ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

চরাঞ্চলে মহিষের দুধের দধির সুনাম

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চরাঞ্চলে মহিষের দুধের দধির সুনাম

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার চরাঞ্চল ঘুরে : মাটির হাঁড়িতে পাতা এ দধির ওপরের দিকে উঠে আসে প্রায় এক ইঞ্চি পুরু দুধের সারাংশ। ভিন্ন স্বাদের এ দধি চিনি কিংবা লবণ মিশিয়ে খেতে খুবই সুস্বাদু। কেউ ভাতের সঙ্গে খেতে পছন্দ করেন, কেউবা খালি।

এক সময় শুধু উপকূলের নির্দিষ্ট এলাকায় এ দধি পাওয়া গেলেও এখন এর বাজার রাজধানী ছাড়াও দেশের বড় শহরগুলোতেও। কিন্তু মহিষের খাবার কমে যাওয়ায় মহিষের দুধের সেই সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় বিকশিত হতে পারছে না।

মহিষের দুধের দধি আগাগোড়াই লোভনীয়। দেশের সব স্থানে এ দধি পাওয়া না গেলেও উপকূলের কিছু এলাকায় উৎসব-পার্বণে মহিষের দধি চাই-ই চাই। বিয়ে বাড়ির নতুন অতিথির সামনে এ দধি পরিবেশন করতে না পারলে যেন সম্মানই চলে যায়। ঈদ, পূজা ছাড়াও সব বড় অনুষ্ঠানে এ দধির বাড়তি কদর। আর এ ঐতিহ্য চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপকূলের চরাঞ্চলে চরে বেড়ানো মহিষ থেকে আসে দুধ। কোনো রকমের মিশ্রণ ছাড়াই এ দুধ দিয়ে তৈরি হয় খাঁটি দধি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপকূলীয় জেলা ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর চরাঞ্চলে আছে অসংখ্য মহিষের বাথান। এসব বাথানে হাজার হাজার মহিষ চরে বেড়ায়। দধি তৈরির যোগানদাতা এসব মহিষ। মহিষের দুধ দিয়ে অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি হলেও মহিষের দুধের এ দধি এখনো তার পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কোনো ধরনের ভেজাল নেই, কেমিক্যাল নেই। বাথানের মহিষ থেকে পাওয়া দুধ সরাসরি হাঁড়িতে চলে যায়। বেলা দু’টার দিকে হাঁড়িতে বসানো দুধ সন্ধ্যা ৭টার দিকে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই দধিতে পরিণত হয়।

দ্বীপ জেলা ভোলার অবস্থান মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যবর্তী স্থানে। এই দুই নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চরে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে উঠেছে মহিষের বহু খামার। এক হিসাবে জানা গেছে, এই অঞ্চলে মহিষের প্রায় অর্ধশত খামার রয়েছে। এক একজন মালিকের অধীনে এসব খামারে রয়েছে শত শত মহিষ। বাথানে মহিষের সাথে বাতানদের (রাখাল) নিবিড় এক সখ্যতা গড়ে ওঠে। মধুচাঁন, কালী কুমার, কালাপাখি, মধুমালা, বোয়ার্নি, লালমনি, বর্ষিসহ বিভিন্ন নাম রাখা হয় মহিষের। বাতানরা এই নামে ডাকলেই কাছে চলে আসে মহিষগুলো।

দধি ব্যবসায়ীরা জানান, দৌলতখান বাজারে চরাঞ্চলের মহিষের বাথান থেকে হকারের মাধ্যমে প্রতিদিন দুধ আসে। এখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী এ দুধ সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। কারো ব্যবসা দৌলতখান ছাড়াও ভোলা জেলায় সীমাবদ্ধ, কেউবা একটু ভালো দাম পাওয়ার আশায় মহিষের দুধের দধি ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন শহরে পাঠান। ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে মহিষের দুধ কম পাওয়া যায়। এ সময় দুধের কেজি একশ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে দুধ বেশি হয়। এ সময় দুধ বিক্রি হয় ৩৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। তবে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে মহিষের দুধের দাম বাড়ে।

ভোলার দৌলতখান উপজেলা সদরে বেশ ক’জন মহিষের দুধের দধির কারিগরের সঙ্গে আলাপকালে এরা জানালেন, বাপদাদার আমল থেকে এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ চরাঞ্চলে মহিষের মালিকদের আগাম দাদন দিয়ে দুধ সংগ্রহ করেন, কেউবা মহিষের দুধের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে দধি তৈরি করেন। দধি ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী দুলাল চন্দ্র ঘোষ জানান, খাঁটি মহিষের দুধ দিয়ে দধি তৈরি হয়। এর মধ্যে কোনো ধরণের ভেজাল নেই। এ দুধ অনেক ঘন। তাই স্বাদ বেশি। এ দধিতে কোনো ধরণের কেমিক্যাল নেই।

ভোলা জেলা সদরের ঘোষপট্টিতে প্রতিদিন মহিষের দুধ আসে চরাঞ্চল থেকে। দুধের গাড়ি এসে পৌঁছালে ক্রেতা-বিক্রেতারা ব্যস্ত সময় পার করেন। দুধ সংগ্রহ করা হয় দধি তৈরির জন্য। দোকানিরা জানালেন, ভোলার মহিষের দুধের টকদধি বেশ জনপ্রিয়। সারা বছরই কমবেশি মহিষের দুধ পাওয়া গেলেও শীতে এই দুধের তৈরি টকদধির চাহিদা বহু গুণ বেড়ে যায়। দুধ কম আর দাম বেশি হলেও চাহিদায় কমতি থাকে না। কারণ এই সময় বিয়েসহ অনুষ্ঠানাদি বেশি থাকে। এ কারণে দধি বিক্রেতারা সব সময় ব্যস্ত থাকেন দধি তৈরির কাজে।

৫০ বছর ধরে মহিষের দুধের দধি তৈরির সঙ্গে যুক্ত ৭৫ বছর বয়সী মো. হাবিবুল্লাহ জানান, মহিষের দুধে তৈরি দধির চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। বেচাকেনাও বেশ ভালো। তবে বাজারজাতকরণে কিছু সমস্যা থাকায় এখানকার বেশিরভাগ দধি এখানেই বিক্রি হয়। বাইরের বাজারে পাঠানোর সুযোগ কম।

সম্ভাবনার মাঝেও নানা সংকটের কথা শোনালেন সংশ্লিষ্টজনেরা। তারা জানান, মহিষ পালনে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম বেড়েছে। মহিষের খাবার কমে এসেছে। ঘন ও পুষ্টিকর দুধ পেতে ‘উড়ি’ ও ‘এলি’ জাতের ঘাস আর ‘চিরিঙা’ লতার উৎপাদনও কমে গেছে। লবণ পানি, ঘাসের স্বল্পতা, স্বাস্থ্যসেবা আর মহিষ চোরের উপদ্রব মহিষ পালনে অন্যতম সমস্যা বলে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া মহিষের দুধ ও দধি সংরক্ষণেও সমস্যা আছে।

খামার মালিকরা জানালেন, লবণাক্ত পানি ও ঘাস কমে যাওয়ার কারণে দুধ কম হচ্ছে। অনেক সময় মহিষের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। সময় মতো মহিষের ডাক্তার পাওয়া যায় না। ওষুধপত্র পাওয়া খুবই কঠিন। তবে মহিষের দুধের সুনাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তাই দধির কদর অনেক বেশি। দুধ বিক্রি লাভজনক হলেও সমস্যা কাটাতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

ভোলা জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, মহিষের দুধের তৈরি টকদধি উৎপাদন করে দেশ ও বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। পুষ্টির অভাবও দূর করে মহিষের দুধ। চরাঞ্চলে মহিষ পালনে কিছু সমস্যা থাকলেও প্রাণিসম্পদ বিভাগের লোকবল স্বল্পতার কারণে অনেক সময় যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।

কে কবে মহিষের দুধ দিয়ে দধি তৈরির প্রচলন শুরু করেছিলেন, তা এখানকার কেউ বলতে পারেননি। তবে আদিকাল থেকেই স্থানীয়দের কাছে এর কদর ছিল। বয়সী ব্যক্তিরা সে রকমটাই জানালেন। তারা জানান, উপকূলের মহিষের দুধে আছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মহিষের দুধভিত্তিক কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে  তুলতে পারে। এর মাধ্যমে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়