ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শাকিলের হাইব্রিড কার সোলার বাইক

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ২৩ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাকিলের হাইব্রিড কার সোলার বাইক

মটোমিস্ট স্মার্ট বাইক

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : মনজুর রহমান শাকিল মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়ছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে উদ্ভাবন করেছেন পাঁচ প্রযুক্তির গাড়ি। জাইকা আয়োজিত অটোমোবাইল প্রতিযোগিতা ইকোরান-এ শাকিলদের ‘মটোমিস্ট হাইব্রিড কার’ পয়েছে শ্রেষ্ঠ নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনী পুরস্কার।

শাকিল রাইজিংবিডিকে বলেন, যেহেতু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ি, ছোট ছোট গাড়ি তৈরি করা আমাদের পড়ার অংশ। আমরা সব সময় ভাবি, এমন গাড়ি তৈরি করা য়ায় কিনা যাতে জ্বালানী খরচ খুব কম লাগে। সেই ভাবনা থেকে শাকিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন মটোমিস্ট টিম। এই দল একে একে উদ্ভাবন করতে থাকে মটোমিস্ট গাড়ি, মটোমিস্ট হাইব্রিড কার, মটোমিস্ট স্মার্ট বাইক, মটোমিস্ট সোলার বাইক এবং  মটোমিস্ট ফ্লাইং কার। শাকিল জানান, তাদের প্রতিটি প্রজেক্ট সম্পূর্ণ করতে প্রধান সমস্যা ছিল বাজেট। কোনো রকম পৃষ্ঠপোষকতা তারা পাননি। নিজেদের টিউশনের টাকা দিয়ে প্রজেক্টগুলো তৈরি করেছেন। সম্প্রতি তিনি বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন অটো মোবাইল ক্লাব। তার স্বপ্ন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে তিনি অটো মোবাইল কারখানা গড়ে তুলবেন। পাঠক চলুন, মনজুর রহমান শাকিলের পাঁচ উদ্ভাবন সম্পর্কে জেনে নেই।
 


মটোমিস্ট: মটোমিস্ট গাড়ির মাধ্যমেই শাকিলের হাতেখড়ি হয় অটোমোবাইলে। শাকিল জানান, ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সাকিব, ইশ্মি, রৌফি, সালমান, মৃণালসহ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে মটোমিস্টের কাজ শুরু করেন। সাথে ছিলেন চতুর্থ বর্ষের রায়হান। এই গাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল কম জ্বালানিতে গাড়ি চালানো এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি অটোমোবাইলের সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করানো।
 


মটোমিস্ট হাইব্রিড কার: মটোমিস্ট হাইব্রিড কার বাংলাদেশে তৈরি প্রথম হাইব্রিড কার। শুধু ইঞ্জিনের মাধ্যমে এই গাড়ি চালিয়ে তারা অর্জন করে দেশের একমাত্র অটোমোবাইল প্রতিযোগিতা ইকোরান-১৫ এর দ্বিতীয় রানার্স আপ পুরস্কার। এখানেই শেষ নয়, তারা এর মাধ্যমে অর্জন করে শ্রেষ্ঠ নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনী পুরস্কার। শাকিল বলেন, ‘আমাদের গাড়ি তৈরিতে সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে মাইল্ড স্টীল ও স্টীল শিট যা দেশীয় বাজারে সহজলভ্য। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ ফলে এ দেশের রাস্তাঘাট তেমন উন্নত নয়। বর্ষাকালে রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের রাস্তায় গাড়ি চালানো কষ্টকর এবং ঝুকিপূর্ণ। তাই গাড়ির বডি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে ডাবল চেসিস। এই চেসিস একটির উপরে আরেকটি বিশেষভাবে সাস্পেনশন সিস্টেমে যুক্ত। তাই ঝাকিতে নিচের চেসিসে প্রেসার পড়ে, উপরের চেসিসে চাপ পড়ে না বিধায় যাত্রীদের ঝাকি কম লাগবে।’

মটোমিস্ট হাইব্রিড গাড়ি পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানী সাশ্রয়ী। একটি ১৩০০ সিসি গাড়ি লিটারে যেখানে চলে ১৭-২০ কিমি সেখানে এই গাড়ি ১০০ সিসিতে চলে ২৮-৩৫ কিমি। পাশাপাশি ব্যাটারিতেও চলবে। ম্যাক্সিমাম স্পিড হবে ইঞ্জিনে ঘণ্টায় ৪০ কিমি/ঘণ্টা, মটরে ৫০-৫৫ কিমি/ঘণ্টা। গাড়িটি এক আসনবিশিষ্ট। বর্তমানে প্রচলিত গাড়ির তুলনায় প্রায় ৪গুণ জ্বালানী সাশ্রয়ী হবে।

মটোমিস্ট স্মার্ট বাইক: শাকিল ও তার দুই বন্ধু সিয়াম ও প্রাণ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৈরি করেন মটোমিস্ট  স্মার্ট বাইক। শাকিল জানান, এটি ছিল মূলত ইলেকট্রিক বাইক। বাইকটি চালাতে তেল, গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে না। ফলে কালো ধোয়া বের হবে না। এটি পরিবেশবান্ধব।
 


মটোমিস্ট সোলার বাইক: শাকিল বন্ধুদের নিয়ে ২০১৬ সালে তৈরি করেন ইলেক্ট্রিক মোটর সাইকেল। ব্যাটারির সাহায্যে এটি চালানো যায়। ব্যাটারি বার বার চার্জ করা ঝামেলাপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। শাকিল বলেন, ‘আমি চিন্তা করলাম বিকল্প উপায়ে চার্জ কীভাবে করা যায়। তখন মাথায় আসে সৌর শক্তিতে চার্জ করার বিষয়টি। কথা বললাম বন্ধুদের সঙ্গে, তারা একমত হলো। কিন্তু বাজেটের সমস্যা হলো। পৃষ্ঠপোষক না পাওয়ায় গ্রুপে যোগ করলাম ডিপার্টমেন্টের ছোট পাঁচ জুনিয়রকে। তাদের সাথে নিয়ে সাত দিনে তৈরি করলাম দেশের প্রথম সোলার মোটর সাইকেল। বাংলাদেশের প্রথম সৌরশক্তি চালিত মোটরবাইক এটি। আগে কিছু সোলার গাড়ি তৈরি হলেও বাইক এই প্রথম।’

শাকিল জানান, সোলার বাইকে ব্যবহার করা হয়েছে ৪৮ ভোল্টের ডিসি মোটর। ১২ ভোল্টের চারটি ব্যাটারি সিরিজে সংযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে পাওয়ার ব্যাংক। বাইকটিতে আরো ব্যবহার করা হয়েছে ১৪০ ওয়াটের সোলার প্যানেল। ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষভাবে তৈরি ভার্জ কন্ট্রোলার। এটিকে ২৪ ভোল্ট থেকে বিশেষভাবে ৪৮ ভোল্ট করা হয়েছে যে কারণে অতিরিক্ত সূর্য রশ্মি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ব্যাটারিতে ক্ষতি হবার আশঙ্কা কমবে। এই প্যানেল সূর্যের আলোর সাহায্যে ব্যাটারি চার্জ করতে সময় নেবে আট ঘণ্টা। যা দিয়ে বাইকটি চলবে টানা সাড়ে চার ঘণ্টা।

বাইকটি বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। শাকিল বলেন, দেশে এখন চার্জিত ইজিবাইক আর অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে গেছে, যার পুরোটাই বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। যা জাতীয় গ্রিডে চাপ ফেলছে। এগুলোকে যদি সোলার সিস্টেম করা যায় তাহলে এই চাপ অনেকটাই কমানো সম্ভব।
 


মটোমিষ্ট ফ্লাইং কার : শাকিল ও তার দুই বন্ধু মিলে ২০১৬ সালের আগস্টে তৈরি করেছেন, মটোমিষ্ট ফ্লাইং কার। গ্রুপের অন্য দুইজন সদস্য হল- শাহরিয়ার শাহ্‌ আর নুর মোহাম্মদ। প্রজেক্টি তৈরি করতে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছে কোর্স কোঅর্ডিনেটর যন্ত্রকৌশল বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর লে. কর্নেল শরিফ। চার জনের প্রায় তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় দেশের প্রথম প্রোটোটাইপ ফ্লাইং কার।

শাকিল বলেন, আমাদের মটোমিষ্ট ফ্লাইং কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থা এবং ট্রাফিক জ্যাম কমানো। তবে মানুষবাহী গাড়ি তৈরি করাটা অসম্ভব বলে আমরা প্রটোটাইপ তৈরি করি। কিন্তু দেশীয় প্রযুক্তিগত কারণে আমাদের এই গাড়ির মডেলের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথম ও প্রধান সীমাবদ্ধতা হল, এই গাড়ি বেশি জায়গা দখল করে, এর প্রপেলারগুলো ফোল্ডিং করা গেলে কম জায়গায় চলতে পারে। তবে দেশীয় প্রযুক্তিতে এটি করা প্রায় অসম্ভব।

শাকিল আরো বলেন, ফ্লাইং কারের ব্যবহারিক মূল্য রাখার জন্য আমরা এটায় রেস্কিউ রোবোটের বৈশিষ্ট যোগ করার সিদ্ধান্ত নেই। রেস্কিউ রোবট হল, বিভিন্ন দুর্যোগে এ রোবট উদ্ধার কাজে ব্যবহার করা হয়। ভূমিকম্প বা আগুনে আক্রান্ত কোনো স্থানে আমাদের এ রোবট গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পারবে। এই ফ্লাইং কারে যুক্ত আছে একটি স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা, জিপিএস সিস্টেম, টেম্পারেচার সেন্সর। ধরা যাক, কোনো বহুতল ভবনে আগুন লাগল, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অনেক উঁচুতে উঠে দেখতে পারছে না কোনো আক্রান্ত মানুষ আছে কিনা, কিন্তু আমাদের এই রোবট ক্যামেরার সাহায্যে তথ্য নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এটি আগুন সহ্য করতে পারবে না, তবে নির্দিষ্ট দুরত্বে থেকে এটি কাজ করতে পারবে। আবার ভূমিকম্প বা ভবন ধসেও এটি ব্যবহার যেতে পারে। রানা প্লাজার কথা চিন্তা করতে পারি, এমন অনেক জায়গা ছিল যেখানে মানুষ যেতে পারেনি, বিপজ্জনক ছিল বা যাবার রাস্তা ছোট ছিল। এমন পরিস্থিতিতে এই ফ্লাইং রেস্কিউ রোবট ব্যবহার করা যাবে। এটি মাটিতে চলার পাশাপাশি আকাশে উড়তে পারে। এছাড়া জিপিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে লোকেশন নির্ধারণ করা যায়। এটি সর্বোচ্চ তিন কেজি ওজন নিতে পারবে। ফলে খাবার বা ওষুধ আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো সম্ভব।

শাকিল জানান, এই ফ্লাইং কার তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার টাকা আর সম্পূর্ণ ফ্লাইং রেস্কিউ কার তৈরিতে খরচ হবে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়