ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মন জুড়িয়ে যায় শুভ্র উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে

সমীর চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ১৭ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মন জুড়িয়ে যায় শুভ্র উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে

জাদুঘরের হেড অব অফিস প্রতিব্রত ভট্টাচার্য্য এর সঙ্গে কথা বলছেন সমীর চক্রবর্তী

সমীর চক্রবর্তী, আগরতলা (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে : শুভ্র উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদ। আকাশের সাদা মেঘের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার। দুপাশে গাছের সারি। এ যেন ত্রিপুরার বুকে অন্যরকম এক শুভ্রতার প্রতীক।

১৯টি উপজাতি জনগোষ্ঠীসহ মিশ্র ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অধিকারী ত্রিপুরায় রয়েছে মাণিক্য রাজবংশের ছয়শ বছরের ইতিহাস। সমৃদ্ধশালী এই ইতিহাস ও ঐতিহ্য সারা বিশ্বকে জানাতে আগরতলার উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদে নবরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ত্রিপুরা রাজ্য মিউজিয়াম। প্রসাদের সম্মুখভাগে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভাস্কর্যসহ মনোরম স্থাপত্য নকশায় চোখ জুড়িয়ে যায়। শতবছর পূর্বে আঁকা রাজাদের ছবিতেও রয়েছে ধাঁধা।

 


ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে বিশ্ব কবির গভীর সম্পর্কের কথা অনেকেরই জানা। মহারাজা বীর চন্দ্র মানিক্য বাহাদুর প্রথম ব্যক্তি যিনি একজন অখ্যাত রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠ কবির স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ সাত বার ত্রিপুরায় আসেন। রাজবাড়িতে থাকতে তার জন্য নির্মাণ করা হয় আলাদা ঘরও। জনশ্রæতি রয়েছে এই  প্রাসাদের নামকরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই  মিউজিয়ামের ২০টি গ্যালারির মধ্যে আলাদা আকর্ষণ রবীন্দ্র গ্যালারি। বাইরে লোকজ সংগীত বাজলেও প্রাসাদের ভেতর বাজে শুধুই রবীন্দ্রনাথের গান। মহারাজা ঈশন চন্দ্র মানিক্যের নাতি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সচিন দেব বর্মনের চিত্রকর্মও রয়েছে জাদুঘরে।

এক হাজার বছর আগের বিষ্ণু মূর্তি, শহরের বিখ্যাত মসজিদ, মন্দির এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চিত্রের মাধ্যমে। তাছাড়া ত্রিপুরার জনগোষ্ঠির উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ু থেকে শুরু করে পুরো জীবন ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যাবে জাদুঘরটিতে।

 


প্রাসাদের ২য় তলায় রয়েছে বীর চন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের (১৮৬২-১৮৯৬) প্রায় ৫ ফুটের মতো লম্বা একটি ছবি। শত বছর আগে আঁকা এই ছবিটির সঙ্গে অন্য ছবির ফারাক হলো এটা মাল্টি ডাইমেনশন ছবি। আপনি যেদিকে ঘুরেই ছবির দিকে তাকান না কেন, মনে হবে মহারাজা আপনার দিকেই ঘুরে তাকিয়ে আছেন। বিষয়টি ধাঁধায় ফেলে দর্শনার্থীদের।

জাদুঘর সূত্র জানায়, বীর চন্দ্র মানিক্য বাহাদুর ত্রিপুরার প্রথম আধুনিক রাজা হিসেবে পরিচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে উন্নত নাগরিক সেবা রাজ্যবাসী তখন থেকেই পেতে শুরু করেন।

 


১৯০১ লন্ডনের মিসেন মার্টিন বার্ন কোম্পানি ৮ শ একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করেন অনিন্দ্য সুন্দর এই প্রাসাদ। তখন রাজা ছিলেন শ্রী রাধাকৃষ্ণ মানিক্য বাহাদুর। রাজদরবার, নাচের ঘর, পাশা খেলার ঘর, কাচারিসহ অন্তত ৬০ টির মতো ঘর রয়েছে প্রাসাদে। এর বাইরে রয়েছে রাজপরিবারের আবাসিক ব্যবস্থা। এখন থাকেন রাজ মাতাসহ রাজপরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারি প্রদ্যুত কিশোর দেববর্মা। যিনি ব্যবসার পাশাপাশি কংগ্রেসের রাজনীতিতে জড়িত।

একসময় গভর্ণর হাউজ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে ২০১৩ সালে রাজ্য জাদুঘরটি পোষ্ট অফিস চৌমুহনী থেকে এই প্রাসাদে স্থানান্তর করা হয়। রাজপরিবারের কাছ থেকে প্রাসাদটি কিনে নেন রাজ্য সরকার।

 


ভারতের পাঞ্জাবের চন্ডিঘর থেকে জাদুঘর দেখতে আসা সঞ্জিব শর্মা এবং বিশ্বজিৎ মগ জানান, গত তিন বছর আগেও তারা একবার এখানে এসেছিলেন। কিন্তু তখন এখানে গভর্ণর হাউজ থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারেননি। আজ ঘুরে দেখে মনটা ভরে গেছে। তার ভাষায়, বহুত পেয়ারা প্যালেস হে।

বাংলাদেশের ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা তরুণ কবির সুমন বলেন, প্রথমবারের ত্রিপুরায় আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই প্রাসাদ দেখা। মনে হয়েছে ত্রিপুরার বুকে এ যেন এক হোয়াইট হাউজ।

জাদুঘরের হেড অব অফিস প্রতিব্রত ভট্টাচার্য্য জানান, প্রতিদিন হাজারের বেশি মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। এর বাইরে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীতো আছেই। যাদের বিনা টিকেটে জাদুঘর দেখার ব্যবস্থা থাকে। তিনি জানান গত তিন বছরে এখানে মোট পর্যটকের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে।

 


মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হচ্ছে আলাদা গ্যালারি:
জাদুঘরের হেড অব অফিস প্রতিব্রত ভট্টাচার্য্য জানান, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা শীর্ষক একটি গ্যালারি দ্রুতসময়ের মধ্যেই আমরা উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। গ্যালারিটিতে বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য রয়েছে। তা ছাড়া শতাধিক ছবির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ক্যামেরাও রয়েছে। এছাড়া যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রসহ অন্যান্য জিনিস সংগ্রহেও কাজ চলছে।

তিনি জানান, গ্যালারিটিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শরণার্থীদের ঢল কীভাবে ত্রিপুরায় ঢুকেছিল। কীভাবে তারা এখানে অবস্থান নিয়েছিল, শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন দেশের প্রধানদের আগমন, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ছবিসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ছবিগুলো মূলত এখানকার প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু সম্মাননা প্রাপ্ত রবিন সেন গুপ্তের তোলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রনাঙ্গণে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং যুদ্ধের ছবি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই গ্যালারিটি চালু হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

যেভাবে যাবেন:
আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে অটোরিকশা কিংবা রিকশাযোগে আপনি পৌঁছতে পারেন রাজপ্রাসাদ বা রাজ্য জাদুঘরে। আসতে পারেন আকাশ পথেও। তবে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আগরতলায় কোন ফ্লাইট নেই। এখানকার মানুষের জন্য প্রবেশমূল্য ১৫ টাকা হলেও বিদেশিদের গুনতে হয় ১৫০ টাকা।

 

 

রাইজিংবিডি/ব্রাহ্মণবাড়িয়া/১৭ এপ্রিল ২০১৭/সমীর চক্রবর্তী/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়