ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মহান বিপ্লবী লেনিন

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২২ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহান বিপ্লবী লেনিন

রুহুল আমিন : মহান বিপ্লবী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে তীব্র শ্রমরোষে শ্রমিক, কৃষকসহ মেহনতি মানুষ ছিল দিশেহারা। মেহনতিদের রক্ত পানি করা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে সুবিধাবাদী জাররা ফুলে-ফেঁপে উঠছিল।

ঠিক এমনই এক সময়ে মার্কস ও এঙ্গেলসের বৈপ্লবিক মতবাদের প্রতিভূ, উত্তরসাধক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উজ্জীবিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন জন্ম নেন।

১৮৭০ সালের ২২শে এপ্রিল রাশিয়ার মহানদী ভলগার তীরে সিমবির্স্ক  (বর্তমানে উলিয়ানভস্ক) শহরে জন্মগ্রহণ করেন লেনিন। লেনিনের বাবা  ইলিয়া নিকোলায়েভিচ উইলিয়ানভ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। গণশিক্ষার ব্যাপারে অনেক কিছু করেন তিনি। গ্রামাঞ্চলে স্কুল খোলেন, শিক্ষকদের সাহায্য করেন, অরুশ অধিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারের দিকে তার খুবই নজর ছিল।

লেনিনের মা-মারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা। কয়েকটি  ভাষা জানতেন তিনি। সাহিত্যে ও  সঙ্গীত খুব ভালবাসতেন।

উইলিয়ানভ-আলেক্সান্দ্রভনা দম্পতির ছয় ছেলেমেয়ে ছিল। তারা হলেন- আন্না, আলেক্সান্দর, ভ্লাদিমির (লেনিন), ওলগা, দৃমিত্রি ও মারায়া।

বাবা-মা তাদের জন্য বহুমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। চেয়েছিলেন তাদের সৎ ,বিনয়ী, পরিশ্রমী ও জনগণের অভাব অনটনের প্রতি সজাগ করে তুলতে। মজার ব্যাপার হলো তাদের ছয় সন্তানের পাঁচ সন্তানই বিপ্লবী হয়ে ওঠে।

লেনিনের বয়স যখন পাঁচ তখন থেকে পড়তে শেখেন। আর নয় বছর বয়সে ভর্তি হন সিমবির্স্ক জিমনেসিয়ামের প্রথম শ্রেণিতে। লেনিন পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিলেন। ছিলেন মেধাবীও। ক্লাসের পর ক্লাস উত্তীর্ণ হলেন প্রথম শ্র্রেণির পুরস্কার পেয়ে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক পড়াশোনা করেন লেনিন। মহান রুশ লেখকদের রচনা তার পাঠ্য সম্ভারে জড়িয়ে ছিল। লেরমন্তভ, পুশকিন, তুর্গেনিভ, নেক্রাসভ, তলস্তয়, সালতিকভ, শ্যেদ্রিন প্রমুখ লেখকের লেখা তিনি পড়তে থাকেন আগ্রহ নিয়ে।তবে বিপ্লবী গণতন্ত্রী লেখকরা তার বেশি প্রিয় ছিল। যেমন ভ. গ. বেলিনস্কি, আ.ই. হেতসের্ন, চেনিশেভস্কি, দব্রলিউবভ ও পিসারেভের রচনা তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তেন।

কিশোর লেলিনের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে রুশ সাহিত্য ও পরিবেশের জীবন পর্যবেক্ষণের প্রভাবে। এ সময় পুঁজিবাদ দ্রুত বিকাশ পাচ্ছিল,  যান্ত্রিকতা ও প্রযুক্তি হাজার হাজার মজুর নিয়ে মাথা তুলছিল কলকারখানা।  ভূমিদাস প্রথার সঙ্গে জার সরকারের স্বৈরাচার, জমিদার ও পুঁজিপতিদের নিপীড়ন; মানুষের অধিকারহীনতা লেলিনের মনে প্রশ্ন জাগায়।

১৮৮৭ সালের মার্চে তার দাদা আলেক্সান্দর উইলিয়ানভ জার তৃতীয় আলেক্সান্দরকে হত্যার অভিযোগে সেন্ট পিটার্সবার্গে গ্রেপ্তার হন। পরে মে মাসে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই ঘটনা লেনিনকে আলোড়িত করে। দাদার ফাঁসির পরই মূলত লেনিন বিপ্লবী সংগ্রামের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন।

লেনিন এ সময় লেখাপড়া চালিয়ে যান। কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন পড়া শুরু করেন। কিন্তু ১৮৮৭ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রসভায় অংশগ্রহণের ফলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।

লেনিন সবসময় মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখা পড়তেন। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিপ্লবী শক্তগুলোকে একীভূত করার প্রক্রিয়ায় নেমে যান।১৮৯২ সালে লেনিন সামারায় প্রথম মার্কসবাদী গ্রুপ স্থাপন করেন।

তেইশ বছর বয়সি লেনিন গ্রাম্য জীবনকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করতেন। কৃষকদের খোঁজখবর নিতেন। এ সময় লেলিনের কর্মপরিধি সামারাসয় কাজান, সারাতভ, সিজরান প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৯৩ সালের আগস্ট মাসে লেনিন সামারা থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে আসেন। সেখানে কিছু গুপ্তচক্র ও তাদের সদস্যরা মার্কস চর্চা করত এবং তা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করত। এই ধরনের একটি চক্রে যোগ দেন লেনিন। এ সময় তিনি বিপ্লবী কাজে গভীর আত্মনিয়োগ করলেন এবং পিটার্সবার্গে মার্কসবাদী স্বীকৃত নেতা হয়ে উঠেন।

পিটার্সবার্গে মার্কসবাদীরা প্রচার চালাত ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। ১৮৯৫ সালে মার্কসবাদীদের সিদ্ধান্তে লেনিন ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলন গ্রুপ ‘শ্রমমুক্তি’ এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় তিনি সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ফান্স ভ্রমণ করেন।

পরে শ্রমিকদের নিয়ে ‘সংগ্রাম সংঘ’প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮৯৬ সালে ‘সংগ্রাম সংঘ’এর নেতৃত্বে পিটার্সবার্গে সুতাকল শ্রমিকদের একটি ধর্মঘট সংঘটিত হয়। এতে ৩০ হাজারেরও বেশি নরনারী শ্রমিক অংশ নেয়। ফলে জার সরকার ডিসেম্বরের গোড়ায় লেনিনসহ দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। জেলে থেকেই তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।

১৮৯৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জার সরকার লেনিনকে তিন বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠায়। এর এক বছর পর লেলিনের বাগদত্তা বধূ নাদেজদা কনস্তানতিনোভনা ক্রুপস্কায়াকেও জার সরকার  সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠায়। পরে স্ত্রীর সঙ্গে তিনি সাইবেরিয়ায় থাকেন। স্ত্রী হিসেবে ক্রুপস্কায়া ছিলেন লেলিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহায়ক।

লেলিনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাশিয়ায় পুজিঁবাদের বিকাশ’  বইটি নির্বাসিত জীবনেই লেখে শেষ করেন। ১৯০০ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে ভ্লাদিমির সস্ত্রীক শশুনস্কয়ে ত্যাগ করেন।

১৯১৪ সালের প্রথমার্ধে রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমেই ব্যাপক হয়ে ওঠে এবং ১৫ লাখ শ্রমিক ধর্মঘট করে। একই বছর রাশিয়ার দুই সম্রাজ্যবাদী দলের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড লড়াই। এদের এক দলে জার্মানি ও অস্ট্রো হাঙ্গেরি এবং অন্যদলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া। দুই দলই অনুসরণ করছিল রাজ্যগ্রাসী নীতি। পরে যুদ্ধে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অন্যান্য রাষ্ট্র। যুদ্ধ হয়ে উঠল বিশ্বযুদ্ধ।

যুদ্ধের বিরোধিতা করায় লেনিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই সপ্তাহ্ পর তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পর লেনিন সুইজারল্যান্ড চলে যান তার বিপ্লবী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য। পরে প্রায় ১০ বছর পর ১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল রাতে লেনিন রাশিয়ায় পৌঁছান। সেখানে বিপ্লবের দ্রুত বিকাশ দেখে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে লেনিন শ্রমিকশ্রেণি ও গরিব কৃষকদের ক্ষমতা দখলের জন্য ব্যবহারিক প্রস্তুতির কর্তব্য, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য তৈরি হবার জন্য জোর দেন।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি লেনিন ফিনল্যান্ডে আত্মগোপন করেন। তবে বিভিন্ন চিঠি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তার কমিটিকে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণে করতে উৎসাহিত করেন।

১ অক্টোবর চিঠিতে লেনিন আর বিলম্ব না করে অভ্যুত্থানে এগোতে বলেন। ২৪ অক্টোবর রাতে পেত্রগ্রাদের ফাঁকা রাস্তাগুলোয় যখন কসাক ও ইউঙ্কার বাহিনীগুলো টহল দিচ্ছিল তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেনিন স্মোলনি আসেন এবং অভ্যুত্থান পরিচালনায় সরাসরি নেতৃত্ব দেন।

লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক, লালরক্ষী, সৈন্য ও নাবিকদের আত্মৎসর্গী সংগ্রাম ও বীরত্বের ফলে জমিদার ও পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়।

২৫ অক্টোবর সকাল ১০টায় পেত্রগ্রাদে সোভিয়েতের অধীনস্থ সামরিক বিপ্লব কমিটি লেনিনের বিবৃতি প্রকাশ করে জনগণের নিকট ঘোষণা দিল যে, সাময়িক সরকারের সঙ্গে যে আদর্শের জন্য জনগণ লড়ছিল তা সফল হয়েছে। এদিন সন্ধ্যাতেই স্মোলনিতে শুরু হয় দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস। এতে নানা অঞ্চল থেকে ৬৫০ জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৪০০ জনই বলশেভিক।

২৬ অক্টোবর কংগ্রেসে লেনিনের বক্তৃতা উল্লাসে অভিনন্দিত করে প্রতিনিধিরা। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের।

১৯২৩ সালের মার্চের গোড়ায় লেনিনের শারীরিক অবস্থা খুবই খরাপ হয়ে আসে। মে মাসে উনি গোর্কিতে ফিরে যান।

১৯২৪ সালের ২১শে জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান মহান এক বিপ্লবী নেতা লেনিন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ এপ্রিল ২০১৭/রুহুল/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়