ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নানা দেশে নববর্ষ

কে এম আব্দুল মোমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৬, ১৩ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নানা দেশে নববর্ষ

কে এম আব্দুল মোমিন : মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে নববর্ষের উৎসব মূলত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন রচনায় আবহমান কাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পুরাতন বছরকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বের নানা দেশের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে তাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা, দুর্ভাগ্য-হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি হতে মুক্তি কামনা করে। নববর্ষের প্রারম্ভে তারা বিপুল সম্ভাবনা, সৌভাগ্য, সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। বিভিন্ন আনন্দময় আনুষ্ঠানিকতায় তারা তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট নশ্বর জীবনকে কিছুটা উপভোগ করতে চায়। তাদের এ চাওয়া একান্তই মানবিক, সার্বজনীন ও চিরন্তন।

নববর্ষের উৎসব ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় শুরু হয়। প্রায় সমসাময়িক কালে ব্যাবিলনে স্পিংকুইনক্স বা মার্চ মাসের মাঝামাঝি চান্দ্র মাসের প্রথম তারিখে আকিতু বা নববর্ষ উদযাপিত হতো। অ্যাসিরিয়ায় নববর্ষের তারিখ ছিল অটাম ইকুইনক্স অর্থাৎ মধ্য সেপ্টেম্বর। মিশর, ফিনিসিয়া ও পারস্যে অটাম ইকুইনক্স বা সেপ্টেম্বর ২১ তারিখে নববর্ষের উৎসব উদযাপিত হতো।

প্রাচীন গ্রিসে এ উৎসব পালন করা হতো উইন্টার সোলাসটিস বা ডিসেম্বর ২১ তারিখে। আর প্রাচীন রোমান রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষের তারিখ ছিল ১ মার্চ। ১৫৩ খৃস্টপূর্বাব্দের ১ জানুয়ারি তারা দাপ্তরিভাবে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত রোমান রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার বহাল ছিল।

মধ্যযুগের প্রথম দিকে অধিকাংশ ইউরোপিয় খ্রিস্টসম্প্রদায় ২৫ মার্চ তারিখ এনানসিয়েশন উৎসব দিবস হিসেবে শ্রদ্ধা করতো। তারা এ দিবসটিকেই নববর্ষরূপে পালন করতো। অপরদিকে, ইংল্যান্ডে এ্যাংলো-স্যাক্সনগণ ডিসেম্বর ২৫ তারিখে নববর্ষের উৎসব উদযাপন করতো। পরবর্তী সময়ে বিজয়ী উইলিয়াম ১ জানুয়ারি নববর্ষ ঘোষণা করেন।

তারপর ইংল্যান্ড অন্যান্য দেশের স্টসম্প্রদায়ের মতো ২৫ মার্চকে নববর্ষরূপে গ্রহণ করে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক চার্চ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশে তা অনুসৃত হয়। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ড, ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও ডেনমার্ক, ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে।

অপরদিকে, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত কারণে যারা চান্দ্র বর্ষ অনুসরণ করতো, তারা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে সৌরবর্ষের ১ জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাদের প্রচলিত তারিখ তারা বহাল রাখে। যেমন, ইহুদিগণের ধর্মীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে ‘রোজ হাসানা’ বা নববর্ষ ‘তিসরি’ মাসের প্রথম তারিখ। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে তাদের নববর্ষ উদযাপিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর হতে ৫ অক্টোবর এর মধ্যবর্তী সময়ে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্যালেন্ডারবর্ষ সাধারণত ৩৫৪ দিনে হয়ে থাকে। আর বছর শুরু হয় মহরম মাস হতে। চৈনিক নববর্ষ শুরু হয় জানুয়ারির শেষে অথবা ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম দিকে। এশিয়ার অন্যান্য দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বিভিন্ন সময়ে তাদের নিজ নিজ নববর্ষ শুরু হয়। দক্ষিণ ভারতের তামিলরা উইন্টার সোলাসটিস বা ডিসেম্বর ২১ তারিখে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। তিব্বতে ফেব্রুয়ারি মাসে আর থাইল্যান্ডে মার্চ অথবা এপ্রিল মাসে নববর্ষের উৎসব পালন করে। জাপানে এ উৎসব ১-৩ জানুয়ারি পালিত হয়।

নববর্ষের উৎসব উদযাপনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদের অনুভূতি লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন গ্রিসে শিশুকে নববর্ষের ও বৃদ্ধকে পুরাতন বর্ষের প্রতীকরূপে গণ্য করা হতো। রোমানগণ ‘জানুস’ দেবতার নামে জানুয়ারি মাসের নাম রাখে। এ দেবতার দুটি মুখ ছিল। একটি সামনে, অপরটি পেছনে। প্রাচীনকালে নববর্ষের প্রথম দিবসে মন্দ অভ্যাস ত্যাগ ও ভাল অভ্যাস অর্জনের প্রতিজ্ঞা করতো। স্কটিশরা অতীত স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করে।

অনেকে নববর্ষের উৎসব উদযাপনে প্রতীকী খাবার গ্রহণ করে থাকে। ইউরোপের অনেক দেশে নববর্ষে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বাঁধাকপি খেয়ে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকায় সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে কালো জাতের সিম খেতে পছন্দ করে। এশিয়ায় পান্তা ভাত, নুডলজ, পিঠা ইত্যাদি দীর্ঘজীবন, সুখ, সমৃদ্ধি ও সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতীক হিসেবে খেয়ে থাকে।

বাংলা নববর্ষ
বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খন্ডের বাঙ্গালিরা উদযাপন করে থাকে। শত শত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ তারিখে নববর্ষ উদযাপিত হয়। বাংলায় পয়লা অর্থ প্রথম এবং বৈশাখ হচ্ছে বছরের প্রথম মাস। এ জন্য বাংলা নববর্ষকে পয়লা বৈশাখ বলা হয়। নব ও বর্ষ শব্দ দুটি সংস্কৃত থেকে আগত। নববর্ষ অর্থ নতুন বছর।

বাংলা সপ্তাহের সাত দিনের ও বাংলা বছরের বার মাসের নামও অনুরূপভাবে বৈদিক যুগে প্রণীত হিন্দু ক্যালেন্ডারসমূহে ব্যবহৃত সংস্কৃত হতে এসেছে। প্রাচীন গ্রীকদের মতো বিভিন্ন নক্ষত্র ও দেবতাদের নামানুসারে এগুলোর নামকরণ করা হয়েছে।

সপ্তাহের সাত দিনের নাম

 

বাংলা বারের নাম

গ্রেগরিয়ান বারের নাম

মূল নাম

নক্ষত্র/দবে-দবেী

রবিবার

Sunday

রবি

সূর্য/সান (গ্রিক)

সোমবার

Monday

সোম

চন্দ্র/শিব/মুন (গ্রিক)

মঙ্গলবার

Tuesday

মঙ্গল

মঙ্গল/মার্স (গ্রিক)

বুধবার

Wednesday

বুধ

বুধ/মার্কারি (গ্রিক)

বৃহস্পতিবার

Thursday

বৃহস্পতি

বৃহস্পতি/জুপিটার (গ্রিক)

শুক্রবার

Friday

শুক্র

শুক্র/ভেনাস (গ্রিক)

শনিবার

Saturday

শনি

শনি/সেটার্ন (গ্রিক)
 


বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে সূর্যোদয়ে পুরাতন দিনের বিদায় ও নতুন দিন শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে মধ্যরাতে পুরাতন দিনের বিদায় ও নতুন দিন শুরু হয়।

বছরের বার মাস ও ছয় ঋতুর নাম

ক্রমিক নম্বর

বাংলা মাসের নাম

গ্রেগরিয়ান মাসের নাম

নক্ষত্রের নাম

বাংলা ঋতুর নাম

ইংরেজিতে ঋতুর নাম

০১

বৈশাখ

April-May

বিশাখা

গ্রীষ্ম

 

Summer

০২

জৈষ্ঠ্য

May-June

জেষ্ঠা

০৩

আষাঢ়

June-July

উত্তরাষাঢ়া

বর্ষা

 

Rainyseason

০৪

শ্রাবণ

July-August

শ্রবণা

০৫

ভাদ্র

August-September

পূর্বভাদ্রপদ

শরৎ

 

Autumn

০৬

আশ্বিন

September-October

অশ্বিনী

০৭

কার্তিক

October-November

কার্তিকা

হেমন্ত

 

Late Autumn

০৮

অগ্রহায়ণ

November-December

মৃগশিরা

০৯

পৌষ

December-January

পূষ্যা

শীত

 

Winter

১০

মাঘ

January-February

মঘা

১১

ফালগুন

February-March

উত্তরফালগুনী

বসন্ত

Spring

১২

চৈত্র

Mach-April

চিত্রা

 

বেদ গ্রন্থসমূহ অবলম্বনে খৃস্টপূর্বাব্দের শেষদিকে প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী লগধা সময় গণনার পদ্ধতি সম্পর্কে ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষা’ প্রণয়ন করেন। তার এ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে বিভিন্ন হিন্দু ক্যালেন্ডারের উদ্ভব ঘটে। এ সমস্ত হিন্দু ক্যালেন্ডারের মধ্যে বঙ্গ বর্ষপঞ্জি বা বাংলা ক্যালেন্ডার অন্যতম।

সাল গণনার ইতিহাসে শাকা বংশের রাজত্বকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাকা সাট্রাপসদের রাজত্বকালে উজ্জয়িনী নগর জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নের কেন্দ্রভূমি হিসেবে প্রভূত প্রসিদ্ধি লাভ করে। বৈদিক ‘লুনি-সোলার’ বা সৌর ও চান্দ্র বর্ষের সমন্বয়ে ৭৮ খৃস্টাব্দে উজ্জয়িনী নগরের জ্যোতির্বিদগণের প্রণীত ‘শালিবাণ’ বা ‘শাকা কাল’ বা শকাব্দ প্রচলিত হয়। দিন ও মাসের নাম বৈদিক লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার থেকেই শকাব্দে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে শাকাগণ গুজরাট অঞ্চলে গমন করে। সেখানে জৈনদের মাঝে শকাব্দ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। জৈনরা পরবর্তীতে যখন দক্ষিণ ভারতে গমন করে, সেখানেও তাদের সাহায্যে পুরো দক্ষিণ ভারতে শকাব্দের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় শতকে ক্যালেন্ডার প্রণয়নে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগন সৌরসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৪৯৯ খৃস্টাব্দে আর্যভট্ট, ষষ্ঠ শতকে বরাহমিত্র ও দ্বাদশ শতকে ভাস্কর প্রমূখজ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রচলিত হিন্দু ক্যালেন্ডারসমূহের বিভিন্ন সংস্কার সাধন করেন। চান্দ্র ও সৌর বছরের সমন্বয় করা সত্ত্বেও বিভিন্ন আঞ্চলিক ক্যালেন্ডারে কিছু কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

প্রাচীন বঙ্গের রাজা শশাঙ্কের শাসন কাল ছিল ৫৯০-৬২৫ খৃস্টাব্দ। এ সময় তিনি শকাব্দ অনুসরণে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন করেন। এ সময় তিনি চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসে নববর্ষ শুরু করেন এবং দিন ও মাসের নাম অপরিবর্তীত রাখেন। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, উড়িষ্যা, আসাম এবং বিহার পর্যন্ত তার বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১২ এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ সোমবার এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ হতে তার এ বিশাল সাম্রাজ্যে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়।

এভাবে শকাব্দ ও হিন্দু বৈদিক যুগের লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার অনুসরণে সৌরসিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে শশাঙ্কের রাজত্বকালে বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হওয়ায়, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে মধ্য এপ্রিল মাসে বাংলা বঙ্গাব্দ শুরু হয়, যা অনেক হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডার থেকে স্বতন্ত্র। মিথিলা, আসাম, বার্মা, কম্বোডিয়া, কেরালা, মণিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, শ্রীলংকা, তামিল নাড়- ও থাইল্যান্ডে বঙ্গাব্দের মতো একই সময়ে নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হয়।

তারিখ-ই-ইলাহি থেকে জানা যায়, মুঘল স্রমাট আকবর লক্ষ্য করেন যে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। অপরদিকে চান্দ্র বর্ষ অনুসারে প্রবর্তিত হিজরি সালের সঙ্গেও সেগুলো সামঞ্জস্যহীন। ফলে সঠিকরূপে দিন, তারিখ ও সময়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। বিশেষত চান্দ্র ও সৌর বর্ষের দ্বন্দ্বে খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তিনি একটি অভিন্ন, কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যার সাহায্যে তার সাম্রাজ্যের সর্বত্র সঠিকভাবে দিন, মাস ও বছর গণনা করা যায়। এ লক্ষ্যে তিনি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ সিরাজীকে এরূপ উপযোগী ক্যালেন্ডার প্রণয়নের জন্য নির্দেশ দেন।

চান্দ্রমাসের হিসেবে ৩১ বছর সমান ৩০ সৌরবছর। এর কারণ চান্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে অথচ সৌরবছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। এ বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যে ফতুল্লাহ সিরাজী শকাব্দ যা পরবর্তীকালে শশাংক কর্তৃক গৃহীত বঙ্গাব্দ বা বাংলা সৌর ক্যালেন্ডার অধিকতর নির্ভরযোগ্য হিসেবে নির্বাচন করেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে এক ফরমান বলে হিজরি সালের পরিবর্তে সম্রাট আকবর তাঁর সমগ্র সাম্রাজ্যে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন করেন। তিনি বাংলা সনের প্রচলিত মাসগুলোর নতুন নামকরণ করেন- কারওয়াদিন, আরদি, বিহিসু, খোরদাদ, তীর, আমরদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, দাই, বাহাম ও ইস্কান্দার মির্জা। তবে এ নামগুলো সমাদৃত হয়নি।

বাংলা নববর্ষ উদযাপনের রীতিও সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন। তিনি তাঁর রাজত্বকালে ১৪টি নতুন উৎসব উদযাপনের প্রচলন করেন। তার মধ্যে নওরোজ বা নববর্ষ উদযাপন অন্যতম। চৈত্র মাসের শেষ তারিখে খাজনা থেকে শুরু করে যত প্রকার ব্যক্তিগত বা সরকারি বকেয়া আছে তা পরিশোধ করার প্রথা প্রচলিত হয়। পরদিন নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ জমিদারগণ প্রজাদের ডেকে মিষ্টিমুখ করাতো। এ উপলক্ষে হালখাতা ও বৈশাখি মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান এ উৎসবে যুক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে এ উৎসব পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের আনন্দময় অনুষঙ্গরূপে প্রচলিত হয়।

বাংলাদেশ
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ‘লিপ ইয়ার’ বা অধিবর্ষের প্রচলন থাকলেও বাংলা ক্যালেন্ডারে তা ছিল না। ফলে সময়ের কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এজন্য বাংলা ক্যালেন্ডার সংশোধনের উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৬৬ তারিখে গৃহীত হয়। এ কমিটি নিম্নরূপ সুপারিশ প্রণয়ন করেঃ

* বৈশাখ থেকে ভাদ্র ৫ মাসের প্রতি মাস ৩১ দিনে হবে।

* আশ্বিন থেকে চৈত্র ৭ মাসের প্রতি মাস ৩০ দিনে হবে।

* গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষে ফালগুন মাস হবে ৩১ দিনে।

কমিটির এ সুপারিশ দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে  ১৯৮৭ খৃস্টাব্দে সুপারিশটি দাপ্তরিকভাবে গ্রহণের জন্য তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ আদেশ জারি করেন। এতে পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বঙ্গাব্দের সঙ্গে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অনেক আচার-অনুষ্ঠান চন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় সেখানে প্রচলিত বাংলা সন সংস্কারের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

বাংলাদেশে নববর্ষের উৎসব উদযাপিত হয় সংগীত, নৃত্য, লাঠিখেলা, বলিখেলা, হাডুডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। পয়লা বৈশাখ পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনের সূচনা করে। নতুন বছরের প্রথম দিবসে নতুন আশা ও আনন্দ, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।

বিভিন্ন ভোজ উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় আনন্দময় এ দিবস। ‘শুভ নববর্ষ’ বলে সকলে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। প্রতিটি বাঙালির জীবনে পয়লা বৈশাখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। শিশু-যুবক-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব, অজ্ঞ-বিজ্ঞ সকলের জন্যই এ দিনটি অনেক আনন্দ বয়ে আনে।

প্রথম দিকে নববর্ষের প্রধান কর্মসূচি ছিল ‘হালখাতা’ বা নতুন হিসাবের খাতা খোলা। আর তা ছিল সম্পূর্ণ আর্থিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ব্যবসায়ীগণ বকেয়া পাওনা আদায় করে হিসাবের পুরাতন খাতা বন্ধ করতো এবং নতুন বছরে নতুন হিসাবের খাতা খুলতো। এজন্য তারা গ্রাহকদের দাওয়াত করে মিষ্টি বিতরণ করতো। নতুন করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হতো। এর মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হতো।

হালখাতার এ রীতি অবশ্য এখনো অনেক জায়গায় বহাল আছে। নববর্ষের রেওয়াজে কিছু কিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসৃত হয়। এ দিনে ঘরবাড়ি, দোকান-পাট সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। সকলে খুব সকালে গোসল করে নতুন পোশাক পরে। তারপর তারা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাইরে বের হয়। অতিথিদের আপ্যায়ন করতে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়।

দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলার আয়োজন করা হয়। এ সমস্ত মেলায় যাবতীয় কৃষিপণ্য, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, খেলনা, প্রসাধনী দ্রব্য ও বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন বিক্রয় হয়। মেলায় চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থাও থাকে। কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও ছদ্মবেশী ভাঁড়গণ বিভিন্ন ধরনের নৃত্য, যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরাগান, গাজির গান, মাদারের গান ও আলকাপ গানে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ ছাড়া, তারা বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত বিশেষ করে বাউল, মারেফাতি, মুরশিদি ও ভাটিয়ালি গান গেয়ে থাকে। যাত্রাগান বিশেষত লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা ও রাধা-কৃষ্ণ মঞ্চস্থ করা হয়। পুতুল খেলা ও জাদুর খেলা বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকে।

নববর্ষ দিবসের অনেক ঐতিহ্যবাহী গ্রাম্য সংস্কৃতি অধুনা নগরায়নের করাল গ্রাসে বিলুপ্ত হয়েছে। অপরদিকে নতুন অনুষ্ঠানও যুক্ত হয়েছে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে খাজনা দেবার পূণ্যাহ অনুষ্ঠান বিদায় নিয়েছে। ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো, মুনশিগঞ্জে ষাঁড়ের লড়াই খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হতো। গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যে গ্রাম্য খেলাধুলা ছিল ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোড়গ লড়াই, কবুতর ওড়ানো, নৌকা বাইচ। কিছু কিছু অনুষ্ঠান এখনো কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায় যেমন চট্টগ্রামের বলি খেলা ও রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা গান।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খুব ভোরে সকলে একটা বড় গাছের নিচে অথবা লেকের পাড়ে সূর্যোদয় অবলোকন করে। শিল্পীগণ সংগীতের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। সর্বস্তরের বাঙালিরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। তরুণীরা লাল পাড়যুক্ত সাদা শাড়ি এবং বালা, ফুল ও টিপ পরে। পুরুষেরা সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে। শহরাঞ্চলের অনেক মানুষ সকালে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ ও ইলিশভাজাসহ পান্তাভাত খেয়ে থাকে।

বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় ঢাকায়। খুব ভোরে প্রচুর সংখ্যক মানুষ রমনার বটমূলে সমবেত হয়। সেখানে ছায়ানট শিল্পীগোষ্ঠী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সংগীত, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ এর মধ্য দিয়ে বৈশাখকে স্বাগত জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগেও অনুরূপভাবে নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করে। তারা সমগ্র ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। এ ছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে। রেডিও এবং টেলিভিশনে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা, মার্মা ও চাকমা জনগোষ্ঠী প্রায় অভিন্নভাবে পহেলা বৈশাখ উৎসব উদযাপন করে থাকে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈশাক, মার্মাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু অনুষ্ঠান বইসাবি নামে উদযাপিত হয়। তারা চৈত্র মাসের শেষ তারিখ অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল এ উৎসব পালন করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ দিবসকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতি বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।

বস্তুত, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চেতনার গন্ডি পেরিয়ে পয়লা বৈশাখ সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে।  বাংলা নববর্ষের এ উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন রচিত হয়েছে। এ দিবসে কোন প্রকার ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয় না। দিবসটি দেশের অন্যতম বৃহৎ উৎসব দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন।

ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার মতো এটা মুসলিমদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ নয়। ক্রিসমাসের উপহার বিনিময় করার মতো প্রথাও এ উৎসবে নেই। নেই দূর্গা পুজার মতো কেবলমাত্র হিন্দুদের অংশগ্রহণ। পয়লা বৈশাখের উৎসব উদযাপন অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাদামাঠা। প্রচুর কোন আর্থিক বিনিয়োগ নেই। কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। গ্রামের সাধারণ মানুষও স্বতস্ফূর্তভাবে এ উৎসব পালন করে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পয়লা বৈশাখ এমন কি পুরো বৈশাখ মাসকে বিবাহের জন্য শুভ সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সময় তারা নতুন পোশাক পরে ও নানারূপ সামাজিকতা পালন করে। পুরাতন বছরের শেষ মাস হচ্ছে চৈত্র। এ মাসে লোকজন বিপুল উত্তেজনা ও কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকে। চৈত্র মাসে পোশাক ব্যবসায়ীগণ দারুণ মূল্যহ্রাস ঘোষণা করেন। ফলে প্রচুর পোশাক বিক্রয় হয়।

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। পরিবারের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। মহিলারা লাল পাড়সহ সাদা শাড়ি ও পুরুষরা ধুতি বা পাজামাসহ পাঞ্জাবি পড়ে প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ করে। সকলে নববর্ষের প্রথম এ দিনটিকে এভাবে স্বাগত জানায়। দিনটি শুভ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় নতুন ব্যবসা শুরু বা কোনো নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

বাঙালিরা পয়লা বৈশাখে সব ধরনের ব্যবসায়িক কাজকর্ম শুরু করে। বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীরা  হালখাতা বা নতুন হিসাবের খাতা কিনে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের সাহায্যে মন্ত্রপাঠ ও পূজো-অর্চনা দিয়ে নতুন করে হিসাব শুরু করে। সে হিসাব খাতায় শস্তিক অংকন করা হয়। গভীর রাত থেকে কালীঘাটের মন্দিরের সামনে ভক্তদের দীর্ঘলাইন দেখা যায়। ভক্তগণ পূজো দিয়ে স্রষ্টার আশীর্বাদ গ্রহণ করে। পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়। নন্দনের রবীন্দ্র সদনে বাংলা সংগীত মেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ মেলা আয়োজন করে থাকে।

বার্মা
বার্মায় (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) তিন দিনব্যাপী নববর্ষের উৎসব উদযাপিত হয়। এ উৎসবের নাম মহা দিজ্ঞান। প্রার্থনা, উপবাস ও কৌতুকের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে তারা তাদের ঘরবাড়ি ও মঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। লোকজন একে অপরের গায়ে দিজ্ঞান জল ছিটিয়ে থাকে এবং বুদ্ধিভিত্তিক খেলাধুলা করে। এর মাধ্যমে তারা বর্ষা মওসুমের আগমন কামনা করে।

জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারে বার্মায় নববর্ষ নির্ধারিত হয়। ১৬ এপ্রিল বা এর নিকটবর্তী সময়ে সাধারণত নববর্ষ শুরু হয়। দিজ্ঞান অর্থ হচ্ছে পরিবর্তন। কুলা দিজ্ঞান বা ক্ষুদ্র পরিবর্তন প্রতিমাসে ঘটে। আর মহা দিজ্ঞান বা বৃহৎ পরিবর্তন বছরে একবার ঘটে। তারা মনে করে মিকথায় এ পরিবর্তন ১৩ এপ্রিল বা এর নিকটবর্তী সময়ে শুরু হয় এবং তিন চারদিন স্থায়ী থাকে। এ সময় তারা ভিজতে পছন্দ করে। দিজ্ঞান পানিতে ভিজে তারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়। তারা মনে করে যে পানি আত্মাকে পরিষ্কার করে।

থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডের নববর্ষকে বলা হয় সংক্রান। ১৩-১৫ এপ্রিল তিন দিন ধরে উদযাপিত হয় তাদের এ উৎসব। নববর্ষে বৃষ্টির আশায় তারা একে অপরের গায়ে জল ছিটিয়ে থাকে। বাড়ি, মঠ ও অন্যান্য স্থানে রক্ষিত সমস্ত বৌদ্ধমূর্তি ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারা মঠে গিয়ে প্রার্থনা করে এবং সন্ন্যাসীগণকে ভাত, ফলমূল, মিষ্টান্ন ও অন্যান্য খাবার প্রদান করে।

এ ছাড়া, সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় সকলে খাঁচা থেকে পাখিদের মুক্ত করে দেয় এবং পাত্রে করে তাজা মাছ নিয়ে নদীতে একসঙ্গে ছেড়ে দেয়। তারা স্কিটলজ জাতীয় ‘সাবা’ খেলার আয়োজন করে। বালতিতে পানি নিয়ে একে অপরের গায়ে ছিটানোর উদ্দেশ্যে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ির মাধ্যমে তাদের নববর্ষের উৎসব শুরু হয়।

এ দিবসে থাই জনগণ ‘কারামা-পালিশিং’ জাতীয় ভাল কাজও করে থাকে। নদীর ধারে গিয়ে তারা বালি দিয়ে বালির পিরামিড তৈরি করে। এ পিরামিডগুলোকে তারা ‘চেডিস’ বলে। এগুলোতে তারা রঙিন পতাকা ওড়ায়।

তিব্বত
তিব্বতের নববর্ষ ‘লোসার’ নামে পরিচিত। তিব্বতের জনসাধারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের নেতা দালাই লামা যখন মৃত্যুবরণ করে, পুনরায় শিশু হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কাজেই লামার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সদ্যজাত শিশুর অন্বেষণ করা হয়। এরূপ শিশুকে যত্মের সাথে শিক্ষা দেয়া হয় এবং বয়োপ্রাপ্ত হলে তাকে ধর্মীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়।

জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে নতুন চাঁদ দেখা গেলে নববর্ষের উৎসব শুরু হয়। পুরাতন বছরের শেষ দুদিনকে ‘গুতর’ বলা হয়। গুতরের প্রথম দিনে বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। রান্নাঘর পরিষ্কারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ঘরকে বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগাগোড়া চিমনি পরিষ্কার করা হয়।

নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। মাংস, গম, মিষ্টি আলু, পনির, সিম, কাঁচা মরিচ, সেমাই ও মূলা এই নয় রকম খাবার দিয়ে সুপ প্রস্তত করা হয়। এর সাথে কিছু ডাম্পলিং আলাদা পাত্রে রাখা থাকে। এতে কাঠ, কাগজ অথবা নুড়ি পাথরের গুঁড়া থাকে। এগুলো দেখে নতুন বছর কেমন কাটবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। কয়লাকে কালো মনের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।

গুতরের দ্বিতীয় দিবসে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়। তারা সকলে মঠে গিয়ে সন্ন্যাসীদের উপহার প্রদান করে। এ ছাড়া, তারা ফায়ারক্রেকার ও টর্চ জ্বালিয়ে থাকে যেন দুষ্টু প্রেতাত্মা বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে।

নববর্ষের দিনে সকলে খুব ভোরে উঠে গোসল করে এবং পোশাক পরে। তারপর তারা বাড়ির বেদীতে স্থাপিত দেবতাদের শ্রদ্ধা জানায় এবং পূজা উপচার প্রদান করে। এ সমস্ত উপচারের মধ্যে ‘টর্মা’ অন্যতম। পশুর মাংস দিয়ে এক প্রকার প্রস্তুতকৃত রুটি টর্মা হিসেবে পরিচিত। পারিবারিকভাবেও এ উৎসব উদযাপন করা হয়। সকলে মিলে উপহার বিনিময় ও খাওয়া-দাওয়া করে থাকে। এ খাবারকে তারা কাপসি বলে। খাবারের সময় মদ জাতীয় গরম পানীয় পরিবেশন করা হয়। এ পানীয়র নাম ‘চ্যাং’। লোসারের দ্বিতীয় দিবসে সকলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ করার জন্য বের হয়।

রাশিয়া
রাশিয়ার অধিকাংশ জনগণ তাদের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নববর্ষের উৎসব উদযাপন করে থাকে। ক্রিসমাস থেকে তাদের উৎসব উদযাপনের প্রথা প্রচলিত হয়। ক্রিসমাস ছিল প্রধান উৎসব। পরবর্তীতে কমুনিস্ট পার্টি ক্রিসমাসসহ সমস্ত ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু নববর্ষের উৎসব চলতে থাকে।

আনন্দের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন করে সকলে ক্রিসমাসের অভাব পূরণ করে। কিন্তু এ উৎসবে কোনো প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান যুক্ত হয় না। রাশিয়ায় নববর্ষ উদযাপন এখন জনপ্রিয় প্রথা হিসেবে প্রচলিত আছে। ১ জানুয়ারি অর্থাৎ নববর্ষের প্রথমদিনে পরিবারে যার প্রথম আগমন ঘটবে (বিশেষত প্রত্যাশিত কেউ), তার উপর তাদের সৌভাগ্য নির্ভর করে বলে তারা বিশ্বাস করে। পুরাতন বছরের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে তারা নববর্ষের উৎসব শুরু করে।

মধ্যরাতের দু-এক ঘণ্টা পূর্বে সাধারণত এ উৎসব শুরু হয়। সকলে তাদের ঐতিহ্য অনুসারে বিগত বার মাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ স্মরণ করে পুরাতন বছরকে বিদায় জানায়। রাত ১২টা বাজার ৫ মিনিট পূর্বে জনগণ তাদের উদ্দেশ্যে ক্রেমলিন হতে দেওয়া প্রেসিডেন্টের ভাষণ টেলিশনে শুনে থাকে।

টেলিভিশনে তারা জনপ্রিয় অন্যান্য অনুষ্ঠানও দেখে থাকে। রেডিও বা টেলিভিশনে রাত ১২টা বাজার ক্রেমলিন ঘণ্টার আওয়াজ শোনা তাদের অন্যতম ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এ ঘণ্টাধ্বনি পর পর ১২ বার বেজে থাকে। শেষ ১২ সেকেন্ড লোকজন নিশ্চুপ থেকে নববর্ষে মনে মনে নিজেদের কামনা ব্যক্ত করে থাকে।

রাত ১২টার ঘণ্টা বাজামাত্র সকলে শ্যামপেইন পান করে। সেই সঙ্গে থাকে উন্নতমানের খাবার। শুরু হয় টেলিভিশনে কনসার্ট দেখা আর মজা করা। কিছু লোকজন আতশবাজি করার জন্য বাইরে বের হয়। অনেকে বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

চিন
চিন দেশে ২১ জানুয়ারি হতে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ‘ইউয়ান তান’ অর্থাৎ নববর্ষ শুরু হয়। চাঁদ দেখে সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা হয়। প্রথম চাঁদ দেখার দিন হতে প্রতি চান্দ্র বছরের মাস শুরু হয়।

পরিবারের লোকজন এ সময় ভোজ উৎসব, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাতে ব্যস্ত থাকে। শহরাঞ্চলে বর্ণাঢ্য মিছিল বের করা হয়। নতুন বছরে যেন তারা সৌভাগ্য, সুস্বাস্থ, সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে সে লক্ষ্যে তারা এ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। উৎসবের প্রারম্ভে তারা বিগত বছরের দূর্ভাগ্য ঝেড়ে মুছে দূর করার জন্য বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে।

রাজপথে নববর্ষের প্যারেড আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার লোক নববর্ষের এ প্যারেড দেখার জন্য সমবেত হয়। ড্রাগন নৃত্য ও সিংহ নৃত্য রাজপথে সমবেত জনতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। ড্রাগনকে দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধির প্রতীকরূপে গণ্য করা হয়। ড্রাগনের রেশমি পোশাকের মধ্যে ৫০ জন নৃত্যশিল্পী থাকে। তারা ড্রাগনটির দীর্ঘ শরীর নৃত্যের তালে তালে আঁকাবাঁকা করতে, দিক পরিবর্তন করতে ও চোখ মিটি মিটি করতে সাহায্য করে।

চিনারা বিশ্বাস করে যে প্রেতাত্মারা উচ্চশব্দ পছন্দ করে না। তাই তারা প্লাস্টিক ফায়ার ক্রেকার দিয়ে ঘরবাড়ি সুসজ্জিত করে। উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করা হয় যেন দুষ্টু প্রেতাত্মা ও দুর্ভাগ্য ভীত হয়ে পালিয়ে যায় এবং ভাল আত্মা যেন আসতে পারে।

নববর্ষের সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে গণ্য ছোট ছোট উদ্ভিদ ও ফুল কেনার জন্য তারা বাজারে যায়। কুমকোয়াত গাছ সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। কারণ এর নামের অর্থও সৌভাগ্যবান। পিচ ব্লোজমকেও সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে গণ্য করা হয়্। টিস্যু পেপারে জড়িয়ে কচি ব্লোজম দিয়ে বাজার সাজানো হয়। ট্যাঙ্গারিনও উজ্জ্বল বর্ণের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে বিবেচিত হয়। কিন্তু বেজোড় সংখ্যা হলে তা দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে। সুতরাং ট্যাঙ্গারিন সব সময় জোড়ায় জোড়ায় বিনিময় করা হয়।

হংকং এর লোকজন প্রকৃত ফায়ারক্রেকার ঘরবাড়িতে ব্যবহার করে না। তারাও প্লাস্টিক ফায়ারক্রেকার সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। তবে পোশাকসহ যাবতীয় সাজসজ্জার উপকরণের রং লাল হতে হবে। লাল রঙকে তারা সুখ ও আনন্দের প্রতীক মনে করে।

পরিবারের নামে লাল খামে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে কিছু টাকা ও স্বর্ণাক্ষরে সৌভাগ্য বার্তা প্রেরণ করা হয়। তবে এগুলো কেবল আত্মীয়-স্বজনদের শিশু ও অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের জন্য দেওয়া হয়। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা বেশ বড় ধরনের ভোজ উৎসবের আয়োজন করে।

চিন দেশের লোকজন নববর্ষ উপলক্ষে ধর্মীয় রীতি অনুসারে পূর্বপুরুষগণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে। তারপর তারা দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে। পরিবারের তরুণ সদস্যরা আত্মীয়স্বজনদের জন্য প্রার্থনা জানায়।

কম্বোডিয়া
কম্বোডিয়ার জনসাধারণ ভারতীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষ শুরুর তারিখ নির্ধারণ করে। উৎসব শুরু হয় ১২, ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল এবং তিনদিন স্থায়ী হয়। নববর্ষের সন্ধ্যাকে ‘ছাউল ছনম মে’ বা নববর্ষে পদার্পণ বলা হয়।

ঘরবাড়ি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে নববর্ষের দেবতা ‘তেবাড়া ছনম মে’ কে স্বাগতম জানানোর জন্য বেদী স্থাপন করা হয়। তারা বিশ্বাস করে যে এ সময় নববর্ষের দেবতা মর্তে নেমে আসে। বেদীতে বুদ্ধের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি, সুগন্ধি জল, খাবার, পানীয়, বিভিন্ন আকৃতির কলার পাতা দিয়ে বেদী সাজানো হয়।

আশীর্বাদ হিসেবে একে অপরের দিকে জল ছিটিয়ে থাকে। লাল, গোলাপী অথবা হলুদ রঙের জল রঙিন বা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্দেশ করে। সকলে নতুন পোশাক পরে। শিশুরা তাদের পিতামাতাসহ অন্যান্য মুরুব্বিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্থ দিয়ে থাকে। তারা অর্থের সঙ্গে খাবার বা ফলমূলও দিয়ে থাকে।

উৎসবের প্রথম দিবসে লোকজন স্থানীয় মঠে গিয়ে সন্যাসীদের নানা ধরনের উৎকৃষ্ট খাবার প্রদান করে। মঠের আঙ্গিনায় তারা বালি দিয়ে একটি স্তুপ তৈরি করে। স্তুপটি ধর্মীয় পাঁচটি পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত করে। চারটি পতাকা থাকে চার কোণায় আর একটি থাকে স্তুপের শীর্ষে। এ ছাড়া, টাগ অব ওয়ার, আঁখুন ও বো চুং জাতীয় বিশেষ ধরনের খেলার আয়োজন করে।

দ্বিতীয় দিবসে তাদের পরিবারসহ সকলের সাথে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময় করে। তারা এ দিবসে মঠেও গিয়ে থাকে। সেখানে তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীদের বিশেষ প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ জানায়।

তৃতীয় দিবসে তাদের বাড়ি ও মঠে স্থাপিত বৌদ্ধমূর্তি ধুয়ে পরিষ্কার করে। এতে তারা মনে করে, নতুন বছরে প্রচুর বৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এ দিবসের সম্মানে ছেলে-মেয়েরা সশ্রদ্ধ চিত্তে তাদের পিতামাতার পা ধুয়ে দেয়।

সকলে নতুন পোশাক পড়ে বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের ‘কুং-সাই ফা-সাই’ অর্থাৎ অভিনন্দন জানায় ও সমৃদ্ধি কামনা করে। এ বর্ষবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা পুরাতন হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যায় এবং আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে উজ্জীবীত হয়।

উৎসবের দ্বিতীয় দিবসে বিবাহিত মেয়েরা তাদের পিত্রালয়ে গমন করে। যদি সম্প্রতি বিবাহ হয়ে থাকে, তাহলে স্বামীকে অবশ্যই সঙ্গে যেতে হবে। তারা এ সময় পরিবারের জন্য উপহার নিয়ে আসে।

তৃতীয় দিবসের রাতে ইঁদুরের দল তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকে। এ বিশ্বাসে সেদিন চিনা জনগণ তাড়াতাড়ি বিছানায় যায় যেন ইঁদুরদের কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।

চতুর্থ দিবসে চিনাদের উচ্ছ্বাস কিছুটা কমে আসে। বিকেলে খাবার প্রস্তুত করে রন্ধন দেবতার প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে। এ দেবতার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের আত্মিক সাধনার মুক্তি ঘটে। বলা হয়, দেবতাদের খুব আগে প্রেরণ করতে নেই, আবার খুব দেরি করেও আমন্ত্রণ করতে নেই।

পঞ্চম দিবসে চিনাদের নববর্ষের উৎসব সমাপ্ত হয়। বেদীমূল হতে সমস্ত পূজোর উপকরণ ও উপহারসামগ্রী সরিয়ে ফেলা হয়। চিনা জনগণ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের নববর্ষ ‘টেট’ নামে পরিচিত। এর দাপ্তরিক নাম ‘নুয়েন-ডান’। কৃষিবর্ষের অন্তবর্তী কালে অত্যন্ত গুরুত্বসহ টেট উৎসব উদযাপিত হয়। সাধারণত পুরাতন ফসল ঘরে তোলার পর নতুন ফসল বপনের মধ্যবর্তী সময়ে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িঘর, তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং যাবতীয় ঋণ বা বকেয়া দেনা পরিশোধ করে ভিয়েতনামের লোকজন নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতিগ্রহণ করে।

সকলে বিশ্বাস করে যে রান্নাঘরের তিন পা বিশিষ্ট উপকরণ তিন দেবতার প্রতীক। বাড়ির গৃহিনী হচ্ছে মধ্য দেবতা। অন্য দুজনের প্রতিভূ তার স্বামী। তাজা কাতলা মাছ উপহার দেওয়া হয়। প্রাণীকূলের মধ্যে কাতলা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রাণী যাদের একটি প্রজাতি পরবর্তীতে ড্রাগনে রূপান্তরিত হয়। তারা বাজার থেকে তাজা কাতলা ক্রয় করে বাড়ি নিয়ে আসে। তারপর তারা মাছটিকে পানিভর্তি বালতিতে রাখে। বালতিটি বেদীর নিকট রেখে পূজো শেষে মাছটি নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। রান্নাঘরের দেবতা ‘টাও’ এর সম্মানে এ পূজা-অর্চনা তারা নববর্ষের এক সপ্তাহ পূর্বেই সম্পন্ন করে।

নববর্ষ উপলক্ষে চাউলের পুডিং খাওয়া হয়। এ পুডিং পূর্বেই প্রস্তুত করে রাখা হয়। এ পুডিংকে তারা ‘ব্যান চুং’ বা ‘ব্যান টেট’ বলে। মুং জাতীয় সিম ও শূকরের মাংস মিশিয়ে এ বিশেষ পুডিং পরিবেশন করা হয়। মিষ্টান্ন, গরুর মাংস, মুরগী, মাছ, কমলা, নারিকেল, আঙ্গুর ও ঋতুকালীন অন্যান্য ফলমূল বিশেষত তরমুজ নববর্ষের খাবার হিসেবে ভিয়েতনামে জনপ্রিয়। ভিতরের অংশ লাল রঙের কারণে তরমুজকে সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে গণ্য করা হয়। তারা এ জন্য তরমুজ কেনার সময় সতর্ক থাকে যেন তরমুজের ভিতরের অংশ উজ্জ্বল লাল বর্ণের হয়। তরমুজের বীজগুলোও লাল বর্ণে রঞ্জিত করে এর চূর্ণ পরিবেশন করা হয়।

পুরাতন বছরের শেষ দিনে বাড়ির আঙ্গিনায় বাঁশ গাছ রোপন করা হয়। তার এ গাছটি ঘণ্টা,  ফুল ও লাল কাগজ দিয়ে সাজায়। বাড়ির আঙ্গিনায় রোপিত বাঁশ গাছ এভাবে সাজানোর কারণ হচ্ছে পরিবারের লোকজন যেন প্রেতাত্মাদের কবলে না পড়ে।

পূর্বপুরুষদের মঙ্গল কামনায় মধ্যাহ্নে পারিবারিক পূজোর বেদীমূলে পূজো-উপচার প্রদান করে থাকে। সেখানে নানা প্রকার সুগন্ধী আগরবাতি জ্বালানো হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় নববর্ষ উপলক্ষে প্রথম পদার্পণকারী নতুন বছরে পরিবারের জন্য সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলে তারা বিশ্বাস করে।

নববর্ষের প্রথম দিবসে তারা তাদের নিকট বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক ও পিতা-মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে থাকে। দ্বিতীয় দিবসে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তৃতীয় দিবসে শিক্ষকদের পরিবার ও দূরবর্তী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। চতুর্থ দিবসে মর্তে আগমনকৃত আত্মাসমূহ স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করে এবং সমস্ত কাজ-কর্ম স্বাভাবিক হয়ে আসে।

ইরান
ইরান মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। তারা বসন্তের প্রথম দিবসে নববর্ষের উৎসব উদযাপন করে। এ উৎসব নওরোজ নামে পরিচিত। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ২১ মার্চ নওরোজ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম মাসের নাম ফাবারদিন।

প্রতিটি শহর ও গ্রামে কামান ছুঁড়ে নওরোজ ঘোষণা করা হয়। এ কামানের আওয়াজ না শোনা পর্যন্ত তারা নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু করে না। অবশ্য কয়েক সপ্তাহ পূর্ব থেকেই তারা অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তারা প্রথমে গম, যব ও মসুর দিয়ে ঘরবাড়ি সজ্জিত করে। এগুলোকে তারা বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির প্রতীক মনে করে। ১৩ দিন সেগুলো বাড়িতে রাখার পর নদীতে নিক্ষেপ করে আসে।

নববর্ষ উপলক্ষে তারা ঘরবাড়ি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে। পরিবারের সকলের জন্য তারা নতুন পোশাক তৈরি অথবা ক্রয় করে। পরিবারের সকলের জন্য পোশাক তৈরি বা ক্রয়ের সামর্থ না থাকলে তারা অন্তত একজনের জন্য নতুন পোশাক ও জুতা ক্রয়ের চেষ্টা করে।

এ উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত ভোজের টেবিলে ‘সিন’ সাউন্ডযুক্ত ‘হপ্ত সিন’ অর্থাৎ নিম্নবর্ণিত সাতটি খাবার অবশ্যই পরিবেশন করা হয়- সনবুল-কচুরিপানা জাতীয় উদ্ভিদ, সবজি-ফসলের ডগা বা শাক, সামানু-সবুজ গমের তৈরি মিষ্টি পুডিং, সিরকা-ভিনেগার, সুমাক-এক প্রকার গুল্ম, সেব-আপেল, সিনজিদ-বোহেমিয় জলপাই।

এ ছাড়া এক বাটি রঙিন ডিম, কিছু মোমবাতি, একটি আয়না ও এক বাটি গোলাপজল দিয়ে টেবিল সাজানো হয়। এ টেবিলে পবিত্র কোরান শরীফ অবশ্যই রাখা হয়।

কামানের আওয়াজ শুনে লোকজন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ঈদি বা খুশি হিসেবে বড়রা ছোটদের রৌপ্য বা স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে থাকে। তারপর তারা সকলে পরিবারের খাবার টেবিলে বিশেষ ভোজন সম্পন্ন করে। এ খাদ্য তালিকায় ঐতিহ্য হিসেবে বকলাভা, নান শিকারি বা চিনির তৈরি বিস্কুট ও বাদাম চোরাগি বা বাদামের তৈরি বিসকিটও রাখা হয়।

সকলে নববর্ষের উপহার হিসেবে ডিম বিনিময় করে থাকে। ডিমকে তারা নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে মনে করে। নববর্ষের উৎসব শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পূর্বে গম, যব ও মসুর বিভিন্ন পাত্রে ভিজিয়ে রাখে যেন সেগুলো অঙ্কুরিত হতে পারে এবং নববর্ষের সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারা গজাতে পারে। এতে তারা বুঝতে পারে যে বসন্তের আগমন ঘটেছে এবং জীবনের নববর্ষ শুরু হয়েছে।

ইরানের কিছু লোক নববর্ষ উপলক্ষে আগুন জ্বেলে সেই আগুনের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়। এ কাজের মধ্য দিয়ে তারা সৌভাগ্যের অন্বেষণ করে।

মিশর
প্রাচীন মিশরে নববর্ষের উৎসব হতো বছরের প্রথম মাসে। এ সময় উৎসবের জন্য উপযুক্ত ছিল। নীল নদ কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকতো। লোকজনের কাজকর্ম থাকতো না। সুতরাং উৎসব পালনের জন্য ছিল অখ-অবসর। তাদের প্রধান দেবতা আমন প্রতি বছর মন্দির ছেড়ে তখন নীলনদের কর্ণক থেকে লাক্সর পর্যন্ত ২৪ দিন ভ্রমণ করতো। ভ্রমণ শেষে পুনরায় সে মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করতো। তার এ ভ্রমণের প্রতি সম্মান জানিয়ে এ সময় নববর্ষের উৎসব পালন করা হতো।

পরবর্তীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাধান্য লাভ করায় চান্দ্র বর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিবসে নববর্ষের উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। সরকারি ছুটি হিসেবে দিবসটি ঘোষণা করা হয়েছে। চাঁদ দেখার খবরও সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। কায়রো নগরীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত মোহাম্মদ আলী মসজিদ হতে চাঁদ দেখার আয়োজন করা হয়। সেখানে চাঁদ দেখা গেলে খবরটি প্রধান মুফতির নিকট প্রেরণ করা হয়। তিনি তখন নববর্ষ শুরুর ঘোষণা প্রদান করেন।

যে সকল লোকজন মসজিদের বাইরে এ ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করে, তারা তা শোনামাত্র একে অপরকে ‘কোল সানা উই ইনতা তায়েব’ বলে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। তারপর তারা বাড়ি ফিরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। নববর্ষ উপলক্ষে  বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে এ বিশেষ ভোজে অংশগ্রহণ করে থাকে। এদিন গরিব লোকজনও মাংস ভোজন করে থাকে। কিন্তু কোনো প্রকার মদ পরিবেশন করা হয় না। কারণ মুসলিমরা মদ পান করে না।

নববর্ষের উৎসব উপলক্ষে প্রত্যেকে বিশেষ পোশাক পরে। মেয়েদের উজ্জ্বল বর্ণের পোশাক পরার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। অন্য সময় তারা সাধারণত কালো পোশাক পরে থাকে। শিশুদের জন্য মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। ঘোড়ার পিঠে সমাসীন বালকের আকৃতি বিশিষ্ট মিষ্টি-ছেলেরা খেয়ে থাকে। মেয়েরা খেয়ে থাকে রঙিন কাগজে মোড়ানো অ্যাকর্ডিয়ান আকৃতির মিষ্টি।

প্রাপ্তবয়স্করা এদিনে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষ্যাৎ করে। কিছু কিছু এলাকায় পিতা বা পরিবারের কর্তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। আর এভাবে তারা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে করতে মেয়রের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

গ্রিস
গ্রিসে ১ জানুয়ারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত নববর্ষের প্রথম দিন। দ্বিতীয়ত সেইন্ট বাসিল দিবস। সেইন্ট বাসিল ছিলেন প্রাচীন গ্রীক পুরোহিতগণের অন্যতম পূর্বপুরুষ। গরিবদের প্রতি তাঁর দয়া ও অকৃপণ দানশীলতার জন্য তাঁকে স্মরণ করা হয়। এ দিবসেই তাঁর মহাপ্রয়ান ঘটে। এ জন্য গ্রীকগণ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

উপহার আদান-প্রদান ও শিশুদের প্রতি দয়াশীলতার বিষয়ে সেইন্ট বাসিলের জনশ্রুতির কারণে ক্রিসমাসের চেয়েও বেশি উৎসবমুখর এ নববর্ষ দিবস। বলা হয়, তিনি গভীর রাতে কীভাবে এসে শিশুদের জুতোর ভিতর উপহার রেখে যেতেন। গ্রীকরা তা স্মরণ করে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে উপহার বিনিময় করে থাকে। সেই সঙ্গে তারা বড় রকমের ভোজ উৎসবের আয়োজন করে। নানা ধরনের প্রিয় খাবার, পানীয় ও সংগীতের ব্যবস্থা করা হয়। বাসিলো পিঠা বা সেইন্ট বাসিল’স কেইক পরিবেশিত হয় বিশেষ খাবার হিসেবে। এ কেইকের মাঝখানে থাকে রৌপ্য অথবা স্বর্ণমুদ্রা।

কঠোর নিয়ম মেনে এ কেইক পরিবেশন করা হয়। প্রথম টুকরা থাকে সেইন্ট বাসিলের জন্য, দ্বিতীয় টুকরা বাড়ির জন্য, তারপর বাড়ির মুরুব্বী থেকে শিশু পর্যন্ত সকলকে ধারাবাহিক ভাবে কেইক পরিবেশন করা হয়। পরিবারের অনুপস্থিত সদস্যের জন্যও কেইক রাখা হয়। গৃহপালিত প্রাণী ও গরিবদের জন্যও কেইক বিতরণ করা হয়। যে তার টুকরার ভিতর মুদ্রাটি পাবে সেই নতুন বছরের ভাগ্যবান ব্যক্তি হিসেবে ধন্য হবে।

সেইন্ট বাসিল’স কেইক ছাড়াও টেবিলে কুরাবিডজ অর্থাৎ ছোট ছোট রুটি ও থিপল্জ নামের এক প্রকার খাবারসহ প্রচুর খাবার পরিবেশন করা হয়। মধু তো থাকবেই। সেই সঙ্গে অলিভ সব্জি, বাদাম, টাটকা ফলমূল ও সুখ-সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন প্রকার খাবার থাকে।

নববর্ষের সন্ধ্যায় শিশুরা ক্যারল গায়। দিনের বেলায়ও তারা এ সংগীত গেয়ে থাকে। প্রথম যে ব্যক্তি আঙ্গিনায় পা রাখবে, মনে করা হয় সারা বছর সে এ পরিবারের জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবে। পিতা, পুত্র অথবা কোন শিশু সাধারণত বাড়ির আঙ্গিনা প্রথম অতিক্রম করে।

আবার অনেক গ্রীক এখনো ১ সেপ্টেম্বর নববর্ষ হিসেবে পালন করে। কারণ, গ্রিসে তখন বীজ বপনের সময়, যে সময়কে আশা ও প্রতিশ্রুতির সময় হিসেবে তারা গণ্য করে। যথা সময়ে এ নববর্ষ শুরু করার জন্য কৃষকরা থালাভর্তি বীজ নিয়ে চার্চের পুরোহিতের আশীর্বাদ গ্রহণ করে।

কস অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ডালিম, আঙ্গুর, রসুন ও অন্যান্য গাছপালার ফুল বা পাতা দিয়ে মালা গেঁথে পরে। ১ সেপ্টেম্বর বাড়ির শিশুরা পুরাতন বছরের মালাগুলো সাগর জলে ভাসিয়ে দেয় আর নতুন মালা নতুন বছরের সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে নিয়ে আসে। তারা কলস ভর্তি করে সাগরের জলও নিয়ে আসে। নববর্ষের মালা, সাগরের ৪০টি নুড়ি পাথর ও ৪০টি ঢেউয়ের মাথার জল রক্ষাকবচ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।

রোডজ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীও কাঠবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, আঙ্গুর, তুলার পেঁজা ও ছোট ছোট কাপড়ের ব্যাগ ভর্তি বিভিন্ন শষ্য দিয়ে মালা গাঁথে। তাদের বিশ্বাস, এ ধরনের মালা পরলেই কেবল ভালভাবে বীজ বপনের সময় শুরু হয় ও ভাল ফলন আশা করা যায়।

ইটালি
রোমান ইতিহাসের প্রথম দিকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে মার্চ মাসে নববর্ষের উৎসব উদযাপিত হতো। এ উৎসবকে তার ক্যালেন্ডস উৎসব বলতো। সে সময় তারা গাছের ডাল দিয়ে একে অপরকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতো। বস্তুত তখন থেকেই তাদের মধ্যে উপহার বিনিময়ের ঐতিহ্যের সূত্রপাত ঘটে।

পরবর্তী সময়ে রোমানরা জানুয়ারি মাসে নববর্ষ উদযাপন শুরু করে। একে জানুস উৎসবও বলা হতো। জানুস তাদের দেবতার নাম। সিংহদ্বার, দরজা, শুরু বা ভাল কিছু শুরুর দেবতা হিসেবে জানুস তাদের পূজ্য ছিল। তার দুটি মুখ ছিল। একটি সামনে, অপরটি পিছনে। ধীরে ধীরে নববর্ষ উপলক্ষে সোনার তৈরি বাদাম বা মুদ্রা উপহার দেওয়ার রেওয়াজ গড়ে ওঠে। এ সমস্ত বাদাম বা মুদ্রার পিঠে জানুস দেবতার প্রতিকৃতি অঙ্কিত থাকতো।

নববর্ষ উপললক্ষে রোমানরা তিন দিন ছুটি ভোগ করে। নববর্ষকে স্বাগতম জানাতে তারা সবুজ গাছপালা, সবুজ রং ও নানারকম বিলাসবহুল ঝলমলে আলোয় তাদের বাড়িঘর সুসজ্জিত করে। বাড়িতে বিশাল ভোজ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে আন্তরিকভাবে নিমন্ত্রণ করা হয়। তাদের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। তারা একত্রে পান-ভোজন ও নাচ-গানের মাধ্যমে আনন্দ-উল্লাস করে থাকে। সেই সঙ্গে মহাসমারোহে পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে।

নববর্ষের উপহার নির্বাচনে রোমানরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সাধারণত সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে গণ্য দ্রব্যসামগ্রী উপহার হিসেবে আদান প্রদান করা হয়। মিষ্টি ও মধু ভবিষ্যৎ ভালোবাসা ও শান্তির প্রতীক। সোনা বা রূপা ভবিষ্যৎ সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক। বাতি ও আলো ভবিষ্যৎ আলো ও আশার প্রতীক। ডিম ভবিষ্যৎ ফলপ্রসূ হওয়ার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।

জনগণ সমবেত হয়ে সম্রাটের প্রাসাদে গিয়ে বিভিন্ন উপঢৌকন প্রদান করে ও নতুন বছরে সম্রাটের  সৌভাগ্য কামনা করে। অবশ্য সবাই এতে অংশগ্রহণ করে না। এ ছাড়া, বাড়ির আঙ্গিনায় প্রথম পদার্পণকারী তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে বলে তারা বিশ্বাস করে। তবে সে যদি লম্বা ও কালো চুলের অধিকারী তরুণ হয়, তাহলে সৌভাগ্য বয়ে আনবে। অপরদিকে কোন মহিলা বা লাল চুল বিশিষ্ট কোন ব্যক্তি যদি আসে, তাহলে সে নতুন বছরে তাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে।

যুক্তরাজ্য
স্কটল্যান্ডে নববর্ষকে বলা হয় ‘হগ মানেই’। সন্ধ্যায় পান-ভোজন ও আনন্দের মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে তা উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়। এডিনবার্গে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। গ্লাসগৌতে হাত ধরে ‘ওড ল্যাং সাইন’ সংগীত গেয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।

সমগ্র যুক্তরাজ্যে নববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে বাড়িতে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে অথবা স্থানীয় ক্লাবে পার্টির আয়োজন করা হয়। উৎসব শুরু হয় সন্ধ্যায়। মধ্য রাতের ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ উল্লাস ও পান-ভোজনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

নববর্ষের দিনে প্রথম যে ব্যক্তি বাড়ির আঙ্গিনায় পদার্পণ করবে সে নতুন বছরের সৌভাগ্য বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করা হয়। একে বলা হয় প্রথম পদার্পণ। ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বিশেষত স্কটল্যান্ড ও নর্দান আয়ারল্যান্ডে প্রথম পদার্পণকারীকে সৌভাগ্যের বার্তাবাহকরূপে গণ্য করা হয়। এরূপ ব্যক্তি সাধারণত একটুকরা কয়লা, একটুকরা রুটি ও এক বোতল হুইস্কি নিয়ে আসে। বাড়িতে প্রবেশ করেই সে চুল্লিতে কয়লার টুকরাটি নিক্ষেপ করে, খাবার টেবিলে রুটি ও হুইস্কি রাখে। তারপর সে এক গ্লাস হুইস্কি বাড়ির কর্তাকে পরিবেশন করে। এ কাজগুলো বিনা বাক্য ব্যয়ে করা হয়। তারপর সে সকলকে ‘আ গিড নিউ ইয়ার টে এ্যান এ্যান’ ওয়াউ’ বলে নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে। তাকে বাড়ির সম্মুখ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এবং পেছন দরজা দিয়ে বের হতে হয়।

মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজলে বাড়ির পেছন দরজা খুলে দেওয়া হয় যেন পুরাতন বছর বিদায় নিতে পারে। তারপর দরজাটি তালাবদ্ধ করা হয় যেন সৌভাগ্য বাড়িতে বন্দি থাকে এবং নতুন বছরের শেষ ঘণ্টা বাজলে বাড়ির সম্মুখ দরজা খুলে দেওয়া হয়।

বিশ্বের মধ্যে নববর্ষের সর্ববৃহৎ প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে। আমেরিকান স্টাইলে এ প্যারেডে প্রায় ১০০০০ গায়ক, বাদক, নৃত্যশিল্পী, শারীরিক কসরৎ প্রদর্শনকারী, চটুল ভাঁড় ও রসিক ব্যক্তি দর্শকদের আনন্দ বর্ধন করে থাকে। পার্লামেন্ট স্কয়ার থেকে দুপুর বেলায় বিগ বেনের মতো প্রচণ্ড  আওয়াজের মধ্য দিয়ে ড্রাম বাজিয়ে যাত্রা শুরু করে। ওয়াইটহল, পল মল, লোয়ার রিজেন্ট স্ট্রিট তারপর পিকাডিলি হয়ে বার্কলে স্কয়ারে গিয়ে ২ টা ৪৫ মিনিটে এ প্যারেড শেষ হয়।

ফ্রান্স
ফ্রান্সে নববর্ষ উদযাপিত হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১ জানুয়ারি। এ দিবসকে বলা হয় ‘জুর ডিস ইট্রেনিস’। এ দিবসের অনুষ্ঠানকে তারা বলে ‘রিভিলিয়ন’। ফ্রান্সের প্রাচীনতম এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এ দিনে সরকারি ছুটি থাকে।

বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে মিলেমিশে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে সকলে নববর্ষ উদযাপন করে। পুরাতন বছরকে মধুরভাবে বিদায় এবং জাঁকজমকের সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। নতুন বছরের নতুন আশা হচ্ছে সাফল্য, সমৃদ্ধি, সুখ ও শান্তি তাদের জীবনকে ভরিয়ে তুলবে।

সন্ধ্যায় নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে। ফ্রান্সে নববর্ষের সন্ধ্যাকে ‘লা সেইন্ট-সিলভেস্টার’ বলা হয়।

নববর্ষের সন্ধ্যায় তাদের ঐতিহ্য অনুসারে বিশেষ কেইক কাটা হয়। এ কেইকের নাম ‘গালেটি’। ‘লি রিভিলিয়ন ডি সেইন্ট-সিলভেস্টার’ উপলক্ষে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। হাঁস জাতীয় মাংসের প্যানকেইকস ও এক ধরনের সবজি ফই গ্রাস পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া, অতিথিদের শ্যামপেইন পরিবেশন করা হয়। বিশেষ ভোজের এ আয়োজন তাদের সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য বয়ে আনে বলে তারা মনে করে।

ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে নববর্ষের সন্ধ্যায় আনন্দ প্যারেডে বের করা হয়। দলে দলে লোকজন এ প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। নেচে গেয়ে এ প্যারেড মাতিয়ে রাখা হয়।

ডেনমার্ক
ডেনমার্কে যদি নববর্ষ দিবসে কারো বাড়ির দরজার পাশে ভাঙ্গা বাসনপত্রের স্তুপ দেখা যায়, তাহলে বুঝতে এটা শুভ সংকেত। সারা বছর তারা ভাঙ্গা তৈজসপত্র জমিয়ে রাখে আর নববর্ষের সন্ধ্যায় সেগুলো প্রধান দরজার পাশে স্তুপীকৃত করে। যত বেশি ভাঙ্গা তৈজসপত্র দেখা যাবে, মনে করতে হবে এ বাড়ির লোকজনের অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে।

নববর্ষের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি থাকে। একটি হচ্ছে সন্ধ্যা ৬টায় নববর্ষ উপলক্ষে সম্রাটের দেওয়া ভাষণ। অপরটি হচ্ছে কোপেনহেগেনের টাউন হলে মধ্য রাতে ঘণ্টা বাজানো। এ ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষ শুরু হয়। এ দুটি কর্মসূচি টেলিভিশন ও রেডিওতে গুরুত্বসহ প্রচার করা হয়।

মধ্যরাতে ডেনমার্কের পার্টিগুলোতে নানা ধরনের খাবারসহ শ্যাম্পেইন ও মারজিপান রিং কেইক পরিবেশন করা হয়। আতশবাজির মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এ ছাড়া প্রচুর শব্দ সৃষ্টি করা হয় এবং রকেটও ছোঁড়া হয়। এতে নানা বর্ণে আকাশ রঞ্জিত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঐতিহ্য অনুসারে সিদ্ধ কড মাছ অথবা দীর্ঘক্ষণ ধরে সিদ্ধ করা বাঁধা কপি ও শূকরের মাংস নববর্ষের ভোজ উসবে পরিবেশন করা হয়।

অস্ট্রিয়া
পোপ ইনৌসেন্ট দ্বাদশ ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ায় ১ জানুয়ারি নববর্ষ শুরুর ঘোষণা দেন। সেইন্ট সিলবেস্টার এর নাম অনুসারে নববর্ষের প্রথম দিবসের সন্ধ্যাকে সিলবেসটেরাবেন্ড বলা হয়। তার সম্মানে তারা দারুচিনি, চিনি ও লাল রঙের মদ দিয়ে পাঞ্জা তৈরি করে।

চিরসবুজ মালা দিয়ে হোটেল ও সরাইখানা সাজিয়ে রাখা হয়। কনফেটি, স্ট্রিমার ও শ্যাম্পেইন জাতীয় খাবার ও পানীয় এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। বোলার অর্থাৎ মর্টার ছুঁড়ে পুরাতন বছরের প্রেতাত্মাদের তাড়ানো হয়। মধ্যরাতে লোকজন গির্জার চূড়া হতে ঢোল বাজিয়ে থাকে। তারপর তারা চুম্বন বিনিময় করে।

বড় বড় শহরে আতশবাজি করা হয়। ভিয়েনায় স্টাউস অপারেটা ডি ফেডারমস দিনের বেলা অনুষ্টিত হয়। রাতের বেলা অনুষ্ঠিত হয় ভিয়েনা স্টেইট অপেরা ও অন্যান্য স্ট্রাউস কনসার্ট। ভিয়েনা ফিলারমনিক কনসার্টের আয়োজন করে থাকে।

নববর্ষ উপলক্ষে অস্ট্রিয়ায় ডিনারের ব্যাপক আয়োজন করা হয়। এদিনে তারা শূকরশাবক ভক্ষণ করে থাকে। শূকর তাদের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। প্রায়ই তাদের টেবিলে শূকরের মাংসে তৈরি মারিজাপান, ম্যাপল চিনি, ফাজ, কুকি ডাফ অথবা চকলেট এর সমাহার ঘটে। চার পাতাযুক্ত ক্লোভার আরো একটি শুভ প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শূকরের রোস্টের সঙ্গে সবুজ পিপারমেন্ট আইসক্রিম চার পাতাযুক্ত কোভারের আকৃতিতে পরিবেশন করা হয়। এ উৎসব উপলক্ষে  অস্ট্রিয়ানরা বল ডান্স ও নানারকম পার্টির আয়োজন করে। নববর্ষের সন্ধ্যার নাম ফাসিং। সকলে মিলে ভোরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যারল গায়। তারা সীসা গলিয়ে পানিভর্তি বালতিতে ফেলে। তারপর সীসার আকৃতি দেখে জ্যোতিষীরা ভবিষ্যৎ গণনা করেন। এ দিবসে কোন বৃদ্ধাকে দর্শন অশুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়।

ভোজ উৎসবের প্রিয় খাবাব শূকর ও কাতলা মাছ। এগুলো সৌভাগ্যের প্রতীক। এ দিবসে তারা এগুলো খেয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। চকলেট ও মারজিপান দিয়ে শূকর, স্বর্ণমূদ্রা, চিমনিঝাড়–, চারপাতাযুক্ত ক্লোভার ও ঘোড়ার ক্ষুরের আকৃতি দান করে।

ব্রাজিল
ব্রাজিলের লোকজন বিশ্বাস করে মসুরের ডাল তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। তাই নববর্ষ শুরুর দিনে ভোজ উৎসবে তারা মসূর ডালের সুপ ও ভাত পরিবেশন করে। নববর্ষের সন্ধ্যায় স্থানীয় মাকাম্বা ভুডু সম্প্রদায়ের মহিলা পুরোহিতগণ জলদেবী ইয়েমাঞ্জার সম্মানে নীল স্কার্ট ও সাদা ব্লাউজ পরে। রিও ডি জেনারিওর বিখ্যাত ইপেনামা সাগর সৈকত হতে ফুল, মোমবাতি ও অলঙ্কার দিয়ে পূজোর নৌকা ভর্তি করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্র
যানবাহন, ফায়ারক্রেকার, সাইরেন, শিঙ্গা, হুইসল ও ঘণ্টার আওয়াজ এবং জনগণের বিপুল উল্লাস ধ্বনির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাত ১২টায় নববর্ষের উৎসব শুরু হয়। নববর্ষ নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এ দিবসের সন্ধ্যায় মৃতদের আত্মা ও দুষ্টু প্রেতাত্মাদের আগমন ঘটে। তারা যেন ভীত হয়ে পালিয়ে যায় এ জন্য বিভিন্ন ধরনের বিকট আওয়াজ সৃষ্টি করা হয়। গ্রিসের জনগণের মতো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ শিশুকে নববর্ষের অন্যতম প্রতীকরূপে গণ্য করে। এ ছাড়া, শিশুকে যিশু খৃস্টের প্রতীক হিসেবেও তারা মনে করে। প্যারেড তাদের অত্যন্ত প্রিয় অনুষ্ঠান। ভূত-প্রেত তাড়ানোর জন্য এ প্যারেড প্রথার প্রবর্তন হয়। হ্যালুইন প্রথা অনুসারে বিশ্বাস করা হতো, মুখোশ পড়লে ভূত-প্রেত ভীত হয়। অপরদিকে, মুখোশ মৃতদের প্রতীক হিসেবে মনে করা হতো। এ জন্য তাদের সম্মানার্থে মুখোশ পরার রীতি প্রচলিত হয়। এতে মৃতদের আত্মা খুশি হয়ে প্রস্থান করে।

কিছু কিছু ম্যাগাজিনে নববর্ষ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। সকলে ভবিষ্যৎ জানতে বেশ কৌতূহলী। নববর্ষ উপলক্ষে মধ্য রাতে পান-ভোজনের ব্যাপক আয়োজন করা হয়। মদপানের সময় একে অপরের সুস্বাস্থ্য কামনা করে ও একে অপরের গ্লাসের সঙ্গে ঠোকাঠুকির মাধ্যমে শব্দ সৃষ্টি করে। মধ্যরাতে গ্লাসের এ ঠুন ঠুন শব্দ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন বছরের প্রস্থান ও নতুন বছরের আগমন ঘটে। তারা মনে করে এ শব্দ শোনামাত্র ভুত-প্রেত পালিয়ে যায়।

নববর্ষে শুভ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সকলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। স্কটিশদের মতো তারাও মধ্যরাতে ‘অড ল্যাং সাইন’ সংগীত গেয়ে থাকে। তারপর তারা বাড়িতে প্রথম প্রবেশকারীর অপেক্ষায় থাকে। প্রথম প্রবেশকারীর ওপর তাদের সৌভাগ্য নির্ভর করে। তারা এ দিবসে এমন কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে যা দেখে বুঝা যায় নতুন বছর তাদের কেমন যাবে এবং কী কী কাজ তারা নতুন বছরে করবে।

নিকটজনদের সঙ্গে সকলে নববর্ষ উদাপন করতে পছন্দ করে। নববর্ষ উপলক্ষে তারা চুম্বন বিনিময় করে। নববর্ষের মধ্যরাতে যাকে প্রথম চুম্বন করা হয় তার সঙ্গে নতুন বছর কাটবে বলে তারা বিশ্বাস করে। নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ারে ‘বল ড্রপ’ নামে দেশের অন্যতম বৃহত্তম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এটা মূলত টাইম সিগনাল।

রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে ১৪১ ফুট উঁচু টাইম স্কয়ারের ছাদ থেকে ৫৩৮৬ কেজি ওজন ও ৩.৭ মিটার আয়তনবিশিষ্ট একটি ওয়াটারফোর্ড ক্রিস্টাল বল শ্যাফটের সাহায্যে ফেলা হয়। বলটি পড়তে এক মিনিট সময় লাগে। শেষ দশ সেকেন্ড সকলে গণনা করতে থাকে। এটা পড়া মাত্র ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজে। সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন বছর বিদায়গ্রহণ করে ও নতুন বছরের যাত্রা শুরু হয়।

এ অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে। টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। গ্রিনিচের অনুসরণে প্রায় ১৯০৭ খৃস্টাব্দে এ অনুষ্ঠানটি এখানে প্রচলিত হয়। বল ড্রপ অনুষ্ঠানের অনুকরণে আটলান্টায় পিচ ড্রপ প্রচলিত হয়। নববর্ষের উৎসব যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নববর্ষের শুরুতে তারা নতুন আশা ও উদ্দীপনায় উজ্জীবীত হয়।

এভাবে দেখা যায়, আবহমান কাল থেকে বিশ্বের নানা দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে নববর্ষের উৎসব বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। এ উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানিকতায় কিছু কিছু কুসংস্কার বা অমূলক বিশ্বাস ঐতিহ্যগতভাবে যুক্ত থাকলেও কারো জন্য তা ক্ষতিকর নয়, নিতান্তই গৌণ। বরং সার্বজনীনভাবে এ উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে অনেক মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয়। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও কলুষমুক্ত পরিবার, সমাজ ও জাতির বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সকলেই পুরাতন বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমস্ত হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন বছরে নতুন আশায় উজ্জীবীত হয়ে ওঠে। আনন্দঘন পরিবেশে তারা জীবনকে উপভোগের চেষ্টা করে থাকে। নতুন বছর সকলের জীবনে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবে এ কামনা বিশ্বজুড়ে চিরন্তন।

সূত্র : এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটানিকা, এনসাইক্লোপিডিয়া অ্যামারিকানা, এনসাইক্লোপিডিয়া এনকার্টা, উইকিপিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়