের সাধ্যমতো সহযোগিতা (দান) করতে দেখেছি। অপরের দুঃখে যার হৃদয় কাঁদে না, আর যাই হোক তিনি দয়ালু হতে পারেন না। যে হৃদয়ে দয়া নেই, সে হৃদয় কখনো কাঁদে না।

তবে কৃত্রিম কান্নাকে দয়ালু মানুষের কান্নার সঙ্গে মিলিয়ে গোল না পাকিয়ে ফেলাই ভালো। মানুষ ভোলানোর জন্য কান্নাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। সেই কৃত্রিম কান্নায় কখনো কখনো অশ্রু বিসর্জনে গ্লিসারিনের প্রয়োজন পড়ে। তবে কোনো কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী এতটাই পারদর্শী যে এ তরল পদার্থের প্রয়োজন পড়ে না। লোক দেখানো কান্নাও সহজ নয় কখনোই। এ কঠিন কাজটি করতে পারলে জনগণের সহানুভূতিও পাওয়া যায়। অনেক রাজনীতিক এ কাজটি করতে পেরেছেন। পত্রিকায় কান্নার সেই দৃশ্য বড় করে ছাপা হয়েছে।

কান্নার ভাষা সর্বজনীন। সব ভাষার মানুষ কাঁদে। কান্নার ভাষা সব ভাষাভাষি বোঝে। পৃথিবীর সব মানুষের প্রথম ভাষা কান্না। ধরাধামে এসে নিজের অস্তিত্ব সে জানান দেয় কান্নার মাধ্যমে। নবজাতকের কান্না শুধু পৃথিবীতে তার আগমনকে জানান দেয় নয়, এটা তার সুস্থতার প্রকাশও। যদি শিশুটি জন্মেই চিৎকার করে কাঁদে এবং একাধিকবার প্রস্রাব-পায়খানা করে, তাহলে শিশুটির শারীরিক সমস্যা নেই মনে করা হয়।

জন্মের কয়েক বছর পর্যন্ত শিশুর ভাষাই কান্না। সে ব্যথা পেলে কাঁদে। ক্ষুধা পেলে কাঁদে। পরিচিতজনকে না পেলে কাঁদে। কিংম্বা শারীরিক কোনো সমস্যার কারণে যখন-তখন কাঁদে। সে কথা বলতে পারে না। কান্নার মধ্যেই তার বক্তব্য নিহিত থাকে।

কান্না রাজনীতিকদের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র। কাঁদতে পারলে মানুষের সহানুভূতি আদায় করা যায়। যার উজ্জ্বল প্রমাণ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কেঁদেছেন। কার্যভার গ্রহণের পর কমপক্ষে ১০ বার তার কাঁদার দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।

গত বছরও দেশটির বন্দুক নিয়ে সহিংসতার কথা বলতে গিয়ে তার গাল বেয়ে অশ্রু  পড়ে। এ মাসে শিকাগোতে তার বিদায়ী ভাষণেও কাঁদতে দেখা গেছে। ওই ভাষণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্ত্রী মিশেল ওবামা ও মেয়ে মালিয়ার কথা বলতে গিয়েও কাঁদেন ওবামা। ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দেশটির সর্বোচ্চ মার্কিন বেসামরিক সম্মাননা প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম দেওয়ার সময়ও চোখের জল ঝরে ওবামার। এ কান্না ওবামাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। 

কঠোর ভাবমূর্তি সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে কান্নারত অবস্থায় দেখা গেছে। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পরই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। ওই সময় তিনি কান্নারত অবস্থায় দাবি করেছিলেন, এর পেছনে পশ্চিমাদের হাত আছে।

যে কাঁদতে পারে তার ভেতরে অহংকার থাকে না। বিজ্ঞানিরা বলেন, কান্না শরীরে স্ট্রেস তৈরি করার রাসায়নিক পদার্থ দূর করে। অতিরিক্ত স্ট্রেস হার্ট অ্যাটাক এবং স্টোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। কান্না স্ট্রেস দূর করে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।

কান্না রক্তচাপ, পালস রেট কমিয়ে শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। কিছুটা কান্না আপনার রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। তবে চাইলেই কাঁদা যায় না। যতক্ষণ মন না কাঁদবে, ততক্ষণ চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরবে না। পাষাণের মন কাঁদে না। দয়ালুর মন কাঁদে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/বকুল/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়