ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মহাশ্মশানের মহাকবি

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহাশ্মশানের মহাকবি

শাহ মতিন টিপু : মহাশ্মশানের কবি কায়কোবাদ। তাকে মহাকবিও বলা হয়। ৭৯০ পৃষ্ঠার ‘মহাশ্মশান’ কায়কোবাদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এবং একমাত্র সার্থক মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত।

এ মহাকাব্যটিতে একদিকে স্বজাতিবোধ, দেশপ্রেম ও মুসলিমসমাজের ঐতিহ্য প্রকাশ করেছেন, পাশাপাশি বিশ্বশান্তি ও মানবতার কল্যাণে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সুসসম্পর্ক, পারস্পরিক সহানুভূতি এবং ঐক্য কামনা করেছেন।

সম্পূর্ণ অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মহাশ্মশান’ শুধু কায়কোবাদের নয়, মুসলিম কবি রচিত শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবেও স্বীকৃত। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধাবলম্বনে রচিত এ কাব্যে জয়পরাজয় অপেক্ষা ধ্বংসের ভয়াবহতা অধিক বিধৃত হয়েছে। তাই মহাকাব্যটির নাম রাখা হয়েছে ‘মহাশ্মশান’। ‘মহাশ্মশান’ কাব্যের জন্য কবি কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যে মহাকবির সম্মানে অধিষ্ঠিত।

ঊনিশ শতকের যুগস্রষ্টা বিপ্লবী কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহাকাব্য রচয়িতা। পরবর্তীকালে তার ধারা অনুসরণ করে যারা মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কায়কোবাদ ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী অসাধারণ মহাকাব্য রচয়িতা।

এই মহাকবির ১৬০তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার নবাবগঞ্জের আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ওই বছরটি ছিল ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লবের বছর। মহান ভাষা আন্দোলনের পূর্ব বছরে ১৯৫১ সালে ২১ জুলাই বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন মহাকবি কায়কোবাদ । পুরাতন আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন হয়। তিনি দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন অর্থাৎ ৯৪ বছর বেঁচে ছিলেন। জীবনের সুদীর্ঘ ৮২ বছরই তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন।

বাংলা কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

কায়কোবাদ ছিলেন মূলত একজন প্রেমিক কবি, বেদনার কবি, একজন আধ্যাত্মিক সাধক কবি। স্বদেশ প্রেম, সত্যনিষ্ঠা আর ইতিহাস ঐতিহ্য প্রীতি ছিল তার কবি প্রতিভার মৌল বৈশিষ্ট্য। তাকে বলা হয়, সৌন্দর্যের উপাসক। স্বভাব কবির ন্যায় তিনি তার কাব্যে অপূর্ব শিল্পচাতুর্যে প্রকৃতি ও নারীর স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। সঙ্গীত রচনায়ও তার হাত ছিল দক্ষ।

কায়কোবাদ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী মননশীলতার অধিকারী। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া তার ভালো লাগত না। তিনি ছিলেন জন্মগতভাবে সৃজনশীল। অতি অল্প বয়সে তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। মাত্র তেরো বছর বয়সে প্রথম কাব্য ‘বিরহবিলাপ’ প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে তিনি পিতা-মাতার বিয়োগ ব্যথা প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের জীবনের কষ্টকে পরম সহানুভূতির সাথে তুলে ধরেছেন। কাব্যটি প্রকাশিত হবার পর সর্বমহলে তিনি প্রশংসিত হন। ফলে তার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। তিনি নিয়মিত কবিতা লিখে চলেন। ছাত্রজীবনে লিখিত কবিতাগুলো সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

কে ঐ শোনালো মোরে আযানের ধ্বনি,/ মর্মে মর্মে সেই সুর,/ বাজিলো কি সুমধুর,/ আকুল হইলো প্রাণ, নাচিলো ধমনি।/ কি-মধুর আযানের ধ্বনি’।/ বিখ্যাত এই কবিতাটিও মহাকবি কায়কোবাদ রচিত। এমন অসংখ্য কবিতাসহ আধুনিক শুদ্ধ বাংলায় গীতিকাব্য, কাহিনী কাব্য, কাব্য উপন্যাস রচনা করে গেছেন তিনি।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে : কুসুম কানন, অশ্রুমালা, মহাশ্মশান, শিবমন্দির, অমিয়ধারা, শ্মশান ভস্ম, মহররম শরীফ, প্রেমের ফুল, প্রেমের বাণী, প্রেম-পরিজাত, মন্দাকিণী-ধারা ও গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ।

বাবা শাহামাতুল্লাহ আলী কোরায়শী ছিলেন ঢাকা জেলা জজ কোর্টের আইনজীবি। কায়কোবাদের পড়ালেখা ঢাকার পোগোজ স্কুল এবং সেইন্ট গ্রেগরি স্কুল, তারপর ঢাকা মাদ্রাসায়।

প্রকৃত নাম কাজেম আল কোরায়শী। লিখতেন মুন্সী কায়কোবাদ নামে। ১৯০৪ সালে মহাকাব্য ‘মহাশশ্মান’ লিখে মহাকবি উপাধিতে ভূষিত হন। বাংলা মহাকাব্যের দুঃসময়ে মহাকবি কায়কোবাদ মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনী নিয়ে ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য রচনা করে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন, তা তাকে বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় আসনে স্থান করে দিয়েছে। সেই গৌরবের প্রকাশে ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি কায়কোবাদ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়