ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শেষ মুহূর্তে বেঁচে যান শহীদ জমাদ্দার

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৬ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শেষ মুহূর্তে বেঁচে যান শহীদ জমাদ্দার

শহীদ জমাদ্দার

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দিশেহারা বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পর প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে সংগঠিত হতে থাকে। শহর থেকে গ্রামে সব স্থানে চলে প্রতিরোধের পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন তরুণ শহীদ জমাদ্দার। সেই সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। 

সেই তরুণ জমাদ্দারের বয়স এখন ৬৪ বছর। রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে তিনি তুলে ধরেন উত্তাল সেইসব দিনের কাহিনী, পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসার কথা, বর্তমানে কেমন কাটছে তার দিন ইত্যাদি।

মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জমাদ্দার খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামের মৃত রফি উদ্দিন জমাদ্দারের ছেলে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম। তিন বোন বিবাহিত, নিজ নিজ সংসার করছে। তার বড় ভাই হারুনার রশিদ জমাদ্দারও মুক্তিযোদ্ধা। জেলা মুজিব বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার। বর্তমানে ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা।

শহীদ জমাদ্দারের তিন মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। বসবাস করছেন খুলনা শহরের নিরালা প্রান্তিকা মসজিদসংলগ্ন কাশেম নগরে। শহীদ হাদিস পার্ক সংলগ্ন স্থানে ‘শহীদ মাইক সার্ভিস’ নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি। একই সঙ্গে একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রূপসা উপজেলা শাখার সহকারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শহীদ জমাদ্দার যুদ্ধকালীন তার ওপর চালানো অত্যাচার-নির্যাতন এবং যুদ্ধের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, হোল্ডিং ট্যাক্সের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্যুৎ ও পানির বিলও মওকুফের।

শহীদ জমাদ্দার জানান, ১৯৭০ সালে তার চাচা শফি আহমেদ জমাদ্দার খুলনার মহসিন জুটমিলের শেয়ার হোল্ডার ছিলেন। ওই সময় মিল মালিক মহসিন হোসেন ’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ছিলেন। চাচার অনুরোধে বড় ভাই হারুন অর রশিদ জমাদ্দার ও তিনিসহ ১৩/১৪ জন কিশোর-তরুণ মহসিন হোসেনের পক্ষে নির্বাচনী কাজে নামেন। তার পক্ষে মিছিল বের করলে মুসলিম লীগের সিদ্দিক আহমেদ জমাদ্দার (তৎকালীন শ্রীফলতলা ইউপি চেয়ারম্যান) ও মজিদ শেখ তাদের ওপর হামলা চালান। তার বড় ভাই হারুন অর রশিদ তখন খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই  ঘটনার পর বড় ভাই ভয়ে স্থানীয় পালের বাজারের পাশে নন্দনশ্রী গ্রামের হাশেম হালদারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এর মধ্যে নির্বাচন পরবর্তী উত্তাল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেন হারুন অর রশিদ।  এক পর্যায়ে ডাক আসে বঙ্গবন্ধুর, দেশকে স্বাধীন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হারুন ভারতে চলে যান।

শহীদ জমাদ্দারও বাড়ি ছেড়ে তেরখাদার পাতলা স্কুলে চালু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নেন। সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন ফহম উদ্দিন, বোরহান উদ্দিন মাস্টার, তৎকালীন তেরখাদা থানার ওসি নিরঞ্জন কুমার এবং তৎকালীন কোদলা ইউপি চেয়ারম্যান নওশের আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন।

এরই মধ্যে ৭১’ সালের অক্টোবর মাসের একদিন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর লিখিত ‘খুলনা অ্যাটাক’র একটি চিঠি অপর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ হোসেনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় শহীদ জমাদ্দারকে। নওশের চেয়ারম্যান প্রাপকের নাম ছাড়াই শুধু সাদা ও গোলাপি কালারের শার্ট-প্যান্ট পরা এক ব্যক্তির নমুনা বলে একটি খাম দিয়ে জেলখানা ঘাটে পৌঁছে দিতে বলেন। খামটি ওই ব্যক্তিকে পৌঁছে দেওয়ার পর শহীদের কাছে পাল্টা একটি খাম দিয়ে সেটি পাতলা ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলা হয়। শহীদ খাম নিয়ে নৌকায় করে বর্তমান বঙ্গবন্ধু কলেজের সামনে পৌঁছলে পাকিস্তানি নৌবাহিনী তাকে আটক করে। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটকের পর ট্রেনিং ক্যাম্প এবং সহযোগীদের নাম জানতে চায় পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা। না বলায় সিগারেট এবং চুলার জলন্ত কাঠ দিয়ে শহীদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেয়। নির্যাতনের সময় তারা বলে, ‘তেরা ফৌজ কাহা, ছাচ বাতা, ছৌড় দেইলে’ (তোদের লোকজন কোথায়, সত্যি কথা বল, ছেড়ে দেব)।

এক পর্যায়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর লঞ্চে থাকা স্থানীয় আলাউদ্দিন লস্করের ছেলে রাজাকার ল ম লিয়াকত লস্করকে (পরবর্তীতে সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সহযোগী) শহীদ জমাদ্দারের বাড়িতে পাঠানো হয়। তখন শহীদ জমাদ্দারের চাচাত ভাই সিদ্দিক আহমেদ জমাদ্দার এবং তার ছেলে নজরুল জমাদ্দার খোঁজ নিতে আসা লিয়াকত লস্করকে জানান, ‘শহীদরা দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা’। ফলে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সদস্যরা শহীদ জমাদ্দারকে খালিশপুর নেভি ক্যাম্পে নিয়ে ছয় দিন আটক রাখে। নৌ কমান্ডার আসলাম উদ্দিন খানসহ অন্যরা তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে কমান্ডার আসলামের ভাইয়ের নামও ‘শহীদ’ হওয়ায় তিনি কিছুটা সহানুভূতি দেখান।

কিশোর শহীদ জমাদ্দারকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নেয় পাক বাহিনী। সে মোতাবেক শহীদকে প্রস্তুত হতে বলা হয়। এ সময় শহীদকে পাক নৌবাহিনী এক মেজরের অফিসে নেওয়া হলে সেখানে খালিশপুর চরের হাটের ঠিকাদার (পাকিস্তান নৌ বাহিনীর খাদ্য সরবরাহকারী) আব্দুর রউফ শেখকে বসা দেখতে পান শহীদ জমাদ্দার। পরে রউফ শেখের অনুরোধে শহীদ জমাদ্দারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে শহীদ ছাড়া পেয়ে জোড়াগেট মোড়ে আসার পর দুইজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার দেখা পান।

শহীদ বাড়িতে গিয়ে খবরটি মাকে জানিয়ে প্রতিবেশী আউয়ুব শেখ ও রশিদ সরদারকে নিয়ে পাতলা ক্যাম্পে ফিরে যান। ক্যাম্পে তাদের দুইজনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। পরে আলাইপুর, বাতিখালকুলি এবং পোলেরহাটে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় বেলফুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। এভাবে অস্ত্র হাতে তিনটি লড়াইয়ে সরাসরি অংশ নেন শহীদ জমাদ্দার।

শহীদ জমাদ্দার জানান, প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি হিসেবে তিনি ৩০০ টাকা ভাতা পেতেন। পরবর্তীতে বেড়ে ৫০০ টাকা, পরে ৮০০০ টাকা, বর্তমানে ১০ হাজার টাকা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পরিবার-পরিজনের খরচ এবং সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। তা বাড়িয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার করার দাবি জানান তিনি।

সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদ্যুৎ ও পানির বিলও মওকুফের দাবি জানান তিনি।

 

রাইজিংবিডি/খুলনা/২৬ মার্চ ২০১৭/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়