অবহেলিত মহীরুহ ‘বাওবাব’
জায়েদ ফরিদ || রাইজিংবিডি.কম
মাদাগাস্কারের জায়েন্ট বাওবাব (Adansonia grandidieri)- সূত্র : পিন্টারেস্ট
জায়েদ ফরিদ : ডিনারের শেষে এলো মাত্র সিকি গ্লাস জুস। পরিমাণ দেখে খুব অবাক হলাম। আফ্রিকায় এক আরবি বন্ধুর বাড়িতে নেমনতন্ন। জুসের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসল, 'হাজা তাবাল্দি', আগে একটু চেখে দেখো, তারপর পছন্দ হলে আরো দেওয়া যাবে।
একটু একটু করে চাখছি আর ক্রমাগত খাওয়ার নেশা বাড়ছে আমার। শেষমেষ দেড় গ্লাস তাবাল্দি গিলে ফেলেছি। পেটে জায়গা থাকলে নিশ্চিত আরো খেতাম। যে কেউ খেতো। জুসটা দেখতে তেমন ইম্প্রেসিভ নয়, একেবারেই সাদামাটা, রঙের ভড়ং নেই। মনে হয়, ঘন করে কদবেল গোলানো হয়েছে। স্বাদটাও কিছুটা কদবেলের মতো- টক মিষ্টি। কিন্তু এর ভেতরে এমন আরো কিছু আছে, যার স্বাদ আজ পর্যন্ত কেউ সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারেনি। ইচ্ছাসত্বেও যখন আর খেতে পারছি না, তখন মনে হতে লাগল, এটিই হয়ত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পানীয়!
এবার জিজ্ঞাসার পালা, কোথায় পাওয়া যায় এই তাবাল্দি? আরবি বন্ধু বর্ণনা করল ঠিকই, কিন্তু ভাষার কারণে তা তেমন বোধগম্য হলো না। শুধু বোঝা গেল এটা ফলের রস, লম্বা ফল, পেঁপের মতো। তাকে বললাম, গাছটার বর্ণনা দিতে। সে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল, 'আরে এই গাছ তো ইন্ডিয়ার কারনাতাকে (কর্ণাটক) আছে। আমি খবরে পড়েছি, হাজার হাজার মানুষ দেখতে যায়, এমন কি রাজনীতিবিদরাও। তিনটে বিশাল গাছের নিচে রাতবিরেতেও সাধুসন্তু বাস করে। এবার আমার আরো আশ্চর্য হওয়ার পালা। আমার বেবুঝ দৃষ্টি দেখে এবার আরবি বন্ধু কতগুলো কাঁটাচামচ নিয়ে এসে কোকের বোতলের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এই হলো তাবাল্দি গাছ। এবার আর বুঝতে সমস্যা রইল না আমার, ‘ওহ এটা তাহলে বাওবাব!’ এবার সে সোৎসাহে বলে উঠল, আইওয়া, 'বু-হেবাব'; যার অর্থ 'ফাদার অব সিডস্'।
প্রিজন বাওবাব, অস্ট্রেলিয়া (Adansonia gregorii)- সূত্র: অস্ট্রেলিয়ান সিড
আরবি বু-হেবাব থেকেই বাওবাব শব্দের জন্ম। আফ্রিকায় যাতায়াতকারী আরব ব্যবসায়ীরা এই নামটির প্রসার ঘটিয়েছে। সুদানে এর নাম তাবাল্দি। গুণ বিচারে এর ইংরেজি নাম হয়েছে 'ট্রি অব লাইফ'। গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এডানসোনিয়া ডিজিটেটা (Adansonia diogitata)। ফরাসি উদ্ভিদবিদ এডানসন বলেছিলেন, তিনি জীবনে যত গাছ নিয়ে স্টাডি করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে উপকারী গাছ এই বাওবাব। দিনে দুবার করে তাবাল্দি খেতেন তিনি, যা তার সুস্বাস্থ্য বজায় রাখত। এই ফলে আছে প্রচুর ফাইবার, কমলার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে বেশি পটাসিয়াম, ব্লুবেরির চেয়ে বেশি এন্টিঅক্সিডেন্ট। এর শুকনো পাউডার বাজারজাত করা হচ্ছে, কোনো প্রিজারভেটিভ ছাড়াই যার শেলফ্-লাইফ তিন বছর। এর পাতা খাওয়া যায় যা ‘মালি’র আঞ্চলিক ভাষায় ‘লালো’নামে বিক্রি হয়। এর বীজ থেকে তেল হয়, যার খৈল পশুখাদ্য। ইউরোপ ও অন্যান্য পশ্চিমের দেশগুলোতে দিন দিন তাবাল্দি পাল্প পাউডারের চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে, এখন নতুন করে নানা দেশে বাওবাব লাগানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিকের একটি এস্টিমেটে বলা হয়েছে, পৃথিবীব্যাপী বাওবাবের চাহিদা মেটানোর জন্য আফ্রিকায় যে ফসল তৈরি হতে পারে তার বাৎসরিক মূল্য অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার।
প্রাগৈতিহাসিক বাওবাব গাছ মাদাগাস্কার ও আফ্রিকার নেটিভ। তবে ভারত, ইয়েমেন, ওমান, মালয়েশিয়া, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও দেখা যায়। বাংলাদেশে ঢাকার বড় বাগানগুলোতে কয়েকটি গাছ আছে যাদের বয়স কম।
এডানসোনিয়ার নয়টি প্রজাতির মধ্যে ছয়টি মাদাগাস্কারের, দুটি আফ্রিকার ও একটি অস্ট্রেলিয়ার। আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রজাতি খুব কাছাকাছি, জিনগতভাবেও সহজে পৃথক করা যায় না। এই নয় প্রজাতির মধ্যে চারটির ফুল রঙিন, পাঁচটির সাদা। প্রকৃতিতে এখন আর বাওবাব গাছ মালিকানাহীন অবস্থায় দেখা যায় না, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এদের পরিচর্যা করে এবং ফসল তোলে। বেশ উঁচু হয় বাওবাব, প্রায় ৮০ ফুটের মতো আর কান্ডের ব্যস সর্বোচ্চ ৪৫ ফুট। এই গাছের ‘এনুয়াল গ্রোথ রিং’স্পষ্ট নয়, তাই গাছের বয়স নির্ধারণ করতে রেডিও কার্বন ডেটিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা সামান্য কয়েকটি গাছে করা হয়েছে।
আফ্রিকান বাওবাবের ফুল (Adansonia digitata)-সূত্র: রিচার্ড লিয়ন নার্সারি
বাওবাব সহজে মরে না, হাজার বছর বা তারও বেশি টিকে থাকে পরিবেশ বৈরিতার বিরুদ্ধে। বোতলের মতো চিকন গলা আর ঝুঁটিতে কিছু ডালপালা, দেখতে কিম্ভূতকিমাকার এই গাছের বয়স বেড়ে গেলে আপনা থেকেই গোড়ায় খোড়ল সৃষ্টি হয়। যথেষ্ট বিস্তৃত হওয়ার কারণে আফ্রিকায় এই খোড়ল বাড়িঘর, পোস্ট অফিস, জেলখানা, এমনকি রেস্টুরেন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। একসময় ঘানায় এদের ব্যবহার করা হয়েছে ক্রীতদাসদের জেলখানা এবং কবরস্থান হিসেবেও। আফ্রিকাবাসীদের জন্য খোড়লের সবচেয়ে বড় ব্যবহার ছিল দুর্দিনের জন্য জলসঞ্চয়ে। মানুষ খানিকটা উঁচুতে এর গায়ে গর্ত করে ভেতরের খোড়লে জলাধার বানিয়েছে। অনেক সময় লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রয়োজনমতো কেটেকুটে স্টোরের আকার তৈরি করে নিয়েছে। বৃষ্টির পর সাময়িক জলাধার থেকে পানি বয়ে নিয়ে বাওবাব-স্টোরের ভেতর রেখেছে তৃষ্ণার্ত দিনের সহায়ক হিসেবে। খুব বেশি বয়স হয়ে গেলে এই খোড়লের ভিতের দিক থেকে পচে উঠে গাছের মৃত্যু হয় এবং এক সময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।
খোলা জায়গায় উঁচু গাছে বজ্রপাত ঘটে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেঁচে থাকে গাছ। এদের বাকলে প্রচুর ট্যানিন থাকে বলে আগুন নির্বাপিত হয়ে যায়। হাতিরা খুব বেশি তৃষ্ণার্ত হলে লম্বা দাঁত দিয়ে গাছের বাকল খুলে ফেলে ভিতরের স্পঞ্জি নরম রসালো ত্বক খেতে শুরু করে। এর ত্বকে জমা থাকতে পারে ২০-৩০ হাজার লিটার পানি। তবে ইদানিং মাদাগাস্কারে কৃষিক্ষেত্র তৈরির কারণে গাছের আশাপাশে জলাজমির সৃষ্টি হয়েছে যা বাওবাবের জন্য বেশ ক্ষতিকর। বাওবাবের ফাইবার থেকে দড়ি, বিভিন্ন রকম বাস্কেট, ঘর ছাওয়ার জিনিষ ইত্যাদি তৈরি হয় বলে মাটি থেকে দুই-আড়াই মিটার পর্যন্ত এর ছাল সংগ্রহ করে মানুষ। এতে বাওবাব মরে না, নতুন করে আবার ছাল তৈরি করে নেয়। বাওবাবের ফল সময়মতো সংগ্রহ না করলে তা ৬ মাস পর্যন্ত গাছে ঝুলে থাকতে পারে। এই শুকনো ফল পাউডার করে খাওয়া চলে, নষ্ট হয় না। গাছ থেকে ফল সংগ্রহের সুবিধার জন্য উঁচু গাছের গায়ে গর্ত করা হয় বা খুঁটি পোঁতা হয় যা গাছের ক্যানপিতে চড়ার জন্য সহায়ক হয়। তবে এই অদ্ভুতভাবে গাছে চড়ে ফল সংগ্রহের কাজটি নির্বাচিত কিছু মানুষই করতে পারে।
তানজানিয়াতে বাওবাবের ফল সংগ্রহ- সূত্র: ফ্রুটিপিডিয়া
বৃহদাকার বাওবাব ফুলের মধ্যে ডিজিটেটা প্রজাতির ফুলের প্রান্তে কদমের মতো ঝুলন্ত পুংকেশর থাকে। পরাগায়ন ও ফল-বীজের বিসরণ বিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যয়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদাগাস্কার দ্বীপে, যেখানে বাওবাবের ছয়টি প্রজাতি আছে সেখানে এদের পরাগায়ন করে হক-মথ (Hawk Moth) ও ক্ষুদ্র লেমুর (Lemur)। বীজ বিসরণের জন্য এতদঞ্চলে একসময় বাস করতো বেবুন ও সবচেয়ে বড় পাখি এলিফ্যান্ট বার্ড (Aepyornis maximus) যাদের উচ্চতা ছিল ১০ ফুট, ডিমের ওজন ছিল ১০ কিলোগ্রাম। ভারতে ভুবনেশ্বর ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এই পাখির একটি ফসিল ডিম সংরক্ষিত আছে। অস্ট্রেলিয়ার বাওবাব ফুলে পরাগায়ন নিয়ে নানা পরীক্ষা করা হয়েছে, বিভিন্ন ফুলের কাছে সারারাত সাউন্ড-এক্টিভেটেড ক্যামেরা ঝুলিয়ে। দেখা গেছে, ফ্লাইং ফক্স নামে এক ধরনের প্রকাণ্ড ফলখেকো বাদুড়ই (Pteropus alecto) মুলত এর পরাগায়ন করে। এসব বাদুড় গাঙ্গেয় শুশুকের মতো একো-লোকেশন সিস্টেমে চলে না, চোখ দিয়ে দেখে লক্ষ্যস্থানে উড়ে যায়। ৫-৬ ফুট বিস্তৃত ডানার বাদুড়গুলো একো-লোকেশনে সিদ্ধ নয় বলে এসব বাদুড় গুহায় বাস না করে গাছে বাস করে। আগে ভাবা হতো, এদের পরাগায়নে হক-মথের সবচেয়ে বড় ভূমিকা আছে। মূলত হক-মথের ২০ সেন্টি লম্বা শুঁড় দিয়ে এরা দূর থেকেই মধু খেয়ে চলে যায়, পরাগের সাথে কোনো সংশ্রব ঘটে না।
বাওবাব নিয়ে সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা এখন সিরিয়াস গবেষণায় লিপ্ত। পৃথিবীর বহু জায়গায় বিশেষত আফ্রিকায় এদের প্রচুর ফলন সম্ভব যা আমাদের দিতে পারে অতিরিক্ত স্বাদ ও পুষ্টি এবং এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে প্রচুর কর্মসংস্থান, যা কিছু অবহেলিত দরিদ্র জাতিকে আর্থিকভাবে ওপরে টেনে তুলতে পারে।
লেখক : প্রবাসী উদ্ভিদবিদ
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ এপ্রিল ২০১৭/হাসনাত/রফিক
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন