ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হিন্দি ভাষা মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝাতেন শুকুর আহমেদ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিন্দি ভাষা মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝাতেন শুকুর আহমেদ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : ভারতীয় প্রশিক্ষকদের হিন্দিতে বলা কথা বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দিতেন সিপাহী শুকুর আহমেদ শেখ। যা বাঙালি কিশোর, তরুণ, যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত প্রশিক্ষণ নিতে সহায়ক হত।

এ কারণে ভারতের চব্বিশ পরগনার টেট্টা ট্রেনিং ক্যাম্পে এ যুবক মুক্তিযোদ্ধার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। শুকুর আহমেদ দুটি যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। থানা লুট করে হাতিয়ার তুলে দিয়েছেন বীর বাঙালির হাতে হাতে। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে রেখেছেন জীবনবাজিও।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশ বিজয়ের পর চার দশক ধরে একে একে রক্ষীবাহিনী, সেনাবাহিনী এবং মোংলা বন্দরেও চাকরি করেছেন। দীর্ঘ চাকরি জীবন পার করে বর্তমানে হাপিয়ে উঠেছেন তিনি। বার্ধক্য তাকে কাবু করে ফেলেছে। বার্ধক্যের পাশাপাশি তিনি নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতেও আক্রান্ত। উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেন না। মুত্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাপ্ত ভাতা ও সামান্য মাথাগোজার ঠাঁইই এখন তার শেষ সম্বল।

শুকুর আহমেদ শেখ বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার আটজুরী ইউনিয়নের কাহালপুর গ্রামের কৃতি সন্তান। তিনি ওই গ্রামের প্রয়াত মো. আব্দুল জব্বারের ছেলে। তার একমাত্র বোন মারা গেছেন। বর্তমানে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের পূর্ব বয়রায় (পোর্ট স্কুলের বিপরীতে) বসবাস করছেন। তিনি ১১ সন্তানের জনক (ছয় মেয়ে, পাঁচ ছেলে)। বড় মেয়ে মারা গেছেন। তিন মেয়ে এবং চার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। চার ছেলে পুলিশ বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত। স্ত্রী আয়েশা বেগম ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ মারা যান।

এই মুক্তিযোদ্ধা সম্প্রতি তার খালিশপুরের বাসায় রাইজিংবিডির কাছে মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক নানা ঘটনা এবং অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেন। বলেছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়েও।

শুকুর আহমেদ শেখ বলেন, ১৯৭১ সালে তার বয়স আনুমানিক ২২ থেকে ২৫ বছর। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের আলমনগর এলাকায় বসবাস করতেন। করতেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। এমনই একটি সময় যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে। স্বাধীনচেতা এবং ডানপিঠে শুকুর আহমেদ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর   প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। একদিন বিকেলে তিনি প্রতিবেশী আব্দুর রাজ্জাক ও মোখলেসসহ কয়েকজনকে নিয়ে বৈকালী এলাকায় মিছিলে অংশ নেন।

ওই মিছিলেই পাকিস্তানি সেনারা গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে অনেকেই হতাহত হন। কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি সেনারা ওই দিন রাতে ধীরে ধীরে বর্তমান পলিটেকনিক কলেজ, আলমনগর এবং নিউজপ্রিন্ট মিলের মধ্যেও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। ওই দিনের ঘটনায় শতাধিক মানুষ নিহত এবং বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। তবে অনেক লাশ নিউজপ্রিন্টের ঘাট দিয়ে ভৈরব নদে ডুবিয়ে দেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।

ওই দিনের পর শুকুর আহমেদ স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি পরদিনই তাদের রেখে আসতে গ্রামে যান। সেখানে তাদের রেখে প্রতিবেশী ও বন্ধু সলেমান কাজী, তার ভাগ্নে আব্দুল হাই, ওলিয়ার রহমান শেখ, ফুলমিয়া শেখ, কবির ও মুক্তসহ ১৩ জনকে নিয়ে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।

তারা বামনডাঙ্গা, যশোর দিয়ে বরইছড়া হয়ে ভারতের টাকি স্টেশনে পৌঁছান। সেখান থেকে চলে যান পব্বিশ পরগনার টেট্টা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের ১৪ নম্বর প্লাটুনে যোগ দেন তিনি। ওই প্লাটুনে মোট ৩৪ জন ছিল। প্রশিক্ষণকালীন তিনি ভারতীয় প্রশিক্ষকদের হিন্দিতে বলা কথা বাংলায় অনুবাদ করে সহযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দিতেন। যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত প্রশিক্ষণ নিতে সহায়ক হত। সেখানে দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণের পর এমএলএ খয়ের মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে যান। সেখানে জাতীয় চার নেতাসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও ছিলেন। সেখান থেকে তাকে নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

দেশে ফিরে সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের অধীনে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ওই সময় শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহূর্তে তিনি মোল্লাহাটের চরকুলিয়া হাড়িদিয়া সেতুর কাছে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন।

এ যুদ্ধের স্মৃতি আউড়িয়া তিনি জানান, ইতিপূর্বে মুক্তিযোদ্ধারা হাড়িদিয়া ব্রিজ ভেঙে দেন। কিন্তু শুক্রবার মুক্তিযোদ্ধারা নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সুযোগে রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়ে গ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হাড়িদিয়া নদীতে কচুরিপানার মধ্যে অস্ত্র হাতে লুকিয়ে পড়েন। সেখান থেকে গুলি চালানো হয়। গুলিতে এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মারা যায়। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে।

শুকুর আহমেদ জানান, এর আগে তার নেতৃত্বে ১১ জন মোল্লাহাট থানা আক্রমণ করে ১৩টি অস্ত্র লুট করেন। যা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। পরবর্তীতে ২৬ জন সঙ্গী নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতে যান শুকুর আহমেদ। সেখানে ক্যাপ্টেন সিপারের নেতৃত্বে ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকেই ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের খবর পান। পরে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। তার মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৫৩৮০২, মুক্তিবার্তা (লালবই) নম্বর ০৪০৩০৩১০৪৬ এবং গেজেট নম্বর ২৬৮৭।

শুকুর আহমেদ জানান, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিন মাস তিনি আনসার প্রশিক্ষণ নেন। আর যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি রক্ষীবাহিনীতে যোগ দেন। রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হলে ১৯৭৫ সালের পর তিনি সেনাবাহিনীতে সিপাহী হিসেবে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। সৈনিক হিসেবে ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এরপর মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বিভাগে যোগ দেন। এ চাকরি থেকেও তিনি ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি বাড়িতেই সময় পার করছেন।

এই সিপাহী মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সরকার তাকে মাথাগোজার ঠাঁই হিসেবে ৫ দশমিক ৭৩ শতক জমি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এই জমির জন্য তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ ছয়টি মামলা দায়ের করে। চার বছর আইনি লড়াই করে উচ্চ আদালত পর্যন্তও তাকে দৌড়াতে হয়েছে। ব্যয় করতে হয়েছে অনেক অর্থও। এরপর তিনি দখল পেয়েছেন। কিন্তু এখনও দলিল করে দেওয়া হয়নি।

এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভুয়াদের ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ দাবি করেন।




রাইজিংবিডি/খুলনা/২৮ মার্চ ২০১৭/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/রিশিত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়