ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

পশ্চিম উপকূলে সুপেয় পানি সংকট!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২২ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পশ্চিম উপকূলে সুপেয় পানি সংকট!

রফিকুল ইসলাম মন্টু, পশ্চিম উপকূল ঘুরে : পানিকষ্ট নিবারণে দীর্ঘপথ পায়ে হাঁটা। সকাল-বিকেল-দুপুর পানির আধারগুলো ঘিরে নারী-পুরুষ ও শিশুদের জটলা। কলসি, বালতি, ড্রাম, জগ, যার যা আছে, তা নিয়েই ছুটে যান জলের কাছে। সুপেয় জলের সংকটটাই সবচেয়ে বেশি। কোথাও আবার গোসল, রান্নাবান্না আর সেচের পানির কষ্টটাও তীব্র হয়ে ওঠে।

দেশের পশ্চিম উপকূলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা আর বাগেরহাটের শরণখোলার প্রত্যন্ত গ্রামে এমনই ‘পানির দুর্ভিক্ষ’। তবে এই এলাকাগুলোর মধ্যে শ্যামনগরের অবস্থা সবচেয়ে সংকটাপন্ন। শব্দ দুটো পশ্চিম উপকূলে পানিকষ্টে থাকা মানুষের মুখেই শোনা। খাদ্য সংকটে যেমন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, ‘পানির দুর্ভিক্ষ’ তাদের কাছে ঠিক তেমনই। বহু চেষ্টা হয়েছে, বহু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে; কিন্তু পানিকষ্ট ঠিক আগের মতোই, যেমনটা ছিল পাঁচ-দশ বছর আগে। এমনটাই জানালেন এলাকার বাসিন্দারা।

শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম আটুলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া আর আটুলিয়া। এখানে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। কম করে হলেও লোকসংখ্যা দেড় হাজারের ওপরে। এই গ্রাম থেকে সুপেয় পানির উৎস কমপক্ষে তিন কিলোমিটার। এই দুই গ্রামের মানুষ পানি সংগ্রহ করেন একই ইউনিয়নের হেঞ্চি গ্রামের মনোরঞ্জন বৈরাগির বাড়ির পুকুর পাড়ে বসানো ফিলটার থেকে। দিনের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয় ভোর থেকে। কার আগে কে যাবে, লাইনের আগে থাকার চেষ্টা সবার। আগেভাগে খাবার পানির কলসিটা ঘরে তুলতে পারলে অন্যান্য কাজে সময় দেওয়া সম্ভব হবে।

তালবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা তাপস কুমার মন্ডল বলেন, পানির দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচতে চাই। বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানির কোন বিকল্প নাই। কিন্তু এই দুই গ্রামের কোন মানুষই প্রয়োজনীয় সুপেয় পানি পান না। ভোর হলেই পানির সন্ধানে ছুটতে হয়। সকাল ও বিকালে পানির ফিল্টারের কাছে সংগ্রহকারীদের লাইন দীর্ঘ হয়। পানির সংকট বারোমাসই থাকে। তবে মার্চ এপ্রিল ও মে মাসে তীব্রতাটা একটু বেশি।

 


খানিক এগিয়ে একই গ্রামের সুজাতা মন্ডলের বাড়ি গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। দিনে যে দু’কলসি পানি প্রয়োজন হয়, তা সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। জানালেন, ‘পানির কষ্টে আমরা তো মরি গেলাম। পানির দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের বাঁচাও।’

পড়ন্ত বেলায় আটুলিয়া থেকে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পথ ধরে আসার সময় বহু নারী ও শিশুর সঙ্গে দেখা মেলে। কলসিসহ পানি সংগ্রহের বিভিন্ন ধরণের পাত্র তাদের সঙ্গে। কেউবা একটু বেশি পানি সংগ্রহের জন্য ভ্যানে করে কয়েকটি ড্রাম নিয়ে যাচ্ছেন। ভিড় দেখে মনে হলো, যেন রাস্তায় মিছিলের জন্য জড়ো হয়েছেন তারা। খানিক এগিয়ে বুড়িগোয়ালিনীর দুলাল চন্দ্র মন্ডলের বাড়ি। শেষ বেলায় এই বাড়ির পুকুর থেকে সরাসরি পানি সংগ্রহ করেন অনেকেই। এদের কয়েকজন লাভলী রাণী, কুসুম রানী, সীতা রানী দাস, ফুলবাসী বানীমন্ডল, ভবানী রানী।              

এইচিত্র সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার। ইউনিয়নের হাজারো মানুষ বছরের পর বছর পানিকষ্টে দিন কাটাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এ এলাকায় সুপেয় জলের সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এই ইউনিয়নের লক্ষীখালী গ্রামের জরিনা খাতুন এক কলসি সুপেয় পানি সংগ্রহে দৈনিক দশ পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটেন। আসা-যাওয়ায় যাতায়াত দশ কিলোমিটার। যেতে আসতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে। এক কলসি পানিতে দিন পার হয় না বলে একই সঙ্গে পানি সংগ্রহে ছুটেন আরও দু’তিন জন।

এই ইউনিয়নের দশ নম্বর সোরা গ্রামের মো. ইদ্রিস মোড়লের স্ত্রী আছমা খাতুনের ঘরে ঢুকেই বোঝা যায় পানির সমস্যা তাদেরকে কতটা সংকটে রেখেছে। ঘরের ভেতরে কলসি, ড্রাম, থালাবাটি এমনকি পলিথিনে করেও পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এদের ঘরে একফোঁটা পানির মূল্য অনেক। নারী-পুরুষ ও শিশুরা পায়ে হেঁটে পানি আনেন, আবার কখনো ড্রাম ভরে ভ্যানে করেও আনেন। এতে পানির মূল্যটা আরও বেড়ে যায়।

এই গ্রামের আছমা খাতুন জানান, পানি কিনে আনতে হয় বলে চাহিদামত ব্যবহার করতে পারেন না। জলের অভাবে রান্না বন্ধ থাকে। আশাপাশের নদীর পানি নোনা। এ দিয়ে কখনো কখনো থালাবাসন ধোয়ার কাজ চলে। অনেকে সংকট কাটাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখেন। মার্চ-এপ্রিল থেকেই বৃষ্টির পানির পাত্র খালি হতে শুরু করে।

এলাকা ঘুরে জানা যায়, ঘরে একবেলা খাবার যোগাড়ের চেয়েও এই এলাকার মানুষের সুপেয় পানি যোগাড়ে বেশি সমস্যা। চাল, ডাল, নুন, তেল সবাই যোগাড় হলো; কিন্তু ঘরে সুপেয় পানি নেই। এর মানে সবকিছুই অচল। গোসল, রান্না করা, থালাবাসন ধোয়া এমনকি গরু-ছাগল ও হাঁসমুরগির পিপাসা মেটাতে ভরসা দূর থেকে আনা এই পানি।

 


লক্ষীখালী, চাঁদনিমূখা, দশ নম্বর সোরা গ্রামে ঢুকতেই বাসিন্দারা একই সমস্যার কথা জানান, পানির অভাব। এই সংকট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি বলে এলাকাবাসী জানালেন। তারা বলেন, নলকূপ বসানো হলেও মিষ্টি পানি ওঠে না। ১২০ ফুট পর্যন্ত পাইপ বসিয়েও পানের যোগ্য পানি মিলছে না। পর্যাপ্ত পুকুর ও পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) নেই। ইউনিয়নের কিছু এলাকায় পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা খুবই সীমিত।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলছে, ইউনিয়নের ৩ নম্বর ও ৫নম্বর ওয়ার্ড বাদে বাকি এলাকার মানুষ পুকুরের পানির ওপর নির্ভরশীল। অনেকস্থানে পুকুর কাছে নেই। লক্ষীখালী, খলিসা বুনিয়া, দশ নম্বর সোরা, চাঁদনিমুখা, নয় নম্বর সোরা, ডুমুরিয়া, চকবারা, খোলপেটুয়া, গাবুরা ও জালিয়াখালী গ্রামে পানির সংকট সবচেয়ে বেশি। সংকটাপন্ন এলাকার মানুষ বাধ্য হয়ে পুকুরের পানিই ব্যবহার করে। পুকুরের পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ইউনিয়নে ১২টি পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) রয়েছে। এগুলো সচল থাকলে পুকুরের পানি ফিল্টারের মাধ্যমে ব্যবহার করা যায়; কিন্তু অচল হয়ে গেলে পুকুরের পানি সংরক্ষিত থাকে না। তখন সমস্যা বেড়ে যায়।

এলাকার বাসিন্দারা জানান, ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এই এলাকায় পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। দেখা দেয় নানা রোগবালাই। সেই সময়ে সংকট নিরসনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কিছু এলাকায় পানির সংকট লাঘবের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখনও এলাকার বহু মানুষের প্রধান সমস্যা পানির অভাব।

পশ্চিম উপকূলের সবচেয়ে সংকটাপন্ন এলাকা শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র বলছে, এই উপজেলায় ৭২ হাজার ২৭৯টি পরিবারে লোকসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৩৫ হাজার। মোট পরিবারের মধ্যে মাত্র ৫০ শতাংশের কাছে সুপেয় পানি পৌঁছানো সম্ভব হয়। বাকি পরিবারগুলো পানিকষ্টে থাকে। ইউনিয়নগুলোর মধ্যে ভুরুলিয়া, শ্যামনগর সদর, ঈশ্বরীপুর, বুড়িগোয়ালিনী ও নূরনগরের অবস্থা বেশি খারাপ।  

শ্যামনগরের পানি সংকট প্রসঙ্গে জানতে জানতে আলাপ হয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। এলাকার মানুষের পানিকষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সংকট উত্তরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকার ভূ-তলের জলের ওপর থেকে চাপ কমাতে উপরিভাগের পানি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে। এজন্য জেলা পরিষদের লিজকৃত পুকুরগুলো অবমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’ এই উদ্যোগের মধ্যদিয়ে এখানকার পানিকষ্ট অনেকটা লাঘব হবে বলে মনে করেন তিনি।     

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়