ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

উনিশ শতকের সেরা জাদুকর

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উনিশ শতকের সেরা জাদুকর

জাদু সম্রাট পি সি সরকার

শাহ মতিন টিপু : পি সি সরকার-ই (সিনিয়র) প্রথম জাদুকর, যিনি এই অনন্য বিদ্যাকে আন্তর্জাতিক দরবারে সম্মানের জায়গায় নিয়ে যান। তার নিজের কথায়, ম্যাজিক একটা শিল্প। এতে বিজ্ঞান, টেকনোলজি, শারীরিক দক্ষতা আর শোম্যানশিপ সবই লাগে। কোনো অলৌকিক কিছুই নেই।

প্রতুল চন্দ্র সরকারের সংক্ষিপ্ত রূপই হচ্ছে পি সি সরকার। আর এই সংক্ষিপ্ত নামেই বিখ্যাত হয়েছিলেন টাঙ্গাইলের এই কৃতিসন্তান। টাঙ্গাইলের আশেকপুর নামে ছোট্ট একটা গ্রামের কুঁড়ে ঘরে ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই কিংবদন্তি জাদুকরের জন্ম । পিতা ভগবান চন্দ্র সরকার এবং মাতা কুসুম কামিনী দেবী।

এমন মানুষ খুব কমই আছে জাদু সম্রাট পি সি সরকারের নাম জানে না । সারাবিশ্বে শুধু জাদুর খেলা দেখিয়েই তিনি গোটা বাঙালি জাতির জন্য কুড়িয়ে এনেছেন অনেক সুনাম আর গৌরব। ঊনিশ শতকের সেরা জাদুকর ছিলেন তিনিই। এই শতকে জাদুতে তার মতো আর কেউ এতটা আলোচনায় আসতে সক্ষম হয়নি।

স্থানীয় শিবনাথ হাইস্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু। বাল্যকাল থেকেই জাদুবিদ্যার প্রতি কৌতূহল এবং কিছুটা বংশগত ঐতিহ্যও তাকে এ পেশায় আগ্রহী করে তোলে। গণপতি চক্রবর্তী ছিলেন তার জাদুবিদ্যার গুরু। সপ্তম-অষ্টম শে্িরণতে পড়া অবস্থায় তিনি জাদু দেখানো শুরু করেন এবং কলেজে অধ্যয়নকালে পুরোপুরি এর প্রাকটিস শুরু করেন। তবে সাধারণ লেখাপড়া এতে বাধাগ্রস্ত হয়নি।

প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি এসে ভর্তি হন করটিয়া সাদত কলেজে। তখন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ ইব্রাহিম খাঁ। কলেজে এসেও চলল জাদুর ওপর পড়াশোনা আর ম্যাজিকের চর্চা। সারা কলেজে তখন তার প্রচুর নাম ডাক। চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে সকলের মুখে মুখে প্রতুলের অদ্ভুত জাদুর খেলার প্রশংসা।

করটিয়া কলেজে পড়ার সময়ে তিনি হিপ্নোটিজম নামে একটি বইও লিখেছিলেন। তখনকার করটিয়া কলেজ ছিল ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। তাই ১৯৩১ সালে আইএ পাস করে ডিগ্রী পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে এসে। এই কলেজ থেকে তিনি অংকে অনার্স নিয়ে বিএ পরীক্ষা দেন।

আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় তিনি ম্যাজিক শিক্ষা নামে আরও একটি বই লেখেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি জাদুকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে তার নাম ডাক এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি হলে অথবা কোথাও ম্যাজিক দেখাচ্ছেন শুনলেই দেখতে দেখতে প্রচুর দর্শক জড়ো হয়ে যেত।

জাদুকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পর তিনি চলে যান বড় শহরে বৃহত্তর ক্ষেত্রে। কারণ গ্রামে পড়ে থাকলে তার পসার জমবে না। তাই তিনি কলকাতায় পাড়ি জমান। প্রথমে ওঠেন তিনি ভাড়া বাড়িতে। পরে নিজেই বাড়ি করেন কলকাতার বালিগঞ্জে। অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতা শহরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নিয়মিত জাদুর অনুষ্ঠান করতে লাগলেন, আর সেই সঙ্গে পত্রপত্রিকাতেও শুরু করলেন জাদু বিষয়ে লেখালেখি। দুদিকেই তার খ্যাতি বাড়তে লাগল।

১৯৫৭ সালে পি সি সরকার লন্ডনের বিবিসি টেলিভিশনে করাত দিয়ে এক তরুণীকে কেটে দু টুকরো করে দেখিয়ে ছিলেন। এতে বহু টেলিভিশন দর্শক অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। পরের দিন লন্ডনের বড় বড় পত্রিকা এই লোমহর্ষক ও বিস্ময়কর খেলার খবরের সচিত্র বিবরণ প্রকাশ করে।

এই বিস্ময়কর খেলা দেখানোর পরপরই ১৯৫৭ সালের ২২ মে পি. সি. সরকারকে আমেরিকা টিভি কোম্পানিগুলো বিশেষ বিমানে করে নিয়ে যায় তাদের দেশে। ১৯৬৭ সালে তিনি আবার আমেরিকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ লাভ করেন। এই সময় তিনি আন্তর্জাতিক রোটারি ক্লাবের সদস্য এবং বিলেতের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন ফেলো নির্বাচিত হন।

জাদুবিদ্যার ওপর তিনি অনেকগুলো বইও লিখেছেন। ১৯৬৮ সাল নাগাদ ইংরেজি, বাংলা, ও হিন্দি ভাষা মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা মোট ২০টি।

জাদুসম্রাট পি সি সরকারের পারিবারিক জীবন ছিল অত্যন্ত সুশৃংখল। ১৯৩৮ সালে তিনি টাঙ্গাইলের নামি চিকিৎসক প্রমথনাথ গুহ মজুমদারের প্রথম কন্যা বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন। বাসন্তী দেবী ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী। পি সি সরকার যখন তার জাদুর খেলা নিয়ে মগ্ন থাকতেন ঘরের বাইরে কিংবা বিদেশে তখন লক্ষ¥ীর মতো সংসার সামাল দিতেন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী।

পি সি সরকারের দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। বড় ছেলে প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। মেজছেলে প্রদীপ চন্দ্র সরকার। যিনি এ সময়ে জাদুসম্রাট হিসাবে পরিচিত। তিনি বর্তমানে জুনিয়র পি. সি. সরকার নামে খ্যাত। ছোট ছেলে কমার্শিয়াল পাইলট।

জাদুশিল্পে পি.সি সরকারের কৃতিত্ব হলো তিনি বহু প্রাচীন জাদুখেলার মূল সূত্র আবিষ্কার করেন। ‘এক্স-রে আই’, ‘করাত দিয়ে মানুষ কাটা’, ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি তার জনপ্রিয় খেলা।

কলকাতার ইম্পেরিয়াল রেস্টুরেন্টে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হককে যে জাদু দেখিয়ে তিনি মুগ্ধ করেন, তার শিরোনাম ছিল ‘বাংলার মন্ত্রিমন্ডলীর পদত্যাগ’। এ শিরোনামের একটি সাদা কাগজে প্রথমে তিনি ফজলুল হককে কিছু লিখতে বলেন এবং তার নিচে মন্ত্রিগণ স্বাক্ষর করেন। কিছুক্ষণ পরে শেরে বাংলা তার নিজের লেখার পরিবর্তে দেখেন ‘আমরা সম্মতিক্রমে সকলেই এই মুহূর্তে মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করলাম এবং আজ হতে জাদুকর পি.সি সরকারই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।’ এটা ছিল -এর জাদু।

পি সি সরকারই প্রথম রাজকীয় পোশাক এবং আকর্ষণীয় পাগড়ি পরে জাদু প্রদর্শনের প্রচলন করেন।

জাদু দেখিয়ে পি.সি সরকার দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেজ ম্যাজিকের জন্য আমেরিকার জাদুবিদ্যার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ‘দি ফিনিক্স অ্যাওয়ার্ড’ তিনি দুবার লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘গোল্ডবার’ পুরস্কার, ‘সুবর্ণ লরেল মালা’ নামে জাদুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জার্মান পুরস্কার, হল্যান্ডের ‘ট্রিক্স পুরস্কার’ এবং ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি লাভ করেন।

১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি জাপানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়