ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’

পপ সম্রাট আজম খান

শাহ মতিন টিপু : এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে- গেয়েছিলেন আজম খান। স্বাধীনতার পর গানটি তার কণ্ঠে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটির কথা মতোই তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই।

আজম খান বাংলা পপ সঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী। তরুণ সমাজের কাছে ‘পপ সম্রাট’, আবার পপগুরুও। পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। কিন্তু মানুষ জানতো আজম খান নামেই। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, এটা গর্ব করেই বলতেন।

আজম খানের ৬৮তম জন্মদিন আজ। বেঁচে থাকলে ৬৭ বছর পূর্ণ হতো।১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে তার জন্ম। পপসম্রাট দীর্ঘদিন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন, ‘২০শে আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।’ এই কটি লাইনই বলে দেয় মুক্তিযুদ্ধে আজম খানের সম্পৃক্ততার কথা।

মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে আজম খানের গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকালে আজম খান পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর দুই-এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো। তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেওয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি পুনরায় আগরতলায় ফিরে যান।

এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান।

এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশান তিতাস’। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল), হোটেল পূর্বাণী'র গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশিরা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যা পরবর্তীতে তার শ্রবণ ক্ষমতায়  বিঘ্ন ঘটায়।

আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খানছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। মা জোবেদা খাতুন। তার তিন ভাই ও এক বোন ছিল। বড় ভাই সাইদ খান (সরকারি চাকরিজীবী), মেজো ভাই আলম খান (সুরকার), ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খানম।

তার পড়ালেখা শুরু ১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাদের। এসে ভর্তি হন কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে। এই স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। মুক্তিযুদ্ধের আবহে পড়ালেখা ওই পর্যন্তই থেমে যায় তার। আর অগ্রসর হতে পারেননি।

স্বাধীনতার পর সঙ্গীতে পপশিল্পী হিসেবে তিনি হঠাৎ করেই যেন ঝড়ের মতো আবির্ভূত হন। ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দু'টির প্রচার তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এরপর রেললাইনের ঐ বস্তিতে গানটি গেয়ে রীতিমত হৈ-চৈ ফেলে দেন। ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না’ এমন অনেক গানে গানে তিনি শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন। যা তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরতো।

আজম খান বিয়ে করেন ১৯৮১ সালে ঢাকার মাদারটেকের সাহেদা বেগমকে। তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রথম সন্তানের নাম ইমা খান এবং দ্বিতীয় সন্তানের 'হৃদয় খান' এবং তৃতীয় সন্তানের নাম অরণী খান। সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবনযাপন ছিল তার।

সৌখিনতার শেষ ছিল না আজম খানের। ১৯৯১-২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন। তিনি ‘গডফাদার’ নামক একটি বাংলা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেল হিসেবে কাজ করেন।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়