ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছাতকের সুমন, যাকে নিয়ে গর্ব করে মানুষ

শাকির হোসাইন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ২৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছাতকের সুমন, যাকে নিয়ে গর্ব করে মানুষ

শাকির হোসাইন, সিলেট : গত ৭ বছরে সিলেটের বিশ্বনাথ ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ৪ ইউনিয়নের বহু রাস্তাঘাট সংস্কার করেছেন সুমন একাই। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে এককাপ চাও খায়নি সে।

সড়কের দুপাশের মাটি দেবে গেলে কিংবা ধসে গেলে সেখানে মাটি ভরাটের কাজ করেন সুমন। আবার যে সড়ক খানাখন্দে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে সেটিকে করে তোলেন চলাচলের যোগ্য । গ্রামের ভেতরের নালায় বাশঁ দিয়ে তৈরি করেছেন কালভার্ট। আবার ব্রিজের এপ্রোচ সড়কও তৈরি করে দিয়েছেন।

এই হচ্ছেন ছাতকের সুমন। এসব কাজের জন্য এলাকাবাসী তাকে নিয়ে গর্ব করেন।

এলাকাবাসী জানান, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বাগইন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৌরশ আলীর ৩ ছেলের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়। সুমনের একমাত্র বোনটি কলেজে পড়াশুনা করলেও অন্য ভাইয়েরা কেউ প্রাইমারির গন্ডি পেরোতে পারেনি।

সম্প্রতি সরেজমিনে সুমনের কাজ দেখতে গেলে কথা হয় সুমনের সঙ্গে। সুমন জানান, সে ৪র্থ শ্রেণির পর আর স্কুলে যাননি।একদিন স্কুলে যাওয়ার সময়ই দেখতে পান রাস্তাঘাটের ভঙ্গুর দশা। আর সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেন মানুষের কষ্ট লাঘবে সড়কের দুরাবস্থা দূর করতে নিজেই কোদাল আর টুকরি নিয়ে নেমে পড়বেন কাজে। সেই থেকে শুরু। যে সড়কটি একেবারে চলাচলের অযোগ্য সেই সড়কে হাত দেন প্রথমে।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার সিঙ্গেরকাচ ইউনিয়ন ও ছাতকের ছৈলা আফজলাবাদ, গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাও ও দোলারবাজার ইউনিয়নের কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করেছেন।এছাড়া তৈরি করে দিয়েছিন অনেক বাশের সাঁকোও। এছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি সড়কের একপাশে ড্রেনের কাজও করেছিলেন। কিন্তু পুরো শেষ করতে পারেননি। এলাকাবাসীর অসহযাগীতার কারণে শেষ পর্যন্ত সেই ড্রেনটি ভরাট করে দেন। এ ঘটনাটি তার মনে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছে বলে জানান সুমন।

এ কাজে লাগার পর লোকজন নিশ্চয় পাগল বলত? এ প্রশ্নের জবাব সুমন বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার কাজ দেখে আমাকে উদ্দেশ্য করে পাগল বলে গালাগাল করত। কিন্তু আমি তাতে কান দেইনি। তারা না বুঝে এসব বলত।’

সুমনের দেশসেবা অনটনের সংসারে কেউই ভাল চোখে নেয়নি। পরিবার থেকে মাঝে মধ্যে বের করে দিলেও টুকরি-কোদাল নিয়ে মাটি কাটা বন্ধ করেননি সুমন। পেটে ভাত না থাকলেও কাজ চালিয়ে যান তিনি।

 



গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাও ইউনিয়নের শ্যামনগর গ্রামের প্রবাসী আব্দুল ওয়াদুদ তুহিন বলেন, ‘দেশে আসার পর দেখি গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া আন্ত:ইউনিয়ন সড়কে সারাদিন ধরে কাজ করছে একটি ছেলে। খবর নিয়ে জানলাম এই ছেলেটি বিনা পারিশ্রমিকে সারাদিন কাজ করে। অসচ্ছল পরিবারের হয়েও দেশের প্রতি তার মমতাবোধ সত্যিই গর্ব করার মতো।’

সুমন প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ শুরু করে। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেয়না। স্থানীয়রা বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তা করতে চাইলেও নেয়নি সে।

গোবিন্দগঞ্জ থেকে বিনোদপুর পযর্ন্ত আন্ত: ইউনিয়ন সংযোগ সড়কটি তৈরি করেছে এলজিইডি বিভাগ। ৭ ফুট প্রস্থ হওয়ায় দুই সিএনজি অটোরিকশা পাশাপাশি দাঁড়াতে পারেনা। এক চাকা সড়কের পাশে মাটিতে নামাতে হয়। সে কারণে মাটি দেবে যায়। তৈরি হয় বড় বড় ভাঙা। প্রায়ই সেসব ভাঙায় দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণে গুরুত্ব বুঝে কাজে নামে সে।

সুমনকে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক আখ্যা দেন ছাতক উপজেলা চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল।  তিনি বলেন, ‘সুমন শুধু ছাতকের নয় সে পুরো দেশের গর্ব। তার মত নিলোর্ভ মানুষ হয়না। তার কাজ দেখে আমি বিস্মিত। সারাদিন ছেলেটি দেশ সেবায় কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেকস্থানে আমি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলাম কিন্তু সুমন করছে সেজন্যে আর টেন্ডার দেইনি।’

এটি সমাজের এবং দেশের মানুষের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন এই জনপ্রতিনিধি। বলেন, ‘সুমনের পরিবারের জন্য কিছু করা যায় কিনা সে বিষয়ে চেষ্টা করব।’



রাইজিংবিডি/সিলেট/২৫ মে ২০১৭/শাকির হোসাইন/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়