ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’

শাহেদ হোসেন : চার্বাক দর্শণে বলা হয়েছে- ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ।’ অর্থাৎ ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো।

হাল জামানায় ব্যাংকগুলো বেশ ভালোভাবেই এ তত্ত্ব জনসাধারণকে গেলাতে সক্ষম হয়েছে। ঋণ নিন গাড়ি কিনুন, ঋণ নিন বাড়ি কিনুন, ঋণ নিন অমুক কিনুন তমুক কিনুন। অর্থাৎ টাকা নেই তো কী হয়েছে? ব্যাংকের কাছে আসুন। ঋণ নিন, সুদের টাকায় আমাকে ঋদ্ধ করুন। আর ফাঁকে আপনি জীবনকে উপভোগ করুন। তবে মহাভারতে বকরূপী ধর্মকে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, দিনান্তে যে পরম নিশ্চিন্তে শাক-ভাত খায়, সে-ই সুখী। অর্থাৎ, না আছে ঋণ-না আছে সুদ গোনার ঝক্কি । অল্পতে সন্তুষ্টিই আসল কথা।

স্বরবর্ণমালার সপ্তম বর্ণ ‘ঋ’। এর উচ্চারণ স্থান মূর্দ্ধা। এটি  স্বরধ্বনির মধ্যে স্থান পেলেও আসলে খাঁটি স্বরধ্বনি নয়। কারণ, এটি উচ্চারণকালে জিহ্বাগ্রা প্রায় মূর্দ্ধা স্পর্শ করে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী  বলেছেন, ‘সংস্কৃত বর্ণমালায় ‘ঋ’ ও ৯ এই দুইটি বর্ণ স্থান পায়। উহারা স্বরবর্ণমধ্যে গণিত হইলেও খাঁটি স্বর নহে। ‘ঋ’ উচ্চারণের সময় জিহ্বাগ্র প্রায় মুর্দ্ধা স্পর্শ করে; ‘৯’ উচ্চারণের সময় জিহ্বাগ্র প্রায় উপর পাটীর দাঁত স্পর্শ করে। প্রায় করে,-একটু ফাঁক থাকিয়া যায়; হাওয়া সেই ফাঁক দিয়া বাহিরে আসে। হাওয়াটা একেবারে আটকায় না বলিয়া উহাদিগকে ব্যঞ্জন মধ্যে না ফেলিয়া স্বরের মধ্যে ফেলা হইয়াছে। সংস্কৃত ভাষায় ঋকারের হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় প্রয়োগই আছে; তবে দীর্ঘ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত অধিক নাই।’ (শব্দ-কথা)।

ধ্বনিবিজ্ঞান অনুসারে বাংলা ঋ-এর উচ্চারণ (১) শব্দের প্রথমে কোনো বর্ণের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত হলে ‘রি’ (ঋণ, ঋষি); অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে ঋ-এর  উচ্চারণ হয় র-ফলা (হৃদয়)।ঋ ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে ‍ৃ কার হয়। যেমন -ক+ ঋ = কৃ।

আগের ‘ঋ’ আদি বাংলায় ‘উ’-তে পরিণত হয়ে যেত ।  ‘ঋজু’ শব্দটি  ‘চর্যাপদ’-এ হয়ে গেছে ‘উজু’। কবি সরহ বলেছেন, ‘বটা উজুবাট ভাইলা’; অর্থাৎ ‘বাবা, সোজা পথ দেখা গেলো’।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে ‘ঋ’ দিয়ে প্রায় ৮৩টি শব্দ যুক্ত করেছিলেন। তবে প্রায় শত বছরের ব্যবধানে ‘ঋ’ দিয়ে শব্দের সংখ্যা অনেক কমেছে। আমাদের বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক অভিধানে এ সংখ্যা অনধিক ২৫-এ এসে ঠেকেছে।

সীতানাথ বসাক তার আদর্শ লিপিতে ঋ-তে লিখেছিলেন-ঋষিবাক্য শিরোধার্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও ঋ-দিয়ে ঋষি লিখেছেন। অর্থাৎ শিশুমনে ঋষির মতো শান্ত-সৌম্য চেহারার ধারণা এবং তেমনি চরিত্র গঠনে হয়তো উৎসাহ দিতে চেয়েছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে, যিনি পরমার্থে সম্যক দৃষ্টি স্থাপন করে সর্বোতভাবে পরোপকার করেন তিনিই ঋষি। তবে যুগ পাল্টেছে, আমাদের চরিত্রের ধরণও পাল্টেছে। ঋষি চরিত্রটি তপোবনে চলে গেছে। সেই তপোবন আবার ঋক্ষ (ভালুক) চরিত্রের বনদস্যুরা কেটে সাফ করে দিয়েছে। সুতরাং ঋষিও গত, ঋজু চরিত্রের মানুষও সেই গত হওয়ার পথে আছেন। বন কেটে সাফ করায়, ঋতুধর্মও পাল্টে গেছে।

চাণক্য বহু আগে বলে গিয়েছিলেন- ঋণকর্তা পিতা শত্রুর্মাতা চ ব্যভিচারিণী/ভার্যা রূপবতী শত্রুঃ পুত্রঃ শত্রুরপণ্ডিতঃ । অর্থাৎ পরিবারিক জীবনে চার ধরণের শত্রু রয়েছে- ঋণী পিতা, পতির প্রতি অবিশ্বাসী মা, খুব সুন্দরী স্ত্রী এবং অজ্ঞ ও বোকা পুত্র। বদলাবদলির এই যুগে এখন এগুলো সবই আমাদের সমাজে বিদ্যমান।

তথ্যসূত্র :
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
বাঙ্গালা ভাষার অভিধান : শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী : হুমায়ুন আজাদ
ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব - মুহম্মদ আবদুল হাই
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী : শব্দ-কথা

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়