ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নজরুলের শেষ জীবন ও কিছু কথা

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২২, ২৬ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নজরুলের শেষ জীবন ও কিছু কথা

নজরুল মৃধা : বিপ্লব, সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতা, গদ্য, উপন্যাস, সঙ্গীত, গল্পসহ সাহিত্য-শিল্পের নানা শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। সঙ্গীতেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভিন্ন এক মাত্রায়। অসাম্প্রদায়িক এই কবি মাত্র ২৩ বছরের লেখক জীবনে বাঙালির চিন্তা চেতনা, মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্তহাতে ধরেছিলেন কলম, গেয়েছিলেন সাম্যের গান।

১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের লামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ওরফে দুখু মিয়া।

দুই বাংলাতেই নজরুলের কবিতা ও গান সমানভাবে সমৃদ্ধ। কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি বিদ্রোহী কবি পরিচয়ে ভূষিত হন। কবিতার মাধ্যমে তিনি নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছেন কবিতাকে। কবি-সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরে রাজনীতিবিদ ও সৈনিক হিসেবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন নজরুল। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতোই তার প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে। এ কারণেই তিনি বিদ্রোহী কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্য কর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও অপরটি ভাঙ্গার গান। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে বদলে দিয়েছিল। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। এই কাব্যগ্রন্থের প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহ কামাল পাশা, শাত-ইল-আরব, আগমনী, খেয়াপারের তরণী প্রভৃতি কবিতা বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক সৃষ্টি করে।

সঙ্গীত রচনায় নজরুল অসাধারণ প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রবপদী ধারার সঙ্গে। দুর্বোধ্য ও আভিজাত্য নিয়ে চলা রাগনির্ভর গানকে ভেঙে-চুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। রাগ-রাগিনীকে নিয়ে দারুণভাবে খেলিয়েছেন গানে গানে। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সঙ্গীতে এক নতুন ধরার সৃষ্টি করেছেন। রাগ-রাগিনী নিয়ে এই ভাঙা-গড়ার খেলায় মীনাক্ষী, দোলনচাঁপার মতো নতুন অনেক রাগের সৃষ্টি করেছেন তিনি। এক কথায় বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে সৃষ্ট নজরুল সঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের এক অপার বিস্ময়।

বাল্য বয়সেই নজরুল লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেটো দলে (বাংলা রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) যোগ দেন। এই দলে তার সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। এই দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য তিনি গান ও কবিতা রচনা করেন। নজরুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। অতি দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছু দিন কাজ করার পর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারববর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেলও খেটেছেন। জেলে বসে লিখেছেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও নিজেকে কখনোই সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বন্দি করেননি। তার সাহত্যিকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহী। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি কলম ধরেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাকট লিখলেও কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেওয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম শেষ ভাষণে বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বণিত হয়ে উঠেছে- আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের, সকল মানুষের...।’

১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গী মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জয়ন্তী উৎসবে সভাপতির বক্তব্যে নজরুল কালজয়ী এই ভাষণ দান করেন। দূরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক-রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার  পূর্বে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা। যারা ভালোভাবে নজরুলকে চিনতে চান, তাদের জন্য এই বক্তৃতার চেয়ে উত্তম কিছুই হতে পারে না।

আর যারা নজরুলকে নিয়ে অহেতুক টানা-হেঁচড়া করেন, রবীন্দ্র-নজরুলের ভেদাভেদ নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে মাথা খালি করে ফেলেছেন, তাদের জন্য নজরুল যেন নিজেই জবাব হাজির করে রেখেছেন এই কালজয়ী অভিভাষণে। দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কেমন করে হাসিমাখা মুখে মাথা উঁচু করে চলতে হয় তাই যেন শেখায় মিনিট ছয়েকের এই ছোট্ট বক্তৃতা। একটু খেযাল করলেই দেখা যাবে, বিগত সাত দশকে একটি দিনের জন্যও তার এই কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক কিংবা পুরাতন মনে হয়নি। সেই জায়গায় চির তরুণ বিদ্রোহী নজরুল স্বার্থক।

 

 

রাইজিংবিডি/রংপুর/২৬ মে ২০১৭/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়