ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিন্ধুতে নিয়ে যাওয়া বিন্দুবাসিনী

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ১৬ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিন্ধুতে নিয়ে যাওয়া বিন্দুবাসিনী

স্কুলের প্রশাসনিক ভবন (সংগৃহীত)

শাহেদ হোসেন : যে মা দেশ ও জাতিকে আলোকিত সন্তান উপহার দেন তাকে বলা হয় ‘রত্মগর্ভা’। আচ্ছা, যে স্কুল দেশকে আলোকিত ও সফল শিক্ষার্থী উপহার দেয় তাকে কী বলা হবে- রত্মপ্রসবা?

প্রাক্তন ছাত্রদের তালিকার একটি অংশের ওপর নজর বুলালে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়কে বোধ হয় নিঃসন্দেহে উপরোক্ত বিশেষণে ভূষিত করা যায়। বাংলাদেশে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্ত, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ড. এম.এন হুদা, সাবেক বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রাক্তন সচিব ও রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল আলম শহীদ, ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি সাযযাদ কাদির, কবি আল মুজাহিদী, সুরশিল্পী অনুপম ঘটক, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক ও প্রাক্তন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ, প্রাক্তন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, জাতিসংঘের পরিবেশ পরিকল্পনাবিদ প্রফেসর ড. সাইদুল ইসলাম খান, চিত্রশিল্পী রনজিৎ দাস, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী, পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারসহ জাতীয় পর্যায়ে সফল শতাধিক ব্যক্তি ছিলেন এই স্কুলের শিক্ষার্থী।         

টাঙ্গাইল পৌরসভার ৪নং দিঘুলিয়া ওয়ার্ডে অবস্থিত স্কুলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৮০ সালের ৩ এপ্রিল। স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানকার একটি মাইনর স্কুলকে হাই স্কুলে উন্নীত করেন। তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক গ্রাহাম সাহেবের নামে এর নামকরণ করা হয় ‘গ্রাহাম ইংলিশ হাই স্কুল’। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় পাঁচ বছর স্কুলটিকে অর্থসংকটের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে স্কুলটির খরচ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হলে মাত্র দুই বছর তিনি এর ব্যয়ভার বহন করেন। ১৮৮৭ সালে সন্তোষের জমিদার বিন্দুবাসিনী চৌধুরানী স্কুলটির দায়িত্ব নেন। তার মৃত্যুর পর সন্তোষের পাঁচ আনা অংশের জমিদার দুই ভাই, প্রমথ নাথ রায় চৌধুরী ও মন্মথ নাথ রায় চৌধুরী স্কুলের দায়িত্ব নেন। তারা মায়ের নামে স্কুলটির নাম দেন ‘বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল’। এখন স্কুলটি যেখানে অবস্থিত সেই জমি, উদ্যান, নিউ মার্কেটসহ ছাত্রাবাস ও স্টেডিয়ামসংলগ্ন পুকুরের জায়গা তারা স্কুলের নামে দান করেন। ১৯১০ সাল পর্যন্ত প্রমথ নাথ রায় স্কুলের ব্যয়ভার বহন করেন এবং ওই বছর এটি ট্রাস্ট সম্পত্তি হিসেবে তিনি সরকারকে প্রদান করেন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুলটি জাতীয়করণ করা হয়।

প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল করিম


বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসেও বিন্দুবাসিনী স্কুলের নাম জড়িয়ে আছে। ডা. কামরুল হাসান স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন: ১৯৬৯ সালে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ প্রায় প্রতিদিনই বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে সভার আয়োজন করতেন।...বিন্দুবাসিনী মাঠ তখন যুদ্ধের প্রস্তুতি ক্ষেত্র। সভা ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রশিক্ষণ হতো প্রতিদিন।

১৯৭১ সালের ৯ মার্চ বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠেই মওলানা ভাসানীকে গানস্যালুট দেওয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ স্কুল মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পতাকা দিবস পালিত হয়েছিল। মার্চে স্কুল মাঠেই জয়বাংলা বাহিনীর সমাপনী কুচকাওয়াজ হয়েছিল। আবার যুদ্ধের পর স্কুল মাঠেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন।

শতবর্ষী বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ফলাফলও রীতিমতো ঈর্ষণীয়। মাধ্যমিকে স্কুলটির পাসের হার শতভাগ। ২০০৮ সালে এটি ঢাকা বোর্ডে অষ্টম, ২০১১ সালে পঞ্চম এবং সারা দেশে ষষ্ঠ স্থান দখল করেছিল। ২০১৫ সালে স্কুলটি সরকারিভাবে দেশসেরা স্কুলের স্বীকৃতি লাভ করে।

স্কুলটির বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল করিম এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। তিনি জানালেন, স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতি আসনের বিপরীতে সাতজনকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হয়। ভর্তি প্রক্রিয়াটি অনলাইনের মাধ্যমেই হয় এবং জেলা প্রশাসকের তত্বাবধানে হওয়ায় এখানে স্বজনপ্রীতির কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে স্কুলে প্রায় ১ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। চলতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্কুল থেকে ৪১০ জন অংশ নিয়েছে। এদের মধ্যে ৩৬১ জন পেয়েছে এ প্লাস, ৪৮ জন এ আর মাত্র একজন পেয়েছে এ মাইনাস। গত বছর জেএসসিতে অংশ নিয়েছিল ৩৫৬ জন পরীক্ষার্থী। এদের মধ্যে ৩৪৬ জন এ প্লাস এবং ১০ জন পেয়েছে এ।

মাঠসহ স্কুল ভবনের একাংশ (সংগৃহীত)


মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্কুলে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগ থাকলেও মানবিক বিভাগে কোনো শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষকেরা কোনোভাবেই অভিভাবক কিংবা শিক্ষার্থীকে মানবিক বিভাগে পড়াতে রাজী করাতে পারেন না। এই স্কুলে পড়ুয়াদের সিংহভাগেরই পছন্দ বিজ্ঞান বিভাগ। হয়তো এ কারণেই বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় এই স্কুলের অংশগ্রহণ ও অর্জন দুটোই বেশি। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকবার জাতীয় পর্যায়ে পদক জয় তারই প্রমাণ। শুধু বিজ্ঞান নয়, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অর্জন অনেক বেশি। ক্রিকেটে জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে অসংখ্যবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বিন্দুবাসিনী। প্রতি বছর খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০টি পদক জয় করে নিয়ে আসে স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

চলতি বছর জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের পদক পাওয়া মো. আব্দুল করিম জানালেন, ১৯৯৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছিল তার স্কুল। ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ স্কুল হয়েছিল বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতি বছরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই স্কুল কোনো না কোনো পদক অর্জন করছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জনকারী প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সুযোগ পেলেই স্কুলে আসেন বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল করিম। পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার দায়িত্বে থাকাকালে একবার স্কুলে এসেছিলেন। ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে তিনি প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বইভর্তি দুটি বুকশেলফ উপহার দিয়েছেন। প্রাক্তনদের অনেকেই স্কুলের জন্য অনেক কিছু করতে চান। সরকারি স্কুল হওয়ায় তাদের খুব একটা কিছু করারও থাকে না। তবে বিন্দুবাসিনীর শিক্ষা নিয়ে জীবন সিন্ধুতে জয়ী হওয়া শিক্ষার্থীরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্কুলে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ মে ২০১৭/শাহেদ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়