ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ওডারল্যান্ড বাংলাদেশের এক পরম বন্ধু

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৮ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওডারল্যান্ড বাংলাদেশের এক পরম বন্ধু

রুহুল আমিন : উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড, সংক্ষেপে ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা। আজ ১৮ মে ওডারল্যান্ডের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে বাংলাদেশের বিদেশি এই পরম বন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে অস্ট্রেলিয়া ওডারল্যান্ডের পিতৃভূমি ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি তার। কারণ ১৭ বছর বয়সেই তিনি জীবিকার তাগিদে সু-সাইনার হিসেবে নেদারল্যান্ডের বাটা সু-কোম্পানির চাকরিতে যোগ দেন।

দুই বছর বাটায় চাকরি করেন তিনি। এরপর তিনি যোগ দেন ডাচ সেনাবাহিনীতে। এ সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড আক্রমণ করে। ১৯৪০ সালে নাৎসিদের বিমান হামলায় হল্যান্ডের রটারডাম শহর বিধ্বস্ত হয়। হল্যান্ড চলে যায় জার্মানির দখলে। ওডারল্যান্ড হন বন্দি। তবে কৌশলে তিনি বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে জার্মান যুদ্ধফেরত সৈনিকদের ক্যাম্পে কাজ করতে থাকেন।

ফ্যাসিবাদের প্রতিবাদস্বরূপ ১৯৪১ সালে হিটলারের জার্মানের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডের মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করেন। ডাচদের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জার্মান ভাষা রপ্ত ছিল তার। এই সুযোগ নিয়ে তিনি জার্মানদের গোপন আস্তানায় ঢুকে পড়েন। তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাতে থাকেন মিত্রবাহিনীর কাছে। ১৯৪৩-এ যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো বাহিনীতে। একজন কমান্ডো হওয়ার কারণে তিনি শান্তির অন্বেষায় এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের নিভৃত অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডের একজন রেডিও টেকনিশিয়ান, গোলা-বারুদ ও সমর বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা ওডারল্যান্ড। যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জার্মানদের নৃশংসতা, বন্দিশিবিরে অবর্ণনীয় কষ্ট ওডারল্যান্ডকে সাহসী, প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী করে তোলে। ১৯৭১ সাল। বাঙালি মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধিকারের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ৭১’ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙালি গণহত্যা ওডারল্যান্ডকে বিচলিত করে। প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী ওডারল্যান্ডের মনে পাকিস্তানি সৈন্যের জঘন্য গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিকাণ্ড, নারী নির্যাতন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ দিনে নিয়ে যায় তাকে।নিজের ভেতর অনুভব করেন মানবতার লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার তাগিদ।

ওডারল্যান্ড তখন কেবল বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাটা সু কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বয়সও তখন ৫৪ বছর। তারপরও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যোদ্ধার ভূমিকায়। বাংলাদেশের টঙ্গীতে তার কার্যালয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ওডারল্যান্ড একজন গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেন। প্রথমত তিনি বিদেশি, আবার একটি বৃহৎ কোম্পানির কর্ণধার। এই সুবাদে তার অবাধ যাতায়াত ছিল সর্বত্র। কর্মসূত্রে তার সঙ্গে পরিচয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বাটা সু-কোম্পানির পার্সোনাল ম্যানেজার  নেওয়াজের। নেওয়াজ ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। যুদ্ধ শুরু হলে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নেওয়াজকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান ওডারল্যান্ড। কিছুদিন বাদে ঢাকায় আসেন নেওয়াজ। ওডারল্যান্ডকে নিয়ে যান ঢাকা সেনানিবাসে। তাকে সেনা হেড কোয়ার্টারে বিবেচনা করা হয় সম্মানীত মেহমান হিসেবে। এই সূত্র ধরেই সেনাসদরের দরজা তার জন্য হয়ে যায় উন্মুক্ত।

এর কিছুদিন পরেই নেওয়াজের মাধ্যমে জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল নিয়াজী ও পুলিশ কমিশনার চৌধুরীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন সামরিক ও বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওডারল্যান্ডের পরিচয় ঘটে।

এ কারণেই যুদ্ধের সময় পাক সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সহজেই পেয়ে যান এবং মুক্তিকামী বাঙালীদের যুদ্ধের পক্ষে তা কাজে লাগান। নিয়ে নেন যখন তখন সেনাসদরে যাওয়ার পাস। এই পাস দিয়ে কারফিউ চলাকালেও ঢাকা সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে চলাফেরার অনুমতি ছিল। পরে ওই পাস কাজে লাগিয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা ও পরিকল্পনা গোপনে পাঠাতে থাকেন ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। আর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে হত্যা-নির্যাতনের ছবি তুলে গোপনে পাঠাতেন বিদেশের গণমাধ্যমে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক গোপন তথ্য বের করে সরবরাহ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধকালীন মুহূর্তে তিনি পাকিস্তানি রণকৌশল ও পদ্ধতি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএ. জি ওসমানীর কাছে সরবরাহ করেছেন। প্রথমে গোয়েন্দাগিরি করেই তিনি সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো রণাঙ্গণে নিয়ে যায়। তিনি সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। টঙ্গীতে বাটা কারখানার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেন প্রশিক্ষণ শিবির। প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরি করেন। পরে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ চালান তিনি। ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করেন, বিচ্ছিন্ন করে দেন রেল যোগাযোগও। যুদ্ধকালীন মুহূর্তে সমর কৌশলের ওপর ক্লাসও নিতেন। এ ছাড়া অর্থসাহায্য, ওষুধপত্র, গরম কাপড়, জুতা, কারিগরি সাহায্য, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি দ্বারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন এমন বিদেশির সংখ্যা কম নয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে যুদ্ধে যাওয়া এক প্রকার বিরল। আর এই জন্যই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত একমাত্র বিদেশি ওডারল্যান্ড। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১৭।

ওডারল্যান্ড ১৯৭৮ সালে বাটা সু কোম্পানি থেকে অবসর নেন। পরে ফিরে যান স্বদেশভূমি অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পুনরায় কিছুদিন চাকরি করেন।  পরে ২০০১ সালের ১৮ মে মহান মুক্তিযুদ্ধের এ রীব সৈনিক পার্থের একটি হাসপাতালে৮৪ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গর্ব করে নামের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া বীর প্রতীক খেতাবটি লিখতেন তিনি। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারায় প্রকৃত একজন বন্ধুকে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মে ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়